মোদী জমানায় দিন-মজুরদের আত্মঘাতী হওয়ার হার অনেক বেড়ে গেছে। কিছুদিন আগে প্রকাশিত ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো, ২০১৯’র তথ্য জানাচ্ছে প্রতি বছর সমাজের এই বিপন্ন শ্রেণিটির আত্মঘাতী হওয়ার প্রবণতা ক্রমেই বাড়ছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই পরিসংখ্যানের মধ্যে কিন্তু বর্তমান মন্থর আর্থিক শ্লোডাউন এবং লকডাউন পর্বে নেমে আসা বিপর্যয়ের তথ্য ধরা নেই।
এনসিআরবি’র তথ্য দেখাচ্ছে, ২০১৯ সালে যতজন ভারতে আত্মঘাতী হয়েছেন, তার মধ্যে দিনমজুরদের হার ২৩.৪ শতাংশ। আত্মঘাতী হওয়ার মধ্যে চতুর্থতম ব্যক্তিই হলেন দিনমজুর। ২০১৪ সালে এই মৃত্যুর হার ছিল ১২ শতাংশ, ২০১৯-এ যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৩.৪ শতাংশ। এই রিপোর্ট আরও জানিয়েছে, এই তথ্যের মধ্যে নেই সেই সমস্ত পরিযায়ী দিন মজুরদের সংখ্যা কারণ সরকারের কাছে এই তথ্য তাদের নেই।
দেখা যাচ্ছে, বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে কৃষি ও অ-কৃষি ক্ষেত্রে শ্রমের চাহিদা কমে যাচ্ছে। জেএনইউ’র ইনফর্মাল সেক্টর ও লেবার স্টাডিস এর সহকারী অধ্যাপক অনমিত্র রায়চৌধুরী জানিয়েছেন “একদিকে অর্থনীতির মন্থরতার কারণে কর্মসংস্থান কমেছে বিরাট ভাবে, অন্যদিকে বেড়েছে শ্রমের জোগান। এর ফলে দৈনিক মজুরির উপর অনেক চাপ পড়ছে, আর হ্রাসপ্রাপ্ত হচ্ছে মজুরির হার।” তিনি আরও বলেছেন, “২০১৪-১৫তে খরার জন্য পরিস্থিতি আরো ঘোরালো হয়ে ওঠে। তার জন্য শ্রমিকেরা কৃষি থেকে অ-কৃষিক্ষেত্রে সরে যাচ্ছে আর তার প্রভাব পড়ছে মজুরি ও কাজের জোগানের উপর। ২০১১ থেকে ২০১৭র মধ্যে ক্যাজুয়াল শ্রমিকদের প্রকৃত মজুরি কমে অর্ধেক হয়ে যায়। এটা অ-কৃষি ক্ষেত্রের আরেকটা সংকটকেই দেখিয়ে দেয়।
এনসিআরবি’র তথ্য থেকে উঠে আসছে, সবচেয়ে দরিদ্র অংশের মধ্যেই আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি, যারা বছরে এক লাখের কম উপার্জন করে। ২০১৯ সালে মোট আত্মঘাতী ১ লক্ষ ৩৯ হাজার ১২৩ জনের মধ্যে ৯২ হাজার ৮৩ জন (অর্থাৎ ৬৬.২ শতাংশ)-র বার্ষিক আয় এক লক্ষ টাকারও কম। আর, যারা আত্মঘাতী হয়েছেন তাদের মধ্যে ২৯.৬ শতাংশ, অর্থাৎ ৪১ হাজার ১৯৭ জনের বাৎসরিক আয় এক লক্ষ থেকে পাঁচ লক্ষ টাকা।
বেশিরভাগ ভারতীয় শ্রমিকরা নির্দিষ্ট কোনো চুক্তি বা কন্ট্রাক্ট ছাড়াই কাজ করেন, জানালো বিশ্ব ব্যাঙ্ক। বিশ্ব ব্যাঙ্ক আরও জানালো, ভারতে মাত্র ২৪ শতাংশ শ্রমিক কোন না কোন ধরনের চুক্তি বা কন্ট্রাক্ট-এর ভিত্তিতে কাজ করেন, যাদের রয়েছে নির্দিষ্ট আয়। আর, বিপুল ৭৬ শতাংশ শ্রমিকরাই ইনফর্মাল ভিত্তিতে কর্মরত, যাদের নেই কোনো ধরনের কাজের ও মজুরির নিশ্চয়তা, সামাজিক সুরক্ষা যেখানে মরীচিকা মাত্র। কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রক জানিয়েছে, তাদের কেন্দ্রীয় ডেটাবেস অনুযায়ী ১.০৪ কোটি পরিযায়ী শ্রমিক নিজ নিজ রাজ্য বা এলাকায় ফিরে গেছেন আর এক্ষেত্রে উত্তর প্রদেশের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি – ৩২.৪ লক্ষ। আর এই সুবিপুল অংশটাই কাজ করেন কোনো ধরনের লিখিত কন্ট্রাক্ট ছাড়াই। বিশ্ব ব্যাঙ্কের হিসাব অনুযায়ী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৯৩.৮ শতাংশ শ্রমিক কোনো না কোনো কন্ট্রাক্টের ভিত্তিতে কাজ করেন। জার্মানি, ফ্রান্স ও চীনে এই সংখ্যাটা হলো যথাক্রমে ৯০.২ শতাংশ, ৮৮.৪ শতাংশ এবং ৫৩.৫ শতাংশ।
বৃহৎ অর্থনৈতিক দেশগুলোর মধ্যে ভারতেই অনথিভুক্ত শ্রমিকদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। আর, এনসিআরবি তথ্য দেখিয়েছে জনসংখ্যার এই বিপুল অংশটাই সবচেয়ে বেশি বিপন্ন, প্যান্ডেমিক যাদের জীবনকে ছাড়খার করে দিল।
(সুত্র - টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২০)
- অতনু চক্রবর্তী