অন্নদাতাদের সংহতিতে কলকাতার বুকে চলমান অবস্থানে যুক্ত হলো ব্যাপকতর নাগরিক সমাজ। আজ ষষ্ঠ দিন হয়ে গেলো রাজ্য রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র ধর্মতলার বুকে চলছে দিল্লীর কৃষক আন্দোলনের সংহতিতে লাগাতার অবস্থান। এ রাজ্য আর দেশের রাজধানী অন্নদাতাদের প্রখর দাবিতে একই সুরে মিলে গেলো। অবস্থানে প্রতিদিন বিভিন্ন জেলা থেকে কৃষকরা, কৃষক আন্দোলনের কর্মীদের উপস্থিতি জানান দিলো বাংলার কৃষকরা সারা দেশব্যাপী এই কৃষক আন্দোলনের সাথে আছে। পাশাপাশি এই অবস্থানে অংশগ্রহণ করলেন রাজ্যের গণআন্দোলনের বিভিন্ন নেতৃত্ব ও কর্মীবৃন্দ। শ্রমিক কর্মচারী থেকে শুরু করে ছাত্র- শিক্ষক-কবি-শিল্পী-বুদ্ধিজীবী-নারী আন্দোলনের কর্মী-সাংস্কৃতিক কর্মী, বিভিন্ন পত্র পত্রিকার সম্পাদক সহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের নাগরিক সমাজ। শিল্পীরা সংগ্রামের ছবি আঁকলেন,তথ্য চিত্র নির্মাতারা কৃষক আন্দোলনের ছবি প্রদর্শন করলেন। এইভাবে অবস্থান কর্মসূচীটি হয়ে উঠেছে বিভিন্ন প্রতিবাদী শক্তির এক সমন্বয় মঞ্চ।
নয়া কৃষি আইনের ফলে কৃষি পণ্যের অভাবী বিক্রি, বিপরীতে বাজারে সেই পণ্যের চরম মূল্যবৃদ্ধি দূটোই একসাথে চলতে থাকবে এ রাজ্যের কৃষকরা তাদের জীবনের অভিজ্ঞতায় সেটা বুঝতে পেরেছেন। তারা ঠেকে শিখেছেন ঋণফাঁদে কিভাবে তারা জর্জরিত হয়েছেন। কেন্দ্রীয় সরকার লকডাউনের বাজারে সার ডিজেল বিদ্যুৎ এর মূল্যবৃদ্ধি কৃষকদের সর্বনাশের পথে ঠেলে দিয়েছে। কিভাবে ধানের সরকারী দর থেকে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার চাষিদের বঞ্চিত করে চলেছে। তাই তারা দিল্লীর কৃষক আন্দোলনের দাবিগুলির সাথে একই আওয়াজ তুলে ধরেছেন, কৃষিকে কর্পোরেট-পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দেওয়া, মজুতদারী কালোবাজারি মূল্যবৃদ্ধি বৈধ করা চলবে না।
ফসলের ন্যায্য দাম চাই, কম দামে সার বীজ, বিদ্যুৎ চাই। মজুরি ও খাদ্য সংকটে নগদ ভর্তুকি দাও। সব হাতে কাজ, শ্রমিকের মর্যাদা ও সামাজিক সুরক্ষা চাই। ফ্যাসিষ্ট রাজ নয়, গণতন্ত্র চাই।
অবস্থানে বিভিন্ন বক্তা যে বিষয়গুলি তুলে ধরেছেন তা হলো, বর্তমান পরিস্থিতিতে এ রাজ্যের বুকে দলবদল আর নির্বাচনী ক্ষমতা দখলের শোরগোলের নীচে চাপা দেওয়া হচ্ছে কৃষকের চরম দূর্দশা, কাজ না পাওয়া, মজুরি কমে যাওয়া বেকারের যন্ত্রণা, শ্রমিকের অধিকার কেড়ে নেওয়া সহ গরিব মানুষের জ্বলন্ত সমস্যাগুলিকে। রাজনীতিকে দুটো শিবিরে যেন ভাগ করে দেওয়ার চক্রান্ত শুরু হয়েছে – শাসক আর বিরোধী। কিন্তু এর বাইরে চলমান ব্যাপক জনগণের লড়াই,বিভিন্ন প্রতিবাদী শক্তির সংগ্রামী ঐক্য শাসকের ভিত্তিকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে। তুলে ধরছে সংগ্রামের নতুন বার্তা। দিল্লীর বুকে লক্ষ লক্ষ কৃষকের মরণপন লড়াই, বহু কৃষকের আত্মদান, জলকামান আর দমনপীড়নকে মোকাবিলা করে মোদীর ফ্যাসিষ্ট রাজত্বকে প্রবল চাপে ফেলেছে। শ্রমিকের ধর্মঘট সৃষ্টি করেছে নয়া ইতিহাস! শাহিনবাগের মতো এই সব আন্দোলনকে “আরবান নকশাল” বলে চিহ্নিত করার অপচেষ্টা চলছে। কিন্তু আন্দোলনগুলি আরও তীব্র ও ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ছে।
কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে সারা দেশের কৃষকরা দীর্ঘ দিন ধরে দাবি তুলেছে, ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (এমএসপি) গ্যারান্টির আইন চাই, সঠিক হিসাব করে উৎপাদন খরচের দেড়গুণ দাম চাই। সংখ্যাগরিষ্ঠ ক্ষুদ্র চাষিরা চেয়েছে কৃষি উপকরণের দাম কমাও, কম সূদে কৃষি ঋণ দাও! ঋণ মুক্তি চাই! কৃষি ও গ্রামীণ মজুরদের দাবি কাজ, মজুরি ও খাদ্য সংকটে নগদ ভর্তুকি চাই! কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার উল্টো দিকে যাত্রা শুরু করেছে। সার ডিজেল বীজ সহ কৃষি উপকরণের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। ফসলের ন্যায্য দাম পাওয়ার অধিকার কেড়ে নিয়ে এখন কৃষকসন্মান প্রকল্পর নামে চাষিকে কার্যত অপমান করা হচ্ছে। ন্যূনতম সহায়ক মূল্য না পাওয়ার জন্য চাষির বিরাট লোকসান হয়ে চলেছে! কেন্দ্রীয় সরকার রেল সহ সমস্ত সরকারী ক্ষেত্রগুলিকে বিক্রি করে দিয়ে কর্মসংস্থানের জায়গাটাকে বন্ধ করে দিচ্ছে। কাজ হারানো, মজুরি কমে যাওয়া, হাজার হাজার মাইল পথ হাঁটা পরিযায়ী শ্রমিকের পাশে ওরা দাঁড়ায়নি। ১০০ দিনের প্রকল্পে বরাদ্দ ছাটাই করে সারা দেশে এই প্রকল্পকে প্রায় তুলেই দিয়েছে। লকডাউনের আর্থিক সংকট চলছে, অথচ রেশনে যেটুকু বাড়তি দেওয়া হচ্ছিলো সেটা বন্ধ করে দিয়েছে।
রাজ্য সরকার ঘোষিত দামে ফসল কিনছে না, চাষিদের লোকসান করিয়ে এখন কৃষকবন্ধুর নামে দেওয়া হচ্ছে ধোঁকা। গ্রামে ক্যাম্প করে ধান সহ সমস্ত ধরনের ফসলের সরকারী দর নির্ধারণ করে কেনার ব্যবস্থা করছে না। ছিটে ফোঁটা অনুদান প্রকল্পকে অনুগ্রহ বা দয়ার দান হিসাবে দেখিয়ে ভোটের বাক্সে ফয়দা তুলতে চাইছে। অথচ রাজ্যের কয়েক কোটি শ্রমজীবী মেহনতিরা বঞ্চিতই থেকে যাচ্ছে! তৃণমূল সরকার মুখে কেন্দ্রীয় কৃষি আইনের বিরোধীতা করলেও তাকে ঠেকাতে এ রাজ্যে পৃথক আইন প্রণয়ন করছে না। ১০০ দিনের কাজে চলছে সীমাহীন দুর্নীতি।
অবস্থান মঞ্চে ধারাবাহিকভাবে অংশ নিয়েছেন এআইকেএসসিসি রাজ্য সচিব ও এআইকেএম নেতা কার্তিক পাল, এআইকেএসসিসির নেতা অভীক সাহা, সুশান্ত ঝা, সমীর পুতুতুন্ডু, প্রদীপ সিং ঠাকুর, শংকর দাস প্রমূখ। এছাড়াও ছিলেন এআইকেএম-এর কৃষ্ণ প্রামানিক, জয়তু দেশমুখ, তপন বটব্যাল, সুবিমল সেনগুপ্ত, সলিল দত্ত, আয়ারলার আনসারুল আমান মন্ডল, সজল অধিকারী, সজল পাল, এআইসিসিটিইউ-র বাসুদেব বসু, দেবব্রত ভক্ত, জীবন কবিরাজ প্রমূখ। আইসা ও অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের ছাত্রছাত্রীদের উজ্জ্বল উপস্থিতি, উত্তাল স্লোগান, বর্ণময় পোস্টার প্ল্যাকার্ড লিখন অবস্থানকে প্রাণবন্ত করে তোলে। গণ সংস্কৃতি পরিষদের নীতীশ রায়, বাবুনি মজুমদার সহ বিভিন্ন দলের সাংস্কৃতিক কার্যক্রম, অসীম গিরির গান সংগ্রামী মেজাজ তৈরি করে। বেশ কয়েকটি পথ নাটিকা প্রদর্শিত হয়। এ ছাড়াও অবস্থানে বক্তব্য রাখেন বামপন্থী বিধায়ক ও এআইকেএস নেতা মহঃ সেলিম, অগ্রগামী কিষণ সভার হাফিজ আলম সাইরানি, সংযুক্ত কিষাণ সভার সুভাষ নস্কর, বিকেএমইউ-র তপন গাঙ্গুলী, এআইকেকেএসইউ নেতা পঞ্চানন মন্ডল প্রমূখ বামপন্থী কৃষক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। অবস্থানকে লাগাতার চালিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন এআইকেএসসিসি নেতৃবৃন্দ।
আগামী কর্মসূচী –
(ক) ১৮ জানুয়ারী মহিলা কিষাণ দিবস হিসাবে মহিলাদের প্রতিবাদী কর্মসূচী পালিত হবে।
(খ) ২০-২১-২২ জানুয়ারী বৃহত্তর কৃষক জমায়েত করে ধর্মতলায় অবস্থান করা হবে।
(গ) ২৬ জানুয়ারী দেশব্যাপী ও রাজ্যে রাজ্যে ট্রাক্টর মিছিল বের হবে।