লাভ জিহাদ এবং মুঘল শাসন: ইতিহাস ও প্রচার
ssar

সংঘ পরিবারের ‘লাভ জিহাদ’ সম্পর্কিত প্রচার সরকারী নীতিতে রূপান্তরিত হয়েছে উত্তর প্রদেশের যোগী আদিত্যনাথের বিজেপি শাসিত সরকারের আদেশে। এই নতুন রায়ে ‘কানুন-বহির্ভূত’ ধর্মান্তরিতকরণকে জামিন-অযোগ্য অপরাধ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। সাম্প্রতিককালে বলপূর্বক ও প্রতারণামূলক ধর্মীয় রূপান্তরের উদাহরণ দেখিয়ে ধর্মান্তরীকরণের আগে জেলাশাসকের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

যদিও, এই আইন হিন্দুত্ত্ববাদীদের মুসলিম-বিরোধী, মহিলা-বিরোধী ও আম্বেদকরবাদ-বিরোধী হিন্দুরাষ্ট্রের স্বপ্নের অন্যতম অংশ। যোগী আদিত্যনাথ একটি সাম্প্রতিক ভাষণে খুব স্পষ্টভাবে বলেছেন লাভ-জিহাদ দমন করার জন্য তারা খুব কঠিণ আইন আনবেন। এই ভাষণ এবং এই আইন, ২০২০ থেকে তৈরি করা এক গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ, যা বলে মুসলিমরা দলে দলে হিন্দু মহিলাদের বলপুর্বক ধর্মীয় রূপান্তর করিয়েছেন। আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের অন্তরায় দাঁড়িয়ে এই আইন যা বলে “প্রত্যেকের ভাবনার, বিবেকবোধের এবং ধর্মের অধিকার আছে; নিজের ভাবনা বা ধর্মাচরণ পরিবর্তনের অধিকারও এর অন্তর্ভুক্ত, একা বা দলবদ্ধভাবে, প্রকাশ্যে বা একান্তে এই অধিকার সবার রয়েছে”। এই আইন স্বাভাবিকভাবেই আমাদের দেশের বিবিধ প্রকৃতির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে, একইসাথে নাগরিকদের নিজের সাথী পছন্দ করার এবং নিজের পছন্দের ধর্মে রূপান্তরের পথে অন্তরায় হবে।

মুঘলদের বারংবার এই বিতর্কে এনে বোঝানোর চেষ্টা হয়েছে যে মুঘল শাসকরা উপমহাদেশে ‘লাভ জিহাদ’ করেছেন বহুলভাবে। এবং এর মাধ্যমে প্রচার করার চেষ্টা হয়েছে আজকের মুসলিমরাও একই পথে চালিত এবং এটি মুসলিম পরম্পরা। কিন্তু ইতিহাস কি প্রমাণ করে? অড্র্যে টুশকের সাথে একটি কথোপকথন থেকে আমরা তা বোঝার চেষ্টা করতে পারি।

মুকুলিকা আর: নীচের বিবৃতিগুলির ব্যাপারে আপনার কি মতামত? “লাভ জিহাদ কোন নতুন জিনিস নয়। হিন্দু সম্প্রদায় থেকে এর সূত্রপাত নয়। এর উৎপত্তি মুঘলদের হাতে।” (চেতনা শর্মা, দূর্গা বাহিনীর আহ্বায়ক)

“ইসলামিক বই ‘তাবকাত-ই-আকবরী’তে লেখা রয়েছে আকবর জোধাবাঈকে মুসলিম ধর্মমতে বিয়ে করেছিলেন। ‘নিকাহ’-এর সময়ে তাঁর ধর্মান্তরণ হয় এবং নাম হয় মারিয়ম-উয-যামানি।” (‘লাভ জিহাদের ইতিহাস’, হিন্দুজন জাগৃতি সমিতি)    

অড্র্যে: মুঘল সম্রাটরা কিছু রাজপুত সাম্রাজ্যের অনুগত্যলাভের জন্য এবং মৌর্য্য সাম্রাজ্যের ক্ষমতায় প্রবেশ করার জন্য বিশেষ কিছু রাজপুত মহিলাকে বিয়ে করেছিলেন। এটা রাজনৈতিক কৌশল এবং ধর্মের সাথে এর কোনো যোগাযোগ ছিল না। বরং আকবর সারিয়া আইনের বিপক্ষে গিয়ে উলামার বিরাগভাজন হয়েছিলেন চারজনের বেশি মহিলার সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ায়। বহু মানুষ আজকের দিনে মুঘলদের ধর্ম প্রচারক মনে করেন, কিন্তু তা আধুনিক কল্পনা ছাড়া কিছু নয়। প্রাক-আধুনিক শাসক হওয়ার কারণে মুঘলরা যত জয় করেছিলেন তত রূপান্তর করেননি।

মুকুলিকা: আরেকটি বহুলপ্রচারিত মত হল, রাজপুত মহিলারা জোহর-প্রথার উদ্ভাবন এবং প্রসার করেছিলেন মুসলিম তথা মুঘল পুরুষদের হাত থেকে বাঁচার জন্য। এই বিষয়ে আপনার মত?

অড্র্যে: প্রাক-আধুনিক ভারতে সম্ভ্রান্ত পরিবারের অঙ্গবিশেষে জোহর ছিল বহুলপ্রচরিত। আমি খুব জোরের সাথে বলছি, এটি সম্ভ্রান্ত শ্রেণির প্রক্রিয়া, সাধারণ মানুষের মধ্যে এর প্রচলন ছিল না। রাজপুত মহিলারা জোহর করতেন শত্রুর হাত থেকে বাঁচতে, যাদের মধ্যে তাঁদের সমশ্রেণীর এবং তাঁদের শাসক হিন্দুরাও পড়তেন। রাজনৈতিক বিভাজন ছিল খুব পরিষ্কার, ধর্মীয় বিভাজন যদিও খুব অস্পষ্ট।

মুকুলিকা: দক্ষিণপন্থী এবং ঔপনিবেশিক লেখায় মুঘল হারেমগুলিকে ‘সমস্যাপ্রবণ’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে, যাতে হিন্দু মহিলাদের বন্দী রাখা হত। ঐতিহাসিকদের বর্ণনায় হারেম সম্পূর্ণ আলাদা এই সব বর্ণনা থেকে। আপনি এব্যাপারে কিছু বলবেন?

অড্র্যে: হারেমে রাজকীয় মুঘল-মহিলারা থাকতেন, একইরকম ব্যবস্থা ছিল রাজপুতদের মধ্যেও। উভয়ক্ষেত্রেই এই মহিলাদের ওপর কিছু বিধিনিষেধ ছিল এবং তারা কিছু স্বাধীনতাও উপভোগ করতেন। কিন্তু ‘লাভ জিহাদে’র মতো পাগলের প্রলাপ বকার মাধ্যমে এই দলগুলি যে প্রচার চালানোর চেষ্টা করছে, এই পৃথিবী তার থেকে বহু দূরে। এরা লাভ জিহাদ বলে চেঁচায় এবং আমি শুধু দেখতে পাই ‘ঘৃণার যুদ্ধ’ যার মাধ্যমে এই হিন্দুত্বের প্রচারকরা ভারতীয় মহিলা, অল্পসংখ্যক এবং সকলের ধর্মীয় স্বায়ত্ত্বের অধিকারকে বিপন্ন করে চলেছে।

মুকুলিকা: এরকম কোনো প্রমাণ রয়েছে যা দিয়ে দেখানো যেতে পারে সে সময়ে বিয়ে ছাড়াও অন্য পদ্ধতিতে মুঘলরা গণরূপান্তর করেছেন? তাছাড়াও, ভারতীয় উপমহাদেশে মুঘলদের আগেও বহু মুসলিম শাসক থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র মুঘলদের ওপর নিবিষ্ট এই আক্রমণের কারণ কী?

অড্র্যে: মুঘলরা ইন্দো-মুসলিম শাসকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি চর্চিত কারণ মানুষ তাঁদের সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি জানে, অথবা তারা মনে করে তারা বেশি জানে। সত্যি কথা বলতে, আমার মনে হয়, খুব কম মানুষই প্রাক-মুঘল যুগের কিছু ইন্দো-মুসলিম শাসকদের নাম জানেন। এর কোনো সুরাহা আমি অদূর ভবিষ্যতে আশা করি না, কারণ হিন্দুত্ববাদী বর্ণনায় ইতিহাসের বিষয়ে অজ্ঞতাকেই অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। ইন্দো-মুসলিম শাসন ভারতবর্ষের ইতিহাসে এক লম্বা, সমৃদ্ধ এবং বিবিধ সময়কাল, বেশিরভাগ মানুষ বেশ অবাক হবেন এই অদ্ভুত সময়কাল সম্বন্ধে জানলে। মুঘলরা কোনোদিন রাষ্ট্রের অধীনে বিশাল ধর্মীয় রূপান্তরের আয়োজন করেননি। তাঁরা ইসলামে রূপান্তরের ব্যাপারে কখনোই বিশেষ ভাবিত ছিলেন না (এর কিছু ব্যতিক্রম রয়েছে)। ইতিহাসে এই গণরূপান্তরের কল্পনা এবং তা নিয়ে মোহাবদ্ধতা একটি আধুনিক ঘটনা, যা সমসাময়িক উদ্বেগের প্রতিফলন এবং অশুভ রাজনীতির পাথেয়। এই ভুল ইতিহাস হিন্দুত্ববাদীদের হাতে ভারতীয়দের ধর্মীয় স্বাধীনতা হননের হাতিয়ার, মূলত বিস্তৃত পরিসরে হিন্দু-ধর্ম পালনের অধিকার এবং অহিন্দু হওয়ার বা হতে চাওয়ার অধিকারকে হননের হাতিয়ার।

মুকুলিকা: যৌন অনাহারভুক্ত, লম্পট এবং হতাশ, পশু-স্বরূপ এবং বর্বরোচিত, ক্রমান্বয়ে অবুঝ হিন্দু মহিলাদের বিয়ের প্ররোচনা দেওয়া – এই কথাগুলি ভারতের প্রচলিত বর্ণনায় মুঘল এবং মুসলিমদের পরিচয়। কীভাবে এই ব্যাখ্যাগুলির বিরোধ করা যায়?

অড্র্যে: এই মুসলিম বিরোধী বক্রোক্তিগুলির সূচনা আধুনিক সময়ে, তাই সেখান থেকেই আমাদের শুরু করতে হবে। মানুষকে তাদের আধুনিক পক্ষপাত শনাক্ত করতে হবে এবং মোকাবিলা করতে হবে, যা খুব সোজা কাজ নয়। মুসলিমভীতি ভারতে প্রসারিত এবং দিন দিন আরও খারাপ দিকে চলেছে, বহু লোকের কাছেই এটি একটি গ্রহণযোগ্য সংস্কার। মানুষকে এটা বদলাতে হবে এবং তারপর বর্ণবাদ-বিরোধী আরও কঠিন কাজে হাত লাগাতে হবে, ব্যক্তি-বিশেষের জন্য এবং সমগ্র সমাজের স্তরে।

আজকের দিনে ঘৃণা চিহ্নিত করে কাটিয়ে ওঠার পরেই আমরা ইতিহাসের ওপর দৃষ্টিপাত করতে পারি এবং আরও বেশি জানতে পারি, নিজেদের পক্ষপাত নথিভুক্ত না করে। বহু বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ভারতীয় ইতিহাসের এই বিশেষ অধ্যায়ের বিশ্লেষণ করেছেন, যাদের কেউ এই হিন্দুত্ববাদী বিবরণের সমর্থন করেন না। এর থেকে আমরা বর্তমানে ফিরে আসতে পারি। মানুষজনের ইতিহাসের ব্যাপারে এই আধুনিক কল্পকথা ছেড়ে আসল ইতিহাসের সন্ধান করা উচিত। যতক্ষণ তা না হচ্ছে, মানুষ এই কাল্পনিক লাভ জিহাদের জালে আটকে থাকবে এবং ভারতীয় ইতিহাসের জটিলতা ও ঘটনাক্রমের সম্বন্ধে কোনো ধারণাই তাদের থাকবে না।

(অড্র্যে ট্রুশকে নেওয়ার্কের রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসের সহযোগী অধ্যাপক। মুকুলিকা আর নিউ দিল্লীর ভারতীয় সাংস্কৃতিক ফোরামের সম্পাদকীয় গোষ্ঠীর সদস্য।

indianculturalforum.in-এ প্রকাশিত সাক্ষাৎকার)

দেশব্রতীর জন্য অনুবাদ: কৌশিকী ভট্টাচার্য

খণ্ড-28
সংখ্যা-2