বিক্ষোভরত কৃষক এবং মোদী সরকারের মধ্যে সপ্তম পর্যায়ের আলোচনা ব্যর্থ হয়েছে। যে কৃষকরা বজ্র-বিদ্যুৎ সহ ঝড়-বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে তীব্র ঠান্ডার মধ্যে দিল্লীর সীমানায় অবস্থান করছেন, তাঁরা সরকারকে সুস্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন কৃষক-বিরোধী তিনটে আইনের পুরোপুরি বাতিল ছাড়া কোনো কিছুকেই তাঁরা মেনে নেবেন না। এই তিনটে আইনকে প্রত্যাহার করে নিতে মোদী সরকার কিন্তু অনমনীয় মনোভাব দেখিয়ে চলেছে।
শুধুমাত্র ধনী কৃষকরাই, এবং তাও আবার পাঞ্জাবের কৃষকরাই বিরোধী পক্ষের প্ররোচনায় বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন — এই গালগল্পটাকে চালানো সরকারের পক্ষে ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে। দিল্লীর সীমানায় পাঞ্জাব ও হরিয়ানার কৃষকদের সঙ্গে বিক্ষোভে যোগ দিয়েছেন রাজস্থান, উত্তর প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, বিহার, ঝাড়খণ্ড এবং তামিলনাড়ুর কৃষকরা। বিহারে হাজার-হাজার ক্ষুদ্র ও মধ্য কৃষক এবং কৃষি শ্রমিকরা কৃষি আইনগুলো বাতিলের দাবিতে সরকারের প্রশাসনিক সদর দপ্তরে অভিযান সংগঠিত করেছেন। এটাও অত্যন্ত সুস্পষ্ট যে, কৃষকদের পিছনে সাধারণ ভারতবাসীর সমর্থন ও সংহতিও রয়েছে।
নৈতিক এবং রাজনৈতিক উভয় দিক থেকেই কিন্তু কৃষকদেরই প্রাধান্য রয়েছে। যে ঘটনাটা এই বিষয়টাকে প্রতিষ্ঠিত করছে তা হল — কৃষক আন্দোলন চলাকালীন নিহত কৃষকদের স্মৃতিতে কৃষকরা যখন দু-মিনিট নীরবতা পালন করছিলেন, সে সময় সেখানে উপস্থিত কৃষক প্রতিনিধি দলের সঙ্গে সাক্ষাৎকারী মন্ত্রীরাও তাতে যোগ দেন। এই প্রতীকী অভিব্যক্তি প্রকাশে মন্ত্রীদের বাধ্য ক’রে কৃষকরা বিজেপির এই প্রচারটাকে ভোঁতা করে দিতে পেরেছেন যে, কৃষকদের আন্দোলনটা অবৈধ এবং তাদের মধ্যে রয়েছে শুধু “দেশদ্রোহী” ও “খালিস্তানি সন্ত্রাসবাদীরা”।
ইতিমধ্যে, প্রথম সারির এক সংবাদপত্রে দেওয়া তাঁর সাক্ষাৎকারে মোদী মন্ত্রীসভার বরিষ্ঠ সদস্য এবং বিজেপি নেতা নীতিন গডকড়ি এমন কিছু মন্তব্য করেছেন যা এই কৃষি আইনগুলোর পিছনে থাকা সরকারের অভিপ্রায় সম্পর্কে কৃষকদের আশঙ্কাকেই উন্মোচিত করে দেয়।
গডকড়ি কোনো রাখঢাক না করেই জানিয়ে দিয়েছেন যে, এই নতুন কৃষি আইনগুলো প্রবর্তন করা হয়েছে ভারতীয় কৃষির সমস্যার “মূল কারণগুলোকে” শোধরানোর জন্য, তাঁর কথায় যেগুলো হল : “উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য”; আর খাদ্যশস্যর জন্য যে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য সরকার দেয় তা অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজারের দামের চেয়ে বেশি হওয়া। গডকড়ির কথাগুলো আক্ষরিকভাবে হল, “আমাদের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য আন্তর্জাতিক এবং বাজারের দামের চেয়ে বেশি, আর সমস্যাটা সেখানেই। আমি গত বারো বছর ধরে ইথানলের কথা বলে আসছি। কিন্তু খাদ্যশস্যকে রূপান্তরিত করার (জ্বালানিতে) অনুমতি দেওয়া হয়নি। মূল সমস্যাটা হল উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য এবং ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের পরিমাণ বাজারের দামের চেয়ে বেশি হওয়া।”
গডকড়ির সাক্ষাৎকার সরকারের এই দাবিকে নির্ভেজাল মিথ্যা বলে প্রতিপন্ন করছে যে, নতুন আইনগুলো শুধু ন্যূনতম সহায়ক মূল্যকেই রক্ষা করবে না, কৃষকদের খোলা বাজারে কোম্পানিগুলোর কাছে এমন দামে খাদ্যশস্য বিক্রির “স্বাধীনতা” দেবে যা ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের চেয়ে বেশি। কৃষকরা ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের দাবি করেন কেননা তাঁরা জানেন, বাজারের দাম কম হওয়ার দিকেই যাবে; আর ন্যূনতম সহায়ক মূল্য না থাকলে তাঁরা উৎপাদনের খরচের চেয়ে কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হবেন। সরকার কিন্তু ন্যূনতম সহায়ক মূল্যকে একটা সমস্যা রূপেই দেখছে, আর নতুন আইনগুলোকে এই উদ্দেশ্যেই প্রবর্তন করেছে যাতে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজারে অনেক কম দামে খাদ্যশস্য বিক্রি ছাড়া কৃষকদের কাছে অন্য কোনো উপায় না থাকে।
গডকড়ির সাক্ষাৎকার থেকে এটাও পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে যে, সরকার নতুন কৃষি আইনগুলোকে এনেছে যাতে তথাকথিত “উদ্বৃত্ত” খাদ্যশস্যগুলোকে গণবন্টন ব্যবস্থা এবং দরিদ্রদের জন্য রেশন ব্যবস্থা থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়াটাকে সহজতর করা যায়। প্রকট সত্যিটা হল ভারতের “উদ্বৃত্ত” খাদ্যশস্য গোডাউনগুলোতে যখন পচে তখন বিশ্ব খাদ্য সূচকে ১০৭টা দেশের মধ্যে ভারতের স্থান হয় ৯৪ নম্বরে, প্রতিবেশি বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং নেপালেরও পিছনে। খাদ্যশস্য “উদ্বৃত্ত” হয় কারণ, সরকার সর্বজনীন গণবন্টন ব্যবস্থার বদলে “নিয়ন্ত্রিত লক্ষ্যমাত্রা ভিত্তিক” গণবন্টন ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছে যা ভারতের দরিদ্র জনগণের এক বড় অংশকে বঞ্চিত ও অভুক্ত করে রাখছে। অনাহারকেই মূল সমস্যা বলে চিহ্নিত না করে মোদী সরকার এখন দাবি করছে যে, গোডাউনগুলোতে উপছে পড়া উদ্বৃত্তই হল মূল সমস্যা, এবং খাদ্যশস্যকে জৈব জ্বালানিতে রূপান্তরিত করার বিধান দিচ্ছে। নতুন আইনগুলোর মধ্যে চুক্তি ভিত্তিক চাষকে সর্বব্যাপী করার উদ্দেশ্য রয়েছে, এবং অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে তা এই পরিবর্তনে মদত যোগাবে। এইভাবে খাদ্যশস্যের জন্য আমরা অন্যান্য দেশের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ব, ফলে দরিদ্রদের খাদ্যের নিরাপত্তাহীনতাও বৃদ্ধি পাবে।
গডকড়ি খোলসা করে যা বলেননি তা হল — মোদী সরকার ন্যূনতম সহায়ক মূল্যকে তুলে দিতে চাইছে, কৃষকদের এমন অবস্থায় ফেলতে চাইছে যাতে তারা অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজারে নির্ধারিত দামে খাদ্যশস্য বিক্রি করতে বাধ্য হয়, এবং আরও চাইছে খাদ্যশস্য সংগ্ৰহ ব্যবস্থা এবং গণ বন্টন ব্যবস্থাকে তুলে দিতে। এ সবই তারা করতে চাইছে ভারতীয় কৃষকদের সরকারী সহায়তাকে হ্রাস করার বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার হুকুমকে তামিল করতে।
সরকারের ভাঁওতা ভারতীয় কৃষকদের কাছে দিবালোকের মতোই স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে, এবং তিনটে আইনকে ঝাড়েমূলে বাতিল করার দাবিতে তাঁরা অবিচল রয়েছেন।
তাঁরা ঘোষণা করেছেন, নিজেদের দাবিকে জোরের সাথে তুলে ধরতে তাঁরা ২৬ জানুয়ারী প্রজাতন্ত্র দিবসে ট্রাক্টরে করে রাজধানী দিল্লী অভিযান করবেন। কৃষক আন্দোলনের সামনের সারিতে থাকা কৃষকরা লড়াই করছেন ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের রক্ষায়, তাঁরা শুধু কৃষকদের অধিকারের দাবিতেই সোচ্চার হচ্ছেন না, তাঁরা সমস্ত নাগরিকের প্রতিবাদের অধিকারকে, খাদ্য নিরাপত্তা ও খাদ্য রেশনের অধিকারকে, এবং কোম্পানি রাজ-এর হাত থেকে দেশের স্বাধীনতাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরছেন। অতীব গুরুত্বপূর্ণ এই লড়াইয়ে ভারতের জনগণ কৃষকদের পাশেই রয়েছেন।
(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয়, ৫ জানুয়ারী ২০২১)