বঙ্গে নির্বাচন যত নিকটবর্তী হইতেছে, বর্গী হামলা তত তীব্রতর হইতেছে। প্রায় প্রতিদিন বায়ুযানে বিভিন্ন বর্গের কমলবাবুদের আগমন ঘটিতেছে। ঘৃত ননী দুগ্ধ দধি পোষিত, নধরকান্তি, বহুমূল্য শালশোভিত ‘তাঁহারা’ কুসুমাস্তীর্ণ পথে গোলাপ পাপড়ি নিক্ষেপ করিতে করিতে ট্রাকবাহনে গজেন্দ্রগমনে ‘রোড-শো’ করিতেছেন। বিভিন্ন ক্যাটাগরির বহুমূল্য নিরাপত্তাসুরক্ষিত ‘তাহাদের’ রাজ্য প্রশাসনে আস্থা না থাকিলেও প্রশাসনের কিন্তু কালঘাম ছুটিতেছে। কারণ কোভিড আবহে যখন রাজ্যের মানুষ বিপন্ন,স্বজন হারাইয়া শোকার্ত, যখন প্রশাসন ও স্বাস্থ্য জগতের বহু যোদ্ধা জীবন দিয়াছেন তখন এই কমলবাবুদের নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা নিয়া অনেক খুঁতখুঁত রহিয়াছে।
তাহাদের ‘ভারত মাতা কি জয়’ হুহুঙ্কারে ভারতমাতার কী হইতেছে জানি না, তবে বঙ্গজননীর অন্তরাত্মা কাঁপিয়া কাঁপিয়া উঠিতেছে। তাহারা গ্রাম গ্রামান্তরে সভা করিতেছেন। গাঁদা মাল্যে ভূষিত ঘাড়ে-গর্দানে নেতাদের দেখিয়া জনতা পরম আহ্লাদে হর্ষধ্বনি করিতেছে। সবই ঠিক ঠাক চলিতেছে। যেন এ বঙ্গে কোনো শোক তাপ অনশন অর্ধাশন কিছুই নাই। আছে শুধু ভক্তকুলের সহর্ষ উল্লাস, বাহুবলের আস্ফালন, শক্তি প্রদর্শন,আর কুমন্তব্যের তুবড়ি-বিস্ফোরণ!
এহ বাহ্য। গোল বাধিল যখন তাহারা বঙ্গের সাহিত্য সংস্কৃতি ঐতিহ্য ইতিহাস প্রসঙ্গে তাহাদের বিদ্যাবত্তা জাহির করিতে শুরু করিলেন। আকছার উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিতে লাগিল। তাহাদের আর দোষ কি! গোবলয়ের সংস্কৃতিলালিত নেতারা কি হঠাৎ জাদুবলে বঙ্গজীবনের হদিশ পাইয়া যাইবেন? তাই কখনও সাঁওতালি জনগণকে খেপাইয়া তুলিলেন, কখনও বা গৌর-ভক্তদের! রাজ্যের শীর্ষ নেতা আবার ভূগোলজ্ঞানের পরাকাষ্ঠা দেখাইয়া ‘কাটোয়া’কে পূর্ব মেদিনীপুরের অন্তর্ভুক্ত করিয়া ফেলিলেন! তাহাতে আর বিশেষ কী! ভাবী মুখ্য প্রশাসকের পদের দাবিদার তাহার অসাধারণ জ্ঞানবত্তার কত অপরূপ পরিচয়ই তো রাখিয়াছেন! আফশোস হয়,বঙ্গের বিশ্বমানের কৌতুকশিল্পীরা আজ অনেকেই বাঁচিয়া নাই। থাকিলে কী অমূল্য সৃজনের উপকরণ পাইতেন!
সেই দিন কলকাতার রাজপথ আরেক যাত্রা পালার সাক্ষী থাকিল। জনৈক কমলবাবু অনেক জল্পনান্তে ‘রোড শো’ করিয়া ভক্তকুলের আনন্দবর্ধন করিলেন। তাহাদের হাস্যে,আধো আধো ভাষ্যে, বহুমূল্য অলঙ্কার ও সযত্ন প্রসাধনে শ্রী বৈভব সমৃদ্ধি উপচীয়মান।
বেশ কয়েক বছর ধরিয়া বঙ্গ রাজনীতিতে ‘বাহুবলী’ অনুপ্রবেশ ঘটিতেছিল। শিষ্টতা-সৌজন্য বিরহিত সেই মঞ্চে এখন উন্মত্ত লম্ফঝম্প, অর্থ-বিত্তের কুৎসিত জগঝম্প। “শুধু যাওয়া আসা স্রোতে ভাসা”--!
২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের পূর্বে এক অশীতিপর বিদগ্ধ অধ্যাপক ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় জানাইয়া ছিলেন, প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য ‘দর্শনধারী’ হওয়াটাও বাঞ্ছনীয় এবং সেই বিচারে তিনি তৎকালীনকে অগ্রাধিকারে রাখিয়াছিলেন। অর্থাৎ শুধু আম জনতা নহেন, দেশ-বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষণ দেওয়া নাগরিকের কাছেও রাজনীতিকের ‘শ্রীযুক্ত’ চেহারা সর্বাগ্রে বিবেচ্য! বটেই তো! দিনকালের পরিবর্তনে এখন আর বিশীর্ণ ধূলিধূসর চেহারার রাজনীতিক কাহারও মনঃপূত না হওয়ারই কথা। কারণ রাজনীতির সংজ্ঞা বহুদিন আগে পাল্টাইয়া গিয়াছে! কিন্তু শ্রীযুক্তদের ভীড়ে রাজনীতি ক্রমশই ‘বিশ্রী’ হইয়া উঠিতেছে – ইহা তো আমরা মর্মে মর্মে বুঝিয়েছি! বাঙ্গালীর কি এখনও মোহমুক্তি ঘটিবে না?
আপামর জনতা কি এই গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসাইয়া দিবে! এই অলীক কুনাট্য রঙ্গের নির্বাক দর্শক হইয়া থাকিবে! – এবং অবশেষে গো-সংস্কৃতির ত্রিপলাচ্ছাদনের গাঢ় তমিস্রায় বঙ্গসংস্কৃতি বিলীন হইবে!