আধুনিক গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হিসাবে স্বাধীন ভারতের যাত্রা শুরু হয়েছিল ২৬ জানুয়ারী, ১৯৫০-এ, যেদিন ভারতের সংবিধান বলবৎ হয়েছিল। সেই সংবিধান যা ‘আমরা, ভারতের জনগণ’ দ্বারা, ভারতকে একটি সার্বভৌম গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হিসাবে গড়ে তোলার এবং তার সমস্ত নাগরিকদের জন্য সার্বিক ন্যায়, স্বাধীনতা, সমতা ও সৌভ্রাতৃত্বকে সুনিশ্চিত করার দৃঢ় অঙ্গীকার সহ গৃহীত হয়েছিল। ভারতের ৭১তম প্রজাতন্ত্র দিবস, জনগণের একতা, দৃঢ়সংকল্প আর শক্তির অভূতপূর্ব প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে প্রত্যক্ষ করল, ভারতীয় সংবিধানের সেই প্রজাতান্ত্রিক চেতনাকে কীভাবে নতুন করে জ্বালিয়ে তুললেন ভারতীয় কৃষক সমাজ ও সাধারণ নাগরিক মানুষজন!
প্রসঙ্গত, সর্বনাশা কৃষি-আইন বাতিলের দাবিতে কৃষক আন্দোলনের বর্তমান পর্যায়টি শুরু হয়েছিল ২৬ নভেম্বর, যেদিন ভারতের সংবিধান গৃহীত হয়েছিল। যখন সরকার কৃষি আইনের নামে কর্পোরেট স্বার্থের ভজনায় সংবিধানের সেই চেতনা ও স্বপ্নের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল, সেই সময়ে এই ফ্যাসিস্ট কর্পোরেট আক্রমণের বিরুদ্ধে কৃষকদের দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ প্রতিরোধ, শুধু ভারতের কৃষক ও অন্যান্য কৃষিজীবী মানুষের নয়, ন্যায় ও গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামরত সমস্ত ভারতবাসীর স্বার্থ ও অধিকার রক্ষার জন্য দেশব্যাপী জনগণের একটি মঞ্চ গড়ে তুলেছে। ২৬ নভেম্বর ২০২০ থেকে ২৬ জানুয়ারী ২০২১-এর মধ্যে, মোদী সরকার, ভারত রাষ্ট্র এবং সঙ্ঘ-বিজেপি বাহিনী প্রতিবাদী কৃষকদের বিচ্ছিন্ন, বিভ্রান্ত, বিভক্ত এবং অসম্মানিত করার সম্ভবপর কোনো চেষ্টাই যখন বাকি রাখেনি, এই আন্দোলন তখন চারিদিকে আশা ও শুভেচ্ছার বিপুল তরঙ্গ জাগিয়ে এবং প্রবল উদ্দীপনার সঙ্গে ক্রমশ আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে।
কৃষক আন্দোলন, হাড় হিম করা শীতের নিষ্ঠুর কামড়ের মধ্যে সরকারের বহুমুখী আক্রমণের রণকৌশলের মোকাবিলায় যথেষ্ট ধৈর্য, বিচক্ষণতা এবং হিম্মতের পরিচয় দিয়েছে। প্রজাতন্ত্র দিবসের আগেই আন্দোলনকে শেষ করে দেওয়ার সরকারের সমস্ত অপচেষ্টাকে বানচাল করে, প্রতিবাদী কৃষকরা আন্দোলনকে নিয়ে গেছেন এক নতুন উচ্চতায়। বল প্রয়োগে আন্দোলনকে চূর্ণ করতে বা শঠতার দ্বারা কৃষকদের পর্যুদস্ত করতে ব্যর্থ হয়ে, মোদী সরকার এখন কৃষকদের বিরুদ্ধে নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলাকে প্রশ্রয় দেওয়ার এবং জাতীয় প্রতীক ও স্তম্ভগুলিকে অসম্মান করার অভিযোগ তুলে, দিল্লিতে প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠানের একটি বিকৃত ও বিভ্রান্তিকর বিবরণ দিয়ে আন্দোলনকে অবৈধ ঘোষণা করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে।
এর থেকে বড় আর নির্লজ্জ ধৃষ্টতাপূর্ণ মিথ্যাভাষণ আর হয় না। দিল্লীর কোনো কোনো অঞ্চলে প্রতিবাদী ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষ এবং লালকেল্লা চত্বরে কিছু মানুষের নিশান সাহিব তোলার দৃশ্য সম্পর্কে এখনও বিশদভাবে জানা যায়নি, কিন্তু দুটো বিষয় একেবারে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। এই দিনের ঘটনায় এই কৃষকরাই তাদের এক সাথীকে হারিয়েছেন এবং এই মৃত্যুতে তাদের মতো করেই শোকপ্রকাশ করেছেন, কোনো প্ররোচনার ফাঁদে পা দেননি। লালকেল্লার ঘটনায় এটাও নজরে রাখা উচিত, যে পতাকা ঘিরে এত প্রশ্ন, সেটি কিন্তু তেরঙ্গার কোন অসম্মান না করেই, একটি শূন্য পতাকাদণ্ড থেকে উত্তোলন করা হয়েছে। সত্যি বলতে কি, দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের শেষের বছরগুলিতে ধর্ষণ-বিরোধী এবং দুর্নীতি-বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক কালের গণ আন্দোলনগুলির মতোই, তেরঙ্গাই চলমান কৃষক আন্দোলনের সবচেয়ে নজরকাড়া নিশান হয়ে উঠেছে, সঙ্গে রয়েছে কৃষক সংগঠনগুলির লাল ও সবুজ নিশান।
প্রতিবাদী জনগণের আবেগস্পন্দিত স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ, সংগ্রামী চেতনা এবং সৃজনশীল উদ্দীপনার নিরীখে চলমান কৃষক আন্দোলন ভারতের ইতিহাসে বৃহত্তম আন্দোলনগুলির একটি হয়ে উঠেছে। বিগত দশকে, দীর্ঘদিন ধরে চলা বেশ কয়েকটি গণসংগ্রামের সাক্ষী থেকেছে দিল্লী। ধর্ষণ-বিরোধী এবং দুর্নীতি- বিরোধী সংগ্রামগুলি দিল্লীতে কংগ্রেস সরকারকে সরিয়ে ‘আপ’কে এবং কেন্দ্রে ইউপিএ সরকারকে সরিয়ে মোদী-নেতৃত্বাধীন এনডিএ-কে এনে, সরকার-পরিবর্তনে একটা বড় ভূমিকা রেখেছে। এই লড়াইগুলির ক্ষেত্রেও আন্দোলনকারী ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটেছে, অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলার ছবিও দেখা গেছে। কিন্তু সে সময়ে, এইসব লড়াই-আন্দোলনকে মিডিয়া ও সরকারের তরফে নৈরাজ্যবাদী বা দেশদ্রোহী বিশৃঙ্খলা বলে খারিজ করার চেষ্টা দেখা যায়নি।
গণতান্ত্রিক গণআন্দোলন ও গণপ্রতিবাদগুলিকে নৈরাজ্য সৃষ্টির দেশদ্রোহী কার্যকলাপ বলে অপবাদ দেওয়া ও ‘জনবিরোধী’ হিসেবে চিহ্নিত করার সংস্কৃতিটা খুব সুস্পষ্টভাবেই ২০১৪ পরবর্তী সময়কালের একটি প্রবণতা। রোহিত ভেমুলার প্রাতিষ্ঠানিক হত্যার পর জ্বলে ওঠা ছাত্র আন্দোলনকে দমন করার উদ্দেশ্যে মোদী সরকারের এই অপচেষ্টা আমরা দেখেছি। এটা গতবছর আবারও আমরা দেখলাম, জামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী এবং শাহিনবাগের প্রতিবাদী মহিলাদের শুরু করা সমান নাগরিকত্বের আন্দোলনের ক্ষেত্রে। এমন কি, শাহিনবাগের প্রতিবাদীদের হুমকি ও অপবাদ দেওয়ার চেষ্টাটা এক সংগঠিত মুসলিম-বিরোধী হিংসা প্রচারের রূপ নিয়েছিল। আর ঠিক তার পরেই প্রতিবাদীদের দানবীয় আইনে গ্রেপ্তারের মাধ্যমে নেমে এসেছিল নির্যাতন। সরকার গোটা পৃথিবীকে বিশ্বাস করাতে চায় যে শাহিনবাগ আন্দোলন ছিল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটানোর জন্য একটা ষড়যন্ত্র।
সেই একই ছককে কাজে লাগাতে দেখা গেল দিল্লীতে প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠানের পর। মানুষের উপলব্ধিতে আন্দোলনের কালিমালিপ্ত চেহারা গেঁথে দেওয়ার জন্য শুরু হয়ে গেছে এক কদর্য, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত জোটবদ্ধ মিথ্যা প্রচার। কৃষক আন্দোলন, যা উল্লেখযোগ্যভাবে আজ পর্যন্ত তার লক্ষ্যে অবিচল এবং ঐক্যবদ্ধ আছে, নিশ্চয়ই এই চ্যালেঞ্জকে অতিক্রম করতে সক্ষম হবে। কৃষক আন্দোলনের মধ্যে, সর্বনাশা কৃষি-আইন সম্পূর্ণ বাতিলের দাবি অর্জনের সমস্ত শক্তি নিহিত আছে। এই মহান সংগ্রামে, কর্পোরেট-বিরোধী ফ্যাসিস্ট-বিরোধী প্রতিরোধের সমস্ত শক্তিকে কৃষকদের পাশে অবিচলিত দৃঢ়তায় থাকতে হবে। সংগ্রামী অন্নদাতারা আরও শক্তিশালী হয়ে উঠুন, জনতার প্রতিবাদ আরও দৃপ্ত হোক!
(এম এল আপডেট, খণ্ড-২৪ সংখ্যা-৫ (২৬ জানুয়ারী - ১ ফেব্রুয়ারী)