(বিশিষ্ট লেখক ও প্রাবন্ধিক আকর প্যাটেল গত ৩০ ডিসেম্বর ১৯২০ ‘দ্য ওয়্যার’ চ্যানেলে করণ থাপারকে এক সাক্ষাৎকারে ‘হিন্দুত্ব-হিন্দুরাষ্ট্র’ সংক্রান্ত বহু কথা বলেন। এখানে তার কিছু সংক্ষিপ্তসার প্রকাশ করা হল।)
হিন্দুত্ব-হিন্দুরাষ্ট্রের প্রথমত লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হল, ভারতীয় সংখ্যালঘুদের, বিশেষ করে মুসলিমদের বিতাড়ন করা, উচ্ছেদ করা। মোদী প্রথমে ১৩ বছর যাবৎ গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ও ৭ বছর ধরে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এই মুসলিম বিরোধী ক্রোধান্ধতাকে মদত দিয়ে এসেছেন। বিজেপি বা তার পূর্বসূরী জনসঙ্ঘের কখনই অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ধ্যানধারণার বিষয়ে কোনও অবিচল অবস্থান থাকেনি, একমাত্র লাগাতার দাবি থেকেছে মুসলিমরা সমস্ত অধিকার ছাড়ুক। ওরা মসজিদ ছেড়ে দিক, মুসলিম ব্যক্তিগত আইন থেকে বিরত থাকুক, কাশ্মীরের ওপর স্বায়ত্ততার অধিকার চলবে না, হিন্দু মেয়েদের বিয়ে করা চলবে না, গোমাংস খাওয়া বন্ধ করতে হবে, ইত্যাদি ইত্যাদি।
হিন্দুরাষ্ট্রের কাছে অ-হিন্দু সংখ্যালঘুরা কেবল উচ্ছেদের সম্প্রদায়। তা যে সংখ্যাগুরু হিন্দুদের সম্প্রদায় হিসাবে খুব ভালো কিছু করার তাও নয়, সেদিকে তাকানোরই নয়, শুধু একটাই লক্ষ্য, অ-হিন্দুদের কি করে সর্বনাশ করা যায়, তাড়ানো যায়, অথর্ব করে রাখা যায়, সেসবই। ২০২০ সাল পর্যন্ত তথ্য দেখুন।
দেশে মুসলিম জনসংখ্যা যেখানে মোট ২০ কোটির বেশি সে তুলনায় ২৮টি রাজ্যে কোনো মুসলিম মুখ্যমন্ত্রী নেই, ১৫টি রাজ্যে কোনও মুসলিম মন্ত্রী নেই, ১০টি রাজ্যে মাত্র একজন করে মন্ত্রী আছেন। তাও সাধারণত মন্ত্রী করা হয়েছে কেবল সংখ্যালঘু বিষয়ক বিভাগে।
বিজেপি খুব মুসলিম তোষণের অবান্তর অভিযোগ তোলে, এটা প্রহসন ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ মুসলিমদের মোট জনসংখ্যা অনুপাতে জনজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের প্রতিনিধিত্ব পড়ে রয়েছে অনেক তলায়। যেমন, লোকসভায় মুসলিম প্রতিনিধির আসন ন্যূনতম যেখানে থাকা উচিত, সেখানে তাদের জনপ্রতিনিধির সংখ্যা মাত্র ২৭। কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারী কর্মচারি মিলিয়ে মুসলিমদের অস্তিত্ব মাত্র ৪.৯ শতাংশ, আধা সামরিক বাহিনীতে অংশ ৪.৬ শতাংশ, আইএএস-আইপিএস ৩.২ শতাংশ, আর সেনাবাহিনীতে সংখ্যাল্পতা সবচেয়ে পক্ষপাতদুষ্ট, ১ শতাংশেরও নীচে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় এবং রাষ্ট্রীয় নীতির অনুসরণে — উভয় দিক থেকে মুসলিম উচ্ছেদ অভিযান হাসিল করা হয়। ‘র’, ‘আর এ ডব্লিউ’, ‘রিসার্চ এ্যান্ড অ্যানালিটিক্যাল উইংস্’ — ভারতের সর্বোচ্চ স্তরের গোয়েন্দা গবেষণাগারে কোনোকালেই কোনও মুসলিম নিয়োগ পাননি, এখন তো আরোই থাকার কথা নয়, নেই।
মোদীর আমলে গুজরাটে লাগু হয়েছিল ‘গুজরাট উপদ্রুত এলাকা আইন,’ আজও বলবৎ রয়েছে। ঐ আইনের মোদ্দা বিষয় হল, গুজরাটের যেসব এলাকা সরকারের নির্দেশে ‘উপদ্রুত’ তালিকাভুক্ত, সেখানে মুসলিমরা জমি-বাড়ি বেচা-কেনা-ভাড়া দেওয়া-নেওয়া যেখানে বা যা ইচ্ছে তাইই করতে পারে না। সবকিছুই করতে হয় কঠোর পুলিশী-প্রশাসনিক ফরমান অনুসারে। নির্মম বাস্তবতা হল, গুজরাটে মুসলিমদের “ঘেটো” (ঘিঞ্জী মহল্লা) জীবনে থাকতে হয়। সবসময় তাড়িয়ে চলে ন্যক্কারজনক নজরদারী। ভোগ করতে হয় ঘৃণা-বিদ্বেষের জ্বলন।
দেশের বিচারব্যবস্থাও মুসলিম বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গী থেকে মুক্ত নয়। সর্বস্তরেই বিচারালয়ে এর বহুরকম ভুরি ভুরি তথ্যপ্রমাণ মেলে। সুপ্রীম কোর্টেও তো একই আচরণের পরিচয় পাওয়া যায়। রায়দানের ক্ষেত্রে ‘বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা অন্যায় অপরাধ হয়েছে’ ভর্ৎসনা করেও সংশ্লিষ্ট জমির ওপর সেই মসজিদ ধ্বংসকারীদের গাজোয়ারী অধিকার ফলানোর ওপর শীলমোহর দিয়ে দেওয়া হল! কাশ্মীরে সংবিধানের ৩৭০ ধারা মোতাবেক বিশেষ মর্যাদা ভিত্তিক স্বাধিকার সংক্রান্ত মামলার কিংবা সিএএ বাতিলের আপীল সংক্রান্ত অত্যন্ত জরুরি সংবেদনশীল মামলার শুনানির দিন নেপথ্য রহস্যপূর্ণ অজ্ঞাত কারণে মাসের পর মাস গড়ায়, শুনানি পরিত্যক্ত হয়ে থাকে।
এইসব হল দৃশ্যমান খন্ডপ্রস্তর মাত্র। মুসলিম নির্যাতন, নিপীড়ন, বিতাড়ন, উচ্ছেদ ও অধীনস্তকরণের প্রণালী লক্ষ্যবিশেষ।