৯ জানুয়ারী, ২০২১-এ বিজেপির নেতৃত্বে “এক মুঠো ভাত” অভিযান শুরু করেছে, যেখানে প্রেসিডেন্ট শ্রী নাড্ডা চাষি পরিবারগুলির কাছে এক মুঠো ভাতের ভিক্ষা চাইছে। এই প্রবল ভণ্ডামিতে আমরা স্তম্ভিত। খবরের কাগজ বলছে এই চাল থেকে অভুক্ত মানুষের জন্য গণ-আহারের ব্যবস্থা হবে।
শ্রী নাড্ডা সেই রাজনৈতিক দলের প্রেসিডেন্ট যারা কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতায় এবং এই মুহূর্তে ৫১২.৯৪ লাখ মেট্রিক টন খাদ্যশস্যের ভাণ্ডার নিয়ে বসে আছে সেই সরকার। খারিফ ফসল এখনও সংগ্রহ চলছে এবং আগামী কিছু দিনে এই পরিমাণ আরও বাড়বে। তার বা তার দলের লোকের, বাংলা বা বলা যায় পুরো দেশের লোককে খাওয়ানোর জন্য কি মুঠোভর্তি চাল চাওয়ার দরকার আছে? বিনামূল্যে রেশন দেওয়ার যে কাজ ‘প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ অন্ন যোজনা’-র আওতায় লকডাউনের মধ্যে শুরু হয়েছিল এবং নভেম্বর ২০২০-তে যা হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া হয়, দরকার তো ছিল সে যোজনার পরিধিকে আরও প্রসারিত করা। তার দল তো স্বচ্ছন্দে তা করতে পারত। এই যোজনার ভেতর, রাষ্ট্রীয় খাদ্য সুরক্ষা আইনের অন্তর্ভুক্ত এরাজ্যের সব কার্ডহোল্ডার, অর্থাৎ ৬০১৮৯৩৮৪ জন, বা পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যার ৬৭ শতাংশ, প্রতি মাসে পরিবার পিছু ৫ কেজি খাদ্যশস্য ও পরবর্তীতে ১ কেজি করে ডাল পাচ্ছিল।
লোকের দুর্দশা লকডাউন ওঠার পরেও কমেনি এবং অর্থব্যবস্থা আরও খারাপ দিকে যাচ্ছে, তাই কেন্দ্রীয় সরকারের বিনামূল্যে রেশনের পরিষেবা হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়ার কারণ বোঝা যাচ্ছে না। ‘হাঙ্গার ওয়াচ স্টাডি’ যার অন্তরিম ফল বেরিয়েছে আন্তর্জাতিক গণ অধিকার দিবসের প্রাক্কালে, ৯ ডিসেম্বর ২০২০-তে। তাতে দেখা যাচ্ছে সারা দেশের মানুষ খাবার না পেয়ে ভোগান্তিতে আছেন। পশ্চিমবঙ্গে ‘রাইট টু ফুড অ্যান্ড ওয়ার্ক ক্যাম্পেইন’-এর চালানো সমীক্ষা, যা ২০টি জেলা থেকে ২৯০৬টি পরিবারের মধ্যে অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে করা হয়েছিল, তাতে দেখা যায় বিনামূল্যে রেশন দেওয়া বন্ধ হওয়ার আগেও অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। লকডাউনের আগে খেতে না পাওয়া পরিবারের তুলনায় এই পর্বে খেতে না পাওয়া পরিবারের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। সমীক্ষার সময় দেখা যায় যে বিগত ৩০ দিনে ১৮.৭৪ শতাংশ পরিবার না খেয়েই ঘুমাতে বাধ্য হয়েছে এবং ৪৫ শতাংশ পরিবার খাবারের জন্য ধার নিতে বাধ্য হয়েছিল। ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ মানুষ জানিয়েছেন তারা খাবারে ডাল ও শাকসবজির পরিমাণ কমাতে বাধ্য হয়েছেন, ৮০.৩ শতাংশ মানুষ খাবারে মাছ, ডিম ও মাংসের পরিমাণ কমাতে বাধ্য হয়েছেন। ২৬ শতাংশ মানুষের মতে আগামী ৬ মাসে অবস্থা আরও বেশি খারাপ হতে চলেছে।
তাই শ্রী নাড্ডা একমুঠো চাল চেয়ে ভুখা লোককে খাওয়ানোর নাটক বন্ধ করলেই ভালো হয়। তার যদি সত্যিই ভোট চাওয়ার থেকে ক্ষুধা নিবারণের ইচ্ছা বেশি হয় তাহলে তিনি তাঁর প্রধানমন্ত্রীকে বলে যে পাহাড়প্রমাণ খাদ্যশস্য গুদামে জমা আছে তা দিয়ে ভুখা মানুষকে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করুন।
বিজেপির এই অভিযানের আরও একটি কারণ হতে পারে বিজেপি নেতারা কৃষকদের ঘরে ঘরে গিয়ে নতুন কৃষি আইনের প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে চান। এ আরও একটি ধাপ্পা – যে কৃষকরা তাদের সরকারের দোরগোড়ায় বসে রয়েছেন তাঁদের সাথেই কি প্রথমে কথা বলা যায় না? যে সরকার বা রাজনৈতিক দল সত্যিই কৃষকদের ভালো চায় এবং তাদের সাথে আলোচনায় যেতে চায়, তারা দিল্লীর ঠাণ্ডায় কম্পমান কৃষকদের সাথেই প্রথমে আলাপ-আলোচনা করবে। ধানের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের দিকে দৃকপাত করলেও ভালো হয়, কারণ পশ্চিমবঙ্গের বেশিরভাগ চাষির এই দামে কোনো লাভ থাকে না এবং তারা কেন্দ্রীয় সরকারের ধার্য করা হাস্যকর দামের চেয়ে খোলা বাজারেই শস্য বেচতে বাধ্য হন।
ধাপ্পাবাজির এই সময়ে পশিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন তৃণমূল সরকারের ‘দুয়ারে সরকার’ অভিযানও আমাদের সামনে আছে। ভোটের ঠিক আগে এই সরকার আমাদের দুয়ারে এসে পড়েছে, যেখানে বিগত দুবার ভোটে জিতে এসে তারা হয় আমাদের কথা উপেক্ষা করে গেছে নয় জণগণের পয়সা চুরি করেছে। শুধু তাই নয়, আইনিভাবে প্রতিকারের সব রাস্তাকেই এই রাজ্য সরকার সমানে লঘু করেছে – খাদ্য সুরক্ষা আইন প্রণীত হওয়ার ৭ বছর পরেও খাদ্য নিগম তৈরি হয়নি; মনরেগার আওতায় কাজের সুরক্ষা সুনিশ্চিত করার পর্ষদটি শুধু নামেই আছে; জেলাস্তরে জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইনের আওতায় অভিযোগ নিরসনের জন্য যে অধিকারী থাকার কথা তার কেউ নামই শোনেনি; অভিযোগ শোনা ও তার সাপেক্ষে কাজ করা ও উত্তর দেওয়ার জন্য বিভিন্ন আইন অনুসারে নির্দিষ্ট সময় নির্ধারিত থাকা সত্ত্বেও অপ্রয়োজনীয় দেরী ও বিভ্রান্তি ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায়না সরকারের দরজায় গেলে।
পরবর্তী স্তরের রাজনৈতিক দলগুলির কাছে আমাদের আবেদন – এই ধাপ্পাবাজি বন্ধ হোক; তার পরিবর্তে লোকের সমস্যার কথা শোনা হোক এবং তার সাপেক্ষে কাঠামোগত এবং দীর্ঘস্থায়ী সমাধান আনা হোক। শুরুয়াতে, আরও অন্তত ছয় মাসের জন্য ‘প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ অন্ন যোজনা’ আবার শুরু করা হোক।
(রাইট টু ফুড অ্যান্ড ওয়ার্ক ক্যাম্পেইন পশ্চিমবঙ্গ কর্তৃক প্রচারিত বিবৃতি)