প্রতিবেদন
আগামী নির্বাচনের এজেন্ডা গড়ে উঠুক
aga

যদিও এ রাজ্যের নির্বাচনের এখনও চার-পাঁচ মাস দেরি, তবুও দেখা যাচ্ছে, গোদি মিডিয়া এই সময় থেকেই একটা হিড়িক তুলে দিয়েছে। এর পেছনে সেনশনাল খবর পরিবেশন করে টিআরপি তোলার বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য তো আছেই, কিন্তু আরও একটি বড় উদ্দেশ্য কাজ করছে বলে বেশ মালুম হচ্ছে। তা হল, পালা পরিবর্তনের একটা হুজুক তুলে দেওয়া, যার পেছনে তাদেরও কিছু স্বার্থসিদ্ধি করার ব্যাপার আছে। দেশজুড়ে যখন গোদি মিডিয়াকে হাতিয়ার করে বিজেপি’র রথ বেলাগাম ছুটতে চাইছে তখন এরাজ্যেও তাকে ছোটাতে এই ধরনের কারসাজি বেশ ফল দেবে বলে তাদের বিশ্বাস।

এই মুহূর্তে নির্দ্বিধায় বলা যায়, পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে ঠিক কী হতে চলেছে, সে কথা বলার সময় এখনও আসেনি। কারণ, ঘটনাবলীকে মিডিয়া যেভাবে দেখাতে চাইছে সেভাবে সব কিছু এগোচ্ছে না।

প্রথমেই ধরা যাক দলবদলের কথা। তৃণমূলের এক ঝাঁক গুরুত্বপূর্ণ নেতা-কর্মীকে দলে এনে বিজেপি যদি মনে করে থাকে যে তাদের পশ্চিমবঙ্গে জয় প্রায় সারা হয়ে গিয়েছে, তাহলে তারা মূর্খের স্বর্গে বাস করছে। কোনও রাজ্যে, এমনকি এখানেও, কতিপয় নেতার চালচলনের ওপর জনতার রায় নির্ভর করে না। কারণ, দেখা গেছে, সংসদীয় গণতন্ত্রের নানা স্তরের বিবিধ নির্বাচনে জনতা বেশ বুঝেশুনেই ভোট দেন। হতে পারে, কখনও তারা উগ্র রক্ষণশীল শক্তিকেও নির্বাচিত করেন। কিন্তু তার কারণ হিসেবে দেখা যাবে, বিপক্ষের যে দল ক্ষমতায় ছিল বা আসতে চায়, তাদের কার্যকলাপে এমন সব জনবিরোধী ও ক্ষতিকর প্রয়াস রয়েছে বা ছিল, তা জনগণ প্রত্যাখ্যান করতে চাইছেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ভার্সাই চুক্তিতে নিঃস্ব জার্মানির ছিন্নমূল অবস্থা দেখেই না জার্মানির জনগণ হিটলারের দলকে নির্বাচনে জিতিয়েছিলেন। সেভাবেই ফ্যাসিবাদী শক্তি জনতার ক্রোধ ও হতাশাকে হাতিয়ার করে নিতে পারে বা নেয়। আমাদের দেশেও অনুরূপ ঘটনা গত কয়েক বছরে ঘটেছে। কিন্তু তার জন্য ইউপিএ সরকারের আমলে জল-জঙ্গল-জমি দখল করার কর্পোরেট আগ্রাসন ও চরমতম দুর্নীতি কম দায়ী ছিল না।

এই দ্বান্দ্বিক বাস্তবতার ওপর দাঁড়িয়েই আমাদের এই সময়ের কঠিন পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করতে হবে। একথা অনস্বীকার্য যে, গত দশ বছরে এ রাজ্যে স্বাধীন মত প্রকাশ ও দলের কর্মসূচী পালন করতে গিয়ে বিরোধীদের শাসকের বহু আক্রমণের মুখোমুখি হতে হয়েছে। এমনকি তার আগের জমানাতে তো সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের মতো ঘটনাও ঘটেছে যা কৃষকদের ওপর শাসক পক্ষের গুলি চালানো ও গণহত্যার স্মারক হয়ে রয়েছে। এই সমস্ত ঘটনার স্মৃতি এলাকাবাসী ও রাজ্যের মানুষের মধ্যে প্রবলভাবে রয়েছে। ফলত, এই রাজ্যের পরিপ্রেক্ষিতে (বামফ্রন্ট ও তৃণমূলের শাসন প্রত্যক্ষ করার পর) বিজেপিকে খুব নতুন ও সজীব কোনও শক্তি হিসেবে কারও কারও মনে হতে পারে, যাকে একবার সুযোগ দেওয়ার কথা দুর্বল চিত্তের মানুষের হৃদয়ে সুড়সুড়িও দিচ্ছে। আর সেই সম্ভাবনা থেকেই বিজেপি কোমর বেঁধে দোর্দণ্ডপ্রতাপে সময়ের বহু আগে থেকেই অর্থ ও ক্ষমতার বাহুবল নিয়ে পরিকল্পিতভাবে নির্বাচনের ময়দানে নেমে পড়েছে। তারা একটা সোরগোল তোলার চেষ্টা করছে যে তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ তৃণমূল তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ছে, অতএব, বিজেপির ক্ষমতায় আরোহন এখন সময়ের অপেক্ষা মাত্র। আর এই তাণ্ডবে তাদের পূর্ণ মদত দিচ্ছে গোদি মিডিয়া।

কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি বইছে সম্পূর্ণ অন্য খাতে। আরএসএস-বিজেপি’র এজেন্ডার মূল প্রতিপাদ্যই হল, গুটি কয়েক কর্পোরেট সহায়তায় গোটা মুসলমান সমাজকে এক ঐতিহাসিক-কাল্পনিক প্রতিপক্ষ বানিয়ে তথাকথিত হিন্দু সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করে তাদের ভোট নিয়ে ক্ষমতায় আসা। এতে তারা বেশ কিছু রাজ্যে সফলও হয়েছে। আর সেই কারণেই তাদের নির্বাচনী প্রচারের ইস্যু হয় – রামমন্দির, সিএএ, এনআরসি, ইস্লামোফোবিয়া, পাকিস্তান, কাশ্মীর, অনুপ্রবেশ, দেশদ্রোহিতা ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে এই পর্যন্ত যা দেখা যাচ্ছে, শত হাইপ ও দলবদল সত্ত্বেও হিন্দুত্ববাদী এই এজেন্ডাগুলোকে তারা এখনও সামনে এনে ফেলতে পারেনি। এমনকি তারা সিএএ চালু করা নিয়েও দ্বিধান্বিত, যে কারণে আইন পাশ হলেও তার নিয়মাবলী দেড় বছরেও করে উঠতে পারেনি।

আশার কথা, এই এজেন্ডা নির্মাণের পৃষ্ঠভূমিতেই বিজেপি আপাতত হেরে বসে আছে। তারা বরং দুর্নীতি, কাটমানি, বেকারত্ব – এইসব নিয়েই সোচ্চার। এরা যত এইসব এজেন্ডা নিয়ে বাধ্যত ব্যস্ত হয়ে পড়বে, ততই তাদের মাটির তলার জমি নরম হবে, সে যতই বড় বড় নেতাদের তারা অর্থ ও ভয় দেখিয়ে ভাঙিয়ে নিয়ে যাক না কেন। কারণ, এই ধরনের এজেন্ডায় নিবদ্ধ হলে তাদের যে ইউএসপি – হিন্দুত্ববাদী প্রচার – তা দুর্বল হবে। আর সে প্রচার দুর্বল হওয়া মানে তাদের আর পাঁচটা পার্টির মতোই দেখতে লাগবে। আলাদা করে নিজ বৈশিষ্ট্যে আলোকিত হতে সমস্যা হবে। অনেকে ইতিমধ্যে বলতে শুরু করেছেন, তৃণমূলের নেতা-কর্মী ভাঙিয়ে বিজেপি আরেকটা তৃণমূল (টিম বি) তৈরি করছে!

বামপন্থী ও গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন মানুষদের বাস্তবতার এই জায়গা থেকেই শুরু করতে হবে যে, নির্বাচন আসতে অনেকটা দেরি থাকলেও বিজেপি অন্তত প্রথম রাউন্ডে তাদের নিজস্ব এজেন্ডা থেকে বিচ্যুত হয়েছে। তারা আপাতত খেলছে বিরোধী দলের এজেন্ডা বা টার্মস’এ। এই পরিস্থিতি আরও সুযোগ করে দিচ্ছে এমন এক গণএজেন্ডা নির্মাণের যার তোড়ে এই ফ্যাসিবাদী শক্তি বিভাজনের রাজনীতির সওয়াল করে ক্ষমতাধারী হওয়ার কোনও সুযোগই পাবে না। তাই যদু-মধু জোটের থেকেও এই মুহূর্তে দরকার মানুষের জীবন-জীবিকার আধুনিক রূপরেখার ওপর ভিত্তি করে এক জনমুখি গণএজেন্ডা তৈরি করা যা হিন্দু সমাজের মধ্যকার বৈষম্যকেও স্বীকার করে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সমস্ত শ্রমজীবী মানুষের বেঁচেবর্তে থাকার সম্মুখে যে অবরোধ, তার বিপক্ষে এক প্রতিরোধের বর্ম গড়ে তুলতে পারে। এই প্রয়াসই হতে পারে উগ্র ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের বিপক্ষে এক মোক্ষম জবাব ও লড়াই। অন্তত একটি সবল প্রথম ধাপ যা পরের লড়াইগুলিতে পুষ্টি ও সক্ষমতা জোগাবে। বিহারের সাম্প্রতিক নির্বাচন থেকে এ বিষয়ে অনেক কিছু শেখার আছে।

- অনিন্দ্য ভট্টাচার্য 

খণ্ড-28
সংখ্যা-1