সৌরভ গাঙ্গুলি, ভারতের প্রাক্তন ক্রিকেট অধিনায়ক, বাঙালির নয়নের মনি, অতর্কিতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন, তাঁর জীবন হতে পারত সংশয়াচ্ছন্ন, কিন্তু সেদিকে গড়ায়নি। গৃহীত ব্যবস্থাক্রমে তিনি সংকটমুক্ত হয়েছেন। বিদ্যুৎগতিতে চলে গিয়েছিলেন কলকাতার সবচেয়ে অভিজাত এক সর্বাধুনিক হাসপাতালে। চিকিৎসাক্ষেত্রের ভাষায় তিনি পৌঁছে যেতে পেরেছিলেন ‘গোল্ডেন আওয়ার’-এর মধ্যে, অর্থাৎ যে সময়ের মধ্যে চিকিৎসা পেলে বিপদ কেটে যাওয়ার সুযোগ বেশি।
এই দেশে, এই রাজ্যে, এহেন ‘সোনালি সময়ে’র মধ্যে চিকিৎসা পরিষেবা পাওয়া যায় মূলত পুরানো-নতুন নামী-দামী সব বেসরকারী হাসপাতালে। তবে ব্যবস্থাটা ‘ফেলো কড়ি মাখো তেল’ পলিসির। সরকারী বড় বড় হাসপাতালেও কিছু অনুরূপ পরিকাঠামো রয়েছে, কিন্তু গরিব, নিম্ন ও মধ্যবিত্ত রোগীর ভীড় লেগে থাকে প্রচণ্ড, লাইন পেতে অতীষ্ট হয় জীবন। ব্যবধানটা ভীষণ মাত্রায়। ফলে পুঞ্জীভূত হয়েই চলছিল দাবিটা। রাজ্য সরকারকে কিছু একটা করতেই হোত স্বাস্থ্যবিমা ধরনের। অনেক দেরীতে হলেও তা প্রথমে শুরু হয়েছিল ২০১৬ সালে। প্রকল্পের নাম ‘স্বাস্থ্য সাথী’। কিন্তু ২০২০’র অতিমারী পরিস্থিতিতে চিকিৎসা পরিষেবা পেতে সাধারণ মানুষের অশেষ দূর্ভোগ পোহানো, বিশেষত বেসরকারী হাসপাতালগুলোর অর্থচোষা ব্যবস্থা; সরকারী বড় বড় হাসপাতালগুলোর বা জেলা ‘সুপার স্পেশ্যালিটি’ হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত পরিকাঠামোর অভাব উন্মোচিত হয়েছে প্রকটভাবেই। সব মিলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা পরিচিত করালো সার্বিক সংকটকে, যার জন্য মূল দায়ি বেসরকারী হাসপাতাল ব্যবস্থা। তারা অসহায় মানুষকে আগেও অর্থের চাপ দিয়ে শুষে ছিবড়ে করে ছাড়তো, দরজা দেখিয়ে দিত, এমনকি শবদেহ আটকে রেখে বিল আাদায়ের বিভৎসতা দেখিয়েছে। অতিমারী পরিস্থিতিতেও এসব শয়তানি করেছে। এই দুরবস্থাকে কোনো-না-কোনো মাত্রায় নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। আর জনসাধারণকে একটু স্বস্তির পরিষেবা দেওয়ার ব্যবস্থা করা ভীষণ প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে। তাই ‘স্বাস্থ্য সাথী’ প্রকল্প উপভোক্তাবর্গের ব্যাপক সম্প্রসারণ করতেই হোত। রাজ্য সরকার সেটা আর দেরী না করে সম্প্রসারিত করে প্রাথমিকভাবে পরিচয় দিয়েছে সুমতির। সামনে বিধানসভা নির্বাচন। ইতিমধ্যে মোদীর কেন্দ্র নামিয়েছে ‘আয়ুস্মান ভারত’! বিজেপি তাই নিয়ে খুব ঢাকঢোল পেটাচ্ছে। রাজ্য সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আয়ুস্মানের বোঝা না টানার। যুক্তি হল, আর্থিক দায় কেন্দ্র-রাজ্য উভয়ের হলেও প্রকল্পের নাম কিনছে কেন্দ্রীয় সরকার। তাই মমতা সরকার চলতে চায় পাঁচ লক্ষ টাকা মূল্যের এবং মহিলাদের নামে চালু প্রকল্প ‘স্বাস্থ্য সাথী’ নিয়ে। এই কার্ডের বিনিময়ে রাজ্যের ভেতরে ও বাইরে শয়ে শয়ে বেসরকারী হাসপাতাল/নার্সিং হোমে চিকিৎসা মিলবে, কেউ ফেরাতে পারে না, নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এমনই। নয় কোটি মানুষ ধর্তব্য-এর আওতায়। এপর্যন্ত আবেদন জমার সংখ্যা সত্তর লক্ষাভিমুখী, আবেদন মঞ্জুরের ভাগ আশি শতাংশ, হাতে কার্ড পেয়েছেন কুড়ি শতাংশ, বাকিদের দেওয়া হচ্ছে ‘ইউনিক’ রেজিস্ট্রেশান নাম্বার ‘ইউআরএন’। একে জনপ্রিয় করতে নাম লিখিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী নিজেও।
কিন্তু শুরুতেই প্রশ্ন উঠছে বেসরকারী হাসপাতালগুলোতে এর গ্রাহ্যতা নিয়ে। কমলি কিস্কু, রূপালি মাহালি, মর্জিনা বিবি, রীতা সর্দার, নমিতা দাসরা এর উপযোগিতা কার্যত কি পাবেন? কিভাবে নিশ্চিত হবেন? এই প্রশ্নগুলোর জরুরী প্রত্যুত্তর চাই। কারণ ইতিমধ্যেই ঘটতে শুরু করেছে নিদারুণ সব ঘটনা। ভাঙরের গরিব শাকিলা বিবি গুরুতর হৃদরোগের জরুরী চিকিৎসার জন্য ‘স্বাস্থ্য সাথী’ কার্ড নিয়ে হন্যে হয়ে ঘুরেছেন। তাঁকে এক নামী বেসরকারী হাসপাতাল ফিরিয়ে দেয় কার্ডে চিকিৎসা মিলবে না বলে। তারপর দুটো বড় সরকারী হাসপাতালেও মেলেনি প্রত্যাশিত পরিষেবা। পুলিশ-প্রশাসনে অভিযোগ করতে হয়েছে, সংবাদ জগতে খবর হয়েছে, তারপর স্বাস্থ্যদপ্তরের হস্তক্ষেপে তিনি ভর্তি হতে পেরেছেন এক বেসরকারী হাসপাতালে। অন্য একটি কেস। মুর্শিদাবাদের নওদায় বছর বাইশের অন্তঃসত্ত্বা জুলেখা বিবির পরিবার কার্ড নিয়ে পরিষবা চাইতে গিয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়। তারপরে বাড়ির রোগিকে বাঁচাতে বাড়ির গরু বিক্রি করতে বাধ্য হয়। পুলিশ-প্রশাসন করতে গেলে ঘনিয়ে আসত রোগীর ঘোর বিপদ।
এহেন নির্দয় দুঃসাহস বেসরকারী চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান দেখাতে পারছে কি করে? সংগঠিত প্রতিবন্ধকতায় নেমেছে তাদের প্রতিনিধি সংস্থা এএইচআই (এসোসিয়েশন অব হসপিটালস্ অব ইস্টার্ণ ইন্ডিয়া)। সংস্থার বক্তব্য হল, কেস প্রতি বিল চার্জ ও বিমাবাবদ বরাদ্দের পরিমাণ নিয়ে রয়েছে বিরোধ। সংস্থার বক্তব্যে আছে রকমফের ‘বিকল্প’ ও দাবি। যদি পাঁচ শতাংশের বেশি কেস করতে না হয় তাহলে বাকি পঁচানব্বই শতাংশের হসপিটাল রেট চার্ট অনুযায়ী বিল আদায়ের টাকা থেকে কার্ডধারীদের ক্রস সাবসিডির টাকা ম্যানেজ করা যাবে। কিন্তু কার্ডধারীদের ভীড় যদি বাড়তেই থাকে তবে সেটা বহন করা সম্ভব নয়। সেটা সম্ভব হতে পারে সরকার যদি কেস প্রতি যা বরাদ্দ করেছে তার গড়ে ছয় থেকে আট গুণ অর্থবরাদ্দ বাড়ায়। এ বিরোধের নিস্পত্তি করতে তৃতীয় কোনো কমিটি গঠন হোক। যাই হোক, নৃশংস স্বাস্থ্য বাজারের চাপ এবং সরকারের বরাদ্দ-সঙ্গতির মধ্যেকার চাপে গোড়াতেই পিষ্ট হতে শুরু করেছে প্রকল্পটি। বাজারি অন্যায় অযৌক্তিক চাপের কাছে নতি স্বীকার না করে অবিলম্বে এর যুদ্ধকালীন সমাধান দিতে হবে সরকারকেই। এক্ষেত্রে আইনি সংস্থান ও রুলস্ যা যা আছে কার্যকরি করা হোক, সেসব বিষয়ে তলিয়ে খতিয়ে দেখা এবং নির্দেশাবলীতে আবশ্যিক আরও পরিবর্তন প্রয়োজন হলে পদক্ষেপ করা হোক। সাফ কথা, নিছক ভোটকুড়ানোর অছিলায় ‘দুয়ারে সরকার’ কসরত প্রদর্শন করলে চলবে না। কাজের কাজগুলো করতে হবে। আমজনতাকেও নামতে হবে কার্ডের প্রাপ্য আদায়ে, গড়ে তুলতে হবে সংগঠিত চাপ।