সময় থাকতে আমরা অনেক কিছুর মর্ম বুঝি না। পরে যখন অনেক মূল্য দিয়ে বুঝি তখন অনেক দেরি হয়ে যায়। আমার মা অনেক ছড়া জানতেন। বিভিন্ন ঘটনায় অবলীলায় প্রাসঙ্গিক ছড়া বলতেন, গ্রাম্যকথার ডালি ঢেলে দিতেন। তখন কি আর ভেবেছিলাম এসব উত্তরকালে আমার/আমাদের কাজে লাগতে পারে! মায়ের অবর্তমানে সেইসব কথা এখন খুব মনে হয়। মায়ের মুখে একবার শুনেছিলাম:
অভদ্রা বর্ষাকাল
হরিণ চাটে বাঘের গাল
শোনরে হরিণ তোরে কই
কালগুণে আমি সবই সই।
আজ রবীন্দ্রনাথের মতো একজন দাড়ি রাখছেন, তাঁর সাকরেদরা বিশ্বভারতীকে রবীন্দ্রনাথের জন্মস্থান বলছেন, রবীন্দ্রনাথের মেজদাকে বড়দা বানাচ্ছেন, মেজবৌদির নাম ভুল বলছেন – এরকম আরও কত কি! ভোট বড় বালাই। পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন আসন্ন। বাংলা বিজয় তাঁদের স্বপ্নের তুঙ্গসীমায় এখন বিরাজ করছে। ইতিমধ্যেই তাঁরা আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে ১৬০’র অধিক আসন প্রায় পেয়ে গিয়েছেন! আরও ৪০টি তো পেতেই হবে, কেননা শাহি মশলার প্রচার তো কার্যীভূত করতে হবে।
এখন তাঁরা আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছেন বাঙালি আদব কায়দা নকল করতে, গায়ে চাদর জড়াতে। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে গুজরাটের কত নিবিড় সম্পর্ক ছিল তা প্রমাণে প্রাণপাত করে চলেছেন এঁরা। আমাদের দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক স্বপ্ন ‘আত্মনির্ভর ভারত’ নাকি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দৃষ্টিভঙ্গির-ই অনুসারী! বিস্ময়ের সীমানাটা আদতে পলকা নয়, তবে এইসব কথাবার্তা শুনে তা অচিরেই হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ছে। কিছুতেই তাকে ঠেকিয়ে রাখা যাচ্ছে না! তবু তিনি থামছেন না। পরম বিজ্ঞের মতো তিনি বলেই চলেছেন যে রবীন্দ্রনাথের মধ্যে নাকি ‘বেদ থেকে বিবেকানন্দ’ সবই পাওয়া যায়! অর্থাৎ একের ভিতর সব! অন্যদিকে বিশ্বভারতীর উপাচার্য তো খোদ হিন্দুত্ববাদীদের গুড বুকে অবস্থান করছেন। তিন তো আবার বলেই দিয়েছেন যে রবীন্দ্রনাথ তো এখানে ‘বহিরাগত’! (সুত্রঃ ফ্রন্টিয়ার, ২ জানুয়ারী ২০২১) মোদীজি তাঁর বাংলা-বিজয়ের রাজনীতিক প্রচারে রবীন্দ্রভক্তির প্রাচুর্যের নমুনা রাখলেও খোদ উপাচার্যের তরফে রবীন্দ্রনাথকে ‘বহিরাগত’ বলে আখ্যা দেওয়ার প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়েছেন!
বাস্তবিক হিন্দুভারতের স্বপ্নদর্শী আরএসএস-এর সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিস্ত প্রকল্পের মানস প্রতিমা বিজেপি’র এভাবে আসন্ন ‘বর্ষাকালে’ অর্থাৎ নির্বাচনের প্রাক্কালে রবীন্দ্র শরণ নিয়ে বাঙালির মন জয়ের লক্ষ্যে বাঘের এভাবে হরিণের ‘গাল’ চেটে দেওয়ার সময়ও সে তার ক্ষুধার্ত লাল চোখের হিংস্রতা কিন্তু গোপন থাকতে পারছে না। সাধারণ্যে তা প্রকাশ পেয়েই যাচ্ছে। সে যখন বিড়বিড় করে বলছে: ‘শোনরে হরিণ তোরে কই/কালগুণে আমি সবই সই’ – তখন তার দাঁত কিড়মিড় করার শব্দ তো আদতে অশ্রুত থাকছে না!
বিজেপি’র নেতা-নেত্রীরা এখন তো আকছার বাঙালি কবিদের শরণ নিচ্ছেন, রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও বঙ্কিমচন্দ্র, অরবিন্দ ঘোষেরও নাম নিচ্ছেন। তবে নাম নিচ্ছেন না বিদ্যাসাগরের, মধুসূদন-নজরুল-সুকান্ত-মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়দের। কারণ তাতে তাঁদের সমস্যা কমবে না বই বাড়বে। এঁদের একসময়ের ডাকসাইটে নেতা (যিনি আবার এখন নেতৃত্বলাভের লক্ষ্যে বিজেপির আনাচে-কানাচে ঘুরঘুর করছেন) তো রবীন্দ্রনাথ, সুকান্ত ভট্টাচার্য এবং নজরুল ইসলামের সংস্কৃতিকে ‘রসুন সংস্কৃতি’ বলে আখ্যা দিয়ে বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি তাঁদের প্রকৃত দৃষ্টিভঙ্গির স্বরূপ উন্মোচন করেছিলেন। এখন আসন্ন নির্বাচনের মুখে এসে বিজেপি তবে কি তাদের পাপস্খালনের কৌশল গ্রহণ করতে চাইছে? তাও খণ্ডিতভাবে? মধুসূদন-সুকান্ত-নজরুল তথা ‘রসুন’ বর্জন করে?
বিজেপি’র শিরোভূষণ নরেন্দ্র মোদী সম্প্রতি বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে তাঁর এবং তাঁর দলের বাঙালি-প্রীতির নিদর্শন রাখতে গিয়ে জানিয়েছেন যে রবীন্দ্রনাথের মধ্যে ভক্তি আন্দোলন থেকে কালীসাধক রামকৃষ্ণ দেবের চিন্তার পরিচয়ও অপ্রাপ্য নয়! তিনি অবলীলায় রবীন্দ্রনাথের ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’ আউড়ে গিয়েছেন! অর্থাৎ তাঁদের ডাক যে বাঙালিরা শুনতে চাইছেন না তিনি কি তা সম্যক উপলব্ধি করতে পারছেন? তাই কি তিনি ভিন্ন প্রেক্ষিতে, ভিন্ন আবহে তাঁর শেখা বুলি আউড়ে গেলেন! তিনি ব্রিটিশ ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রামে নিবেদিতপ্রাণ ক্ষুদিরাম, বীণা দাশ, প্রফুল্ল চাকি, প্রীতিলতাদের নাম করে তাঁদের আদর্শের কথা স্মরণ করতে চেয়েছেন। অথচ একই সময়ে তিনি বিস্মৃত হয়েছেন যে এদেশে ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁদের পূর্বসূরিদের কারও কোনও সদর্থক ভূমিকা ছিলো না, তাঁদের পূর্বসূরিরা এই স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ তো করেননি, পরন্তু তাঁরা ব্রিটিশ রাজশক্তির সঙ্গে সহযোগিতা করে দেশের স্বাধীনতাকামী মানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন। আজ তাঁরা নিছক নির্বাচনে সাফল্য লাভের লক্ষ্যে, বাঙালি-প্রীতির নমুনা রাখতে স্বাধীনতা সংগ্রামে শহিদ হওয়া জনাকয়েক বাঙালি বিপ্লবীর নাম নিয়েছেন! এতই যদি তাঁর বাঙালি-প্রীতি তাহলে আন্দামানের কুখ্যাত সেলুলার জেলের নামকরণ কেন বিশ্বাসঘাতক সাভারকরের নামে হলো? এর জবাব তো তাঁকে দিতে হবে। শুধু তাই নয়, দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অবদান ছিল এমন কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম করতে গিয়ে তিনি তো খোদ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামটাই বিস্মৃত হয়েছেন!
২০১৫ খ্রিস্টাব্দের ১৮ নভেম্বর মধ্যপ্রদেশের সাগর-এ আরএসএস-প্রধান মোহন ভাগবত জানিয়েছিলেন যে তাঁরা ভারতকে এক হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করতে চান কেননা হিন্দুধর্ম বিপরীতের মধ্যে ঐক্যে বিশ্বাস করে, আর একথা নাকি নোবেল পুরষ্কার বিজেতা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই বলে গিয়েছিলেন! তিনি তাঁর বক্তৃতার সমর্থনে রবীন্দ্রনাথের ‘স্বদেশী সমাজ’ শীর্ষক প্রবন্ধের কথা উল্লেখ করেছিলেন। (সুত্রঃ https://www.ndtv.com/india-news/rss-chief-invokes-tagore-appeals-for-hindu-rashtra-729070)
‘স্বদেশী সমাজ’ বিষয়ক রবীন্দ্রনাথের গোটা তিনেক লেখার সন্ধান পাওয়া যায়। প্রথমটি ‘স্বদেশী সমাজ’ শিরোনামে লেখা হয় ১৩১১ বঙ্গাব্দের ভাদ্র মাসে। এরপর “স্বদেশী সমাজ’ প্রবন্ধের ‘পরিশিষ্ট’ শিরোনামে আরও একটি লেখার সন্ধান পাওয়া যায় যা লেখা হয়েছিল পূর্বোক্ত প্রবন্ধের ঠিক পরের মাসে অর্থাৎ আশ্বিনে। এরপর ‘স্বদেশী সমাজ’-এর ‘সংবিধান’ রচিত হয়। তাছাড়া ১৩১১ বঙ্গাব্দের ভাদ্র মাসে ‘স্বদেশী সমাজ’ প্রবন্ধ পাঠের দুটি সভাও অনুষ্ঠিত হয়েছিল, সেই সভায় হীরেন্দ্রনাথ দত্ত, বিপিনচন্দ্র পাল, গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। এই সমস্ত লেখাগুলি একত্র করে রবীন্দ্রনাথের ‘স্বদেশী সমাজ’ পুলিনবিহারী সেনের সম্পাদনায় বিশ্বভারতীর তত্ত্বাবধানে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল ১৩৬৯ বঙ্গাব্দের পৌষ মাসে (অর্থাৎ ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাস নাগাদ)। ভাগবতোক্ত হিন্দুরাষ্ট্রের কথা রবীন্দ্রনাথ কোথায় বলে গিয়েছেন তা ওঁরাই জানেন।
১৩৩৬ বঙ্গাব্দের অগ্রহায়ণ মাসে এই গ্রন্থের সূচনায় ‘মর্মকথা’ প্রসঙ্গে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই বলেছিলেন: “স্বদেশী সমাজে …আমি বলেছিলুম ইংরেজ আমাদের রাজা এই কথাটা নিয়ে বকাবকি করে সময় নষ্ট না করে সেবার দ্বারা, ত্যাগের দ্বারা নিজের দেশকে নিজে সত্যভাবে অধিকার কররার চেষ্টা সর্বাগ্রে করতে হবে। দেশের সমস্ত বুদ্ধিশক্তি এবং কর্মশক্তিকে সঙ্ঘবদ্ধ আকারে কেমন করে দেশে বিস্তীর্ণ করা যেতে পারে, স্বদেশী সমাজে আমি তারই আদর্শ ব্যাখ্যা করেছিলুম।”
এর মধ্যে হিন্দুরাষ্ট্রের কথা কোথায় তা দুর্বোধ্য। এছাড়া এই ‘মর্মকথা’র শুরুতেই রবীন্দ্রনাথ দেশের ‘সরকারবাহাদুর’কে একটা ‘অমানবিক প্রভাব’ বলে চিহ্নিত করেছিলেন। স্বভাবতই ভাগবত যে রবীন্দ্রনাথকে হিন্দুরাষ্ট্রের প্রবক্তা হিসেবে আখ্যাত করে তাঁকে তাঁদের হীন রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করার প্রয়াস পেয়েছেন, রবীন্দ্রনাথ তাঁদেরই শংসিত ‘স্বদেশী সমাজ’-এর প্রারম্ভ কথায় দেশের সরকার সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করেছেন, সেই সরকার বাহাদুরের প্রয়াসকে ‘অমানবিক’ আখ্যা দিয়েছিলেন। তাছাড়া রবীন্দ্রনাথের ‘স্বদেশী সমাজ’ আদতে কোনও রাজনৈতিক প্রকল্প ছিল না, এখানে যেমন ব্রিটিশ-বিরোধিতার স্পষ্টতা নেই, তেমনই নেই তাঁর বক্তব্যের সুঠাম শরীরি কাঠামো। তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতেই তিনি যেসব কথা তাঁর ‘স্বদেশী সমাজে’ বলেছেন তার মধ্যে হিন্দুত্ব এবং হিন্দুরাষ্ট্রের কথা একান্তই অনুপস্থিত।
মোদী-ভাগবতরা তো রবীন্দ্রনাথকে তাঁদের কাঙ্ক্ষিত হিন্দুত্ববাদের প্রবক্তা হিসেবেই প্রতিপন্ন করায় অপপ্রয়াস পেয়ে চলেছেন! এভাবেই দেশের মানুষকে নিরন্তর বিভ্রান্ত করে রাজনৈতিক সুবিধা অর্জনের রাজনীতি করে থাকেন। তাঁরা বিস্মৃত হয়েছেন যে রবীন্দ্রনাথের কাছে জাতিয়তাবাদ এবং দেশপ্রেমের চাইতে মানবতাবাদকেই অধিকতর গুরুত্ব দিতেন। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি লিখেছিলেন: “দেশপ্রেম আমাদের অন্তিম আশ্রয় হতে পারে না। আমার অন্তিম আশ্রয় হচ্ছে মানবতাবাদ। আমি যদিন জীবিত আছি ততদিন অন্তত মানবতাবাদের বিনিময়ে দেশপ্রেমকে অনুমোদন দেবো না।”(সুত্রঃ ফ্রন্টিয়ার, ২ জানুয়ারী ২০২১) – অথচ মোদী-ভাগবতরা হলেন মানবতার চরম শত্রু। তাঁরা যে দর্শনের প্রভাবে প্রভাবিত সেই ফ্যাসিবাদ তো মানবাত্মার চরমতম শত্রু।
এর দু’বছর পর ২০১৭ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে এই মোহন ভাগবত পুনরায় পশ্চিমবঙ্গে তাঁদের রাজনীতির গ্রহণযোগ্যতার লক্ষ্যে আবারও রবীন্দ্রনাথকে তাঁদের হিন্দুত্বের ‘আইকন’ হিসেবে প্রচার করার অপপ্রয়াস পেয়েছিলেন। তিনি রবীন্দ্রনাথের পূর্বোক্ত প্রবন্ধের কথা উল্লেখ করে বলেছিলেন যে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন হিন্দু এবং মুসলিমরা নিজেদের মধ্যে চিরকাল এভাবে লড়াই করে চলতে পারবে না, একটা মধ্যপথই এই সংঘর্ষের ইতি টানতে সক্ষম, আর এই মধ্যপথই হচ্ছে হিন্দুত্বের পথ! (সুত্রঃ Catchnews, ৫ অক্টোবর ২০১৭) – এভাবেই ভাগবত রবীন্দ্রনাথকে নিজেদের ফ্যাসিস্ত রাজনীতির সপক্ষকরণের অপপ্রয়াস পেয়ে যাচ্ছেন বেশ কয়েক বছর ধরেই।
মাইকেল মধুসূদন দত্তকে বাঙালি হিসেবে সম্মান দিতে একান্তই পরাম্মুখ এই হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্তরা। আগামী নির্বাচনের মুখে বাঙালি-প্রীতির প্রদর্শনী খুললেও তারা ভুলেও মাইকেল মধুসূদন দত্তের নাম নেন না। প্রখ্যাত বাঙালি কবি মধুসূদন দত্তকে তাঁরা ‘দেশদ্রোহী’ আখ্যা দিয়ে থাকেন, কারণ তাঁর লেখা ‘হিন্দুবিরোধী’! তাঁর লেখায় রামচন্দ্রকে অপমান করা হয়েছে! মাইকেলের ‘আমি রাম এবং তার সাঙ্গপাঙ্গদের ঘৃণা করি’ এই উক্তির মধ্যে বিজেপিওআলারা রাম এবং হনুমান সহ তাঁর সাগরেদের ঘেন্না করেন বলে তো তাদের হিন্দুত্ববাদী আইকন-কেই নস্যাৎ করে দিয়েছেন! তাঁর মেঘনাদবধ কাব্যে প্রমীলার মুখ দিয়ে বলা উক্তি: “আমি কি ডরাই সখি ভিখারী রাঘবে?” তো বিজেপি-আরএসএস-এর হিন্দুত্ববাদের প্রতিপক্ষতাই করে! স্বভাবতই তাদের বাঙালি বন্দনার প্রদর্শনীতে মাইকেল মধুসূদন দত্তের স্থান হয় না! বাঙালি লেখকদের মধ্যে তাদের প্রিয় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নোবেল পুরষ্কার পাওয়ার যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে নোবেল দেওয়া হয়নি বলে তাদের আক্ষেপ! এই ছদ্ম বাঙালিপ্রেম দেখাতে গিয়ে তাঁরা বিস্মৃত হয়েছেন যে বঙ্কিমের জীবনকালে নোবেল পুরষ্কারের প্রবর্তন হয়নি! আর স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এঁদের নিকট ‘চরিত্রহীন, লম্পট এবং হিন্দু-বিরোধী বিদেশিদের এজেন্ট’ আর এঁকেই কিনা নোবেল পুরষ্কার দেওয়া হয়েছিল! (সুত্রঃ The Wire, ৪ এপ্রিল ২০১৭) আরএসএস-এর অন্যতম প্রচারক দীননাথ বাত্রা তো সরাসরি রবীন্দ্রচিন্তার বিরোধিতা করেছিলেন। তিনি রবীন্দ্রচিন্তার মধ্যে জাতীয়তাবাদের বিরোধিতার (অবশ্যই বিজেপি’র হিন্দুত্ববাদী জাতিয়তাবাদ) সন্ধান পেয়েছিলেন, পেয়েছিলেন ধর্ম আর মানবতাবাদের মধ্যে বিভেদরেখা টানার প্রয়াস। আর এখন আবার সেই রবীন্দ্রনাথকে আঁকড়ে ধরে সেই হিন্দুত্ববাদিরাই এখন তাদের বাঙালি-প্রীতি দেখাতে অতি তৎপর হয়েছে আগামী নির্বাচনে সাফল্যলাভের লক্ষ্যেই। আসলে ইতালির ফ্যাসিস্ত নায়ক বেনিতো মুসোলিনি এবং তাঁর পোষিত বুদ্ধিজীবীদের স্তাবকতায় রবীন্দ্রনাথকে সাময়িকভাবে হলেও তাঁরা বিভ্রান্ত করতে এবং তাঁর নিকট থেকে ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে শংসাপত্র আদায় করে বিশ্ববাসীর নিকট সেই বার্তা প্রদান করে বিভ্রম নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। রমাঁ রলাঁর অক্লান্ত প্রয়াসে অবশ্য রবীন্দ্রনাথ অবশেষে ফ্যাসিস্তদের সম্পর্কে মোহমুক্ত হয়েছিলেন এবং ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রামের গুরুত্ব উপলব্ধি করেছিলেন। এখনও আমাদের দেশের হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্তদের প্রতিনিধিরা মুসোলিনির অনুশীলিত প্রক্রিয়ায় বাঙালি-প্রীতি প্রদর্শন করতে এসে সেই রবীন্দ্রনাথকেই হাতিয়ার করতে চাইছে। তারা বিভিন্নভাবে রবীন্দ্র-স্তাবকতার মাধ্যমে বাঙালির মন জয় করে আসন্ন নির্বাচনে ফয়দা তুলতে চাইছে। ‘হিন্দুবিরোধী বিদেশিদের এজেন্ট’ অর্থাৎ দালাল রবীন্দ্রনাথ এখন হঠাৎ করে তাদের নিকট বড়ো দেশপ্রেমিক হয়ে উঠেছেন! এভাবেই তারা বাংলার ময়দানে প্রবেশের ছাড়পত্র আদায়ের চেষ্টা করছে। বাংলা এবং বাঙালি-প্রীতির সঘন নিদর্শনের প্রদর্শনীর দোকান খুলে বসেছে।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে বাইরে’র নিখিলের কথাগুলো তো সারা বাংলাময় ধ্বনি থেকে প্রতিধ্বনিত হয়ে চলেছে: “দেশকে দেবতা বলিয়ে যখন তোমরা অন্যায়কে কর্তব্য, অধর্মকে পুণ্য বলে চালাতে চাও তখন আমার হৃদয়ে লাগে বলেই আমি স্থির থাকতে পারিনে।”
একদিকে দেশপ্রেমকেই ‘দেবতা’ বলে প্রচার করা আর অন্যদিকে অন্যায় এবং অধর্মকে প্রয়োজনীয় অনুশীলন হিসেবে কার্যকরী করা একসঙ্গে কী করে চলতে পারে?
একদিকে কৃষকপ্রেমের বিজ্ঞাপন আর অন্যদিকে কৃষকস্বার্থ-বিরোধী আইন প্রণয়ন করে তাকে কার্যীভূত করার মধ্যে দিয়ে কর্পোরেটের ফুলে ফেঁপে ওঠার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ন্যায্য কৃষক বিদ্রোহকে ‘রাজনৈতিক’ মদতপুষ্ট, দেশবিরোধী নকশাল-মাওবাদী-খলিস্তানপন্থীদের পরিকল্পিত চক্রান্ত বলে আখ্যাদানের মতো ‘অধর্মকে পুণ্য বলে চালাতে’ চাওয়ার অপপ্রয়াস এবং আসন্ন নির্বাচনে বাংলাজয়ের লক্ষ্যে ছদ্ম বাঙালি-প্রীতির নিদর্শনের প্রদর্শনী কি একসঙ্গে চলতে পারে? ষাটেরও অধিক সংখ্যক কৃষক এই প্রবল শীতের মধ্যে প্রকাশ্য রাস্তায় নেয়ে আন্দোলন করতে গিয়ে শহিদ হয়েছেন। কতখানি অমানবিক, মানবতার শত্রু হলে এরকম একটা সংবেদনশীল ব্যাপারেও চরম উদাসীন থাকা সম্ভব তা এই মোদী-ভাগবতদের না দেখলে বোঝা যায় না।
আজ থেকে আশি বছর আগে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন যে তাঁর বিশ্বভারতী হচ্ছে একটা বিশাল জাহাজ, যে জাহাজ বয়ে নিয়ে চলেছে তাঁর সারা জীবনের সেরা মূল্যবান সম্পদ সমূহ। আর আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সেই বিশ্বভারতীর আচার্য হয়ে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতার চিন্তাভাবনা সম্পর্কে অনবহিত থেকে এক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপরাজনীতির অনুশীলন করে চলেছেন। এর চাইতে লজ্জার আর কী হতে পারে!
তাঁর ‘স্বদেশী সমাজ’-এই রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন: “… এই সময়েই বাঙালিকে নিয়ত স্মরণ করাইয়া দেওয়া দরকার যে, ঘর ও বাহিরের যে স্বাভাবিক সম্বন্ধ, তাহা যেন একেবারে উলটাপালটা হইয়া না যায়। … শিক্ষা করিব বাহিরে, প্রয়োগ করিব ঘরে।”
সারা দেশ জুড়ে আরএসএস-বিজেপি কী অন্যায় করে চলেছে নিত্য অহর্নিশ তার নমুনা আমরা নেতিবাচক ‘শিক্ষা’ হিসেবে যেমন গ্রহণ করবো এবং তেমনই আসন্ন নির্বাচনে এই হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্তদের ছদ্ম বাঙালিপ্রেম দেখিয়ে বাংলা দখলের প্রতিরোধে সেই নেতিবাচক শিক্ষার বিরোধিতাই ‘ঘরে’ প্রয়োগ করে দেখাবো। এই প্রচারবার্তাকেই আজ জনদরবারে সামনে নিয়ে আসা প্রয়োজন।
- অশোক চট্টোপাধ্যায়