পশ্চিমবঙ্গে আবার আসছেন বিজেপির দু’নম্বর নেতা অমিত শাহ। বিধানসভা নির্বাচন পর্যন্ত আসতে থাকবেনই। কিছু না কিছু জিগির তোলা তাঁর পরিকল্পনায় থাকবে। বিগত সফরের রাজনীতিতে ছিল এক ডাকসাইটে তৃণমূল দলত্যাগীর বিজেপিতে অন্তর্ভুক্তি করানো এবং দু’জেলায় দুটি জমকালো রোড শো। এবারের সফরেও সেরকম চমক কিছু থাকতে পারে, তবে অন্যতম কর্মসূচী থাকছে মতুয়া সমাজের ভোটের দখল পেতে আসা। সকলের নজর থাকবে সিএএ তাসটি তিনি কেমন খেলেন। ২০২০-র জানুয়ারীতে দেশজুড়ে যেমন, তেমনই এই বঙ্গভূমিতে, বিশেষত কলকাতায় উত্তাল হয়েছিল ‘এনআরসি-এনপিআর-সিএএ’ বিরোধী আন্দোলন। ইস্যুটা তারপরে দীর্ঘ একবছর যাবত ভাসমান ছিল নিস্তরঙ্গে। কারণ জনজীবন স্তব্ধ হয়ে যায় অতিমারী আর লকডাউনে। এখন আবার জনজীবন সচল হচ্ছে যখন এবং বিধানসভা নির্বাচন নিকটে, তখন সিএএ বিষয়টা সামনে না এসে চাপা থাকবে না। বিজেপি লকডাউনকালীন প্রসঙ্গটাকে মাঝেমধ্যেই নাড়াচাড়া করে এসেছে। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের এজেন্ডায়ও ইস্যুটা রয়েছে খুবই নজরের মধ্যে। কেন্দ্র ‘নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন’-এর হুমকি-হামলা ফের কিভাবে নামায় বুঝতে হবে। মতুয়া সমাজের ভেতর থেকে বিজেপির এক সাংসদ ক্রমাগত চাপ দেখিয়ে আসছেন। এটা নিছক নিচের তলাকার স্বতঃস্ফূর্ত চাপ নয়। এ চাপের পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে সুপরিকল্পিতভাবে নাগরিক নিরাপত্তাহীনতার ভয়াতঙ্ক ঢুকিয়ে, নাগরিকতার নিরাপত্তা সুনিশ্চিত হতে পারে একমাত্র সিএএ রূপায়ণ হলে, তার জন্য এরাজ্যে কেন্দ্রের অনুরূপ বিজেপি সরকার কায়েম হতে পারলে, সম্প্রদায় জনতার জানাবোঝায় পশ্চাদপদতার সুযোগ নিয়ে এসব উল্টোপাল্টা বুঝিয়ে। এই নীলনকশা বিজেপির ওপরতলার। সেইমতোই দলের বনগাঁ লোকসভা সাংসদকে দিয়ে গত মাস দুয়েক ধরে নতুন করে মতুয়া চাপ তোলানো হচ্ছে। মতুয়া জনতার বসবাস বাংলাদেশ লাগোয়া প্রায় সমস্ত জেলাতেই কমবেশি। সর্বত্র নীচেরতলায় উসকে তোলার ক্ষমতা নেই। উত্তর চব্বিশ পরগণা ও নদীয়া জেলাতেই যত জমায়েত সংঘটিত করানো হচ্ছে, যাতে জ্বালামুখ তৈরি করা যায়, যাতে ওজনদার নেতা উড়ে এসে দলের ভোট কৌশল হাসিল করার ‘অভয়বাণী’ জুড়ে দিতে পারেন।
বিজেপির এই নোংরা খেলায় নামার নীচতার উৎস রয়েছে নাগরিকতার প্রশ্নে তার ধর্মভিত্তিক বৈষম্যের দৃষ্টিভঙ্গীর মধ্যে। আর, আসামের মতোই বাংলায়ও ছুতো বানিয়েছে ‘বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী’ তত্ত্বকে। এটা ঘটনা, দেশভাগ, পূর্ববঙ্গ ও বাংলাদেশ সৃষ্টির ফলস্বরূপ হিন্দু উদ্বাস্তু জনতার স্রোত সবচেয়ে এসেছে পশ্চিমবঙ্গেই। সেই সিন্ধুতে হয়ত বিন্দুর মতো কিছু মুসলিমও এসে থাকবেন, হয় ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে থাকা শ্রেয় মনে করে, নয়তো অপেক্ষাকৃত অর্থকড়ি নিশ্চয়তার আশায়। জন্মভূমি মনে করে বা জোতজমি, চলতি রুজি-রোজগারের ভাবনায় বহু হিন্দুও থেকে গেছেন ওপার বাংলায়, পাকিস্তানে। এপার বাংলায় উদ্বাস্তু আসাকে কেন্দ্র করে কখনও কোনো সংঘাত হয়নি, মিলমিশ হয়ে গেছে। বিজেপি নিজের সাম্প্রদায়িক ও ক্ষমতার রাজনীতির স্বার্থে অহেতুক সিএএ প্রণয়ন করেছে। গোড়ার বিষ বপন করা হয়েছিল বিগত বাজপেয়ী জমানায়, ২০০৩ সালে প্রথম নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন এনে। সেই ধারারই উত্তরোত্তর কোপ নামিয়ে আনা হচ্ছে ‘সিএএএনআরসি-এনপিআর, বিদ্বেষ-বিভাজন-দলবাজীর পরিবেশ তৈরি করছে বিজেপি। মতুয়া জনগণের উল্লেখযোগ্য অংশের ভোটার তালিকায় নাম আছে। যাদের নেই তাদের নাম তুলে দিলেই সহজে বাকি সমাধান হয়ে যায়। তার জন্য প্রতিবেশি বা পরদেশ থেকে ‘পীড়িত হয়ে চলে আসা’, ‘স্বেচ্ছায় নিজেদের বে-নাগরিক ঘোষণা করে’ সিএএ-র বিধানে নতুন করে আবার নাগরিকত্বের জন্য হত্যে দিয়ে থাকা; এসব চলতে দেওয়া হবে কেন?
বিজেপির এসব ঘোট পাকানো কৌশল প্রয়োগের জমি পাওয়ার পেছনে তৃণমূল কংগ্রেসও দায়ী। তৃণমূল এখন সিএএ-এনআরসি-এনপিআর-এর বিরোধিতা করছে বটে। কিন্তু বামফ্রন্ট আমলে তৃণমূল নেত্রী প্রায়শ ফেরী করতেন ভোটার তালিকায় ‘বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী’ থাকার অপপ্রচার, যার কোনও বাস্তব ভিত্তি সেদিনও ছিল না, আজও নেই। সেদিন ফায়দা তুলতে চেয়েছিল তৃণমূল, আজ লুঠের লঙ্কাকান্ড ঘটাতে চাইছে বিজেপি। তাছাড়া, মতুয়াদের বাস্তুজমির পাট্টা দেওয়া থেকে শুরু করে নাগরিক জীবনের শিক্ষা-স্বাস্থ্য-খাওয়া-পরার ন্যূনতম প্রয়োজনগুলো গুরুতর আকারে অবহেলিত হয়ে রয়েছে। এসবও ক্ষোভ জমে ওঠার কারণ। একদা বিরোধী দল থাকাকালীন উদ্দেশ্য প্রণোদনা, অধুনা শাসক হিসেবে অপদার্থতা-ব্যর্থতা তৃণমূল অস্বীকার করতে পারবে না।
তবে, বিজেপিকে কিছুতেই কোনও অজুহাতে বদ মতলব চরিতার্থ করতে দেওয়া যায় না। আসামে এনআরসি-র যাঁতাকলে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে লক্ষ লক্ষ নিরীহ মানুষ ঘর-পরিবার ছাড়া হয়ে ছিন্নমূল, ভোগ করছে কারাগার-জীবনের বিভীষিকা। তাদের ব্যাপক অংশ হিন্দু জনগণ, ১৯ লক্ষের বেশি। তাই আসামের পরিণতি দেখে বুঝে নিতে হবে বাংলায় সিএএ নামানোর মধ্যে বিজেপির সুপ্ত উদ্দেশ্যটা কি!
আওয়াজ তুলে চলতে হবে সিএএ-এনআরসি-এনপিআর হটাও! বিজেপিকে ভোট নয়! বিজেপিকে হারাও — বিজেপিকে ভাগাও!!