অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণ তহবিল সংগ্রহ অভিযান শুরু করেছে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো। আর, ভারতের রাষ্ট্রপতি ঐ মন্দির নির্মাণ তহবিলে অর্থদান করলেন। যে পদে আসীন হতে শপথ নিতে হয় সংবিধান নির্দেশিত “ধর্মনিরপেক্ষতা” অনুসরণ করতে প্রশ্নাতীত অনুগত থাকার, রামনাথ কোবিন্দ পাঠ করেন সেই শপথবাক্য, শুধু তাই নয়, একই শপথ পাঠ করিয়েছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার সদস্যদেরও, সর্বোচ্চ রাষ্ট্রপ্রধান সেই সবকিছুকে পরিণত করলেন ছেঁড়া কাগজে। এই সাংবিধানিক লঙ্ঘন হল এমন এক সময়ে যখন ভারতের গণতান্ত্রিক প্রজাতান্ত্রিক দিবস উদযাপন দোড়গড়ায়। রাষ্ট্রপতির এই ধর্মীয় পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ, যা বাস্তবে পৃষ্টপোষকতারই স্বার্থবাহী, ধিক্কারযোগ্য স্খলনেরই নির্দিষ্ট প্রকাশ। বিগত ২০২০-র জানুয়ারী থেকে গোটা দেশ প্রত্যক্ষ করে আসছে দুই সম্পূর্ণ বিপরীতের সংঘাত। একদিকে কেন্দ্রের মোদী সরকার সংবিধানের একের পর এক এমন সব সংশোধনের পদক্ষেপ শুরু করে যা সরকার ও সংবিধানের গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রকে গুরুতরভাবে ক্ষুণ্ণ করে। নাগরিকত্বের প্রশ্নে বৈষম্য ও বিভাজনদুষ্ট এনআরসি-এনপিআর-সিএএ প্রবর্তনের অপপ্রয়াস, কাশ্মীরি জনগণের সাত দশকের স্বতন্ত্র স্বায়ত্ততার অধিকার সংযুক্ত ৩৭০ ধারা খারিজ করা ইত্যাদি হল সেই ন্যক্কারজনক পরিঘটনার পরিচয়। এইসমস্ত রাষ্ট্রীয় অপরাধ সামাজিক-রাজনৈতিক পরিমন্ডলের সাম্প্রদায়িকীকরণকে আরও মদত যোগায়। তাতে বাতাস যোগায় উপরন্তু সুপ্রীম কোর্টের চূড়ান্ত পক্ষপাতদুষ্ট অযোধ্যা রায়। বাবরি মসজিদ ধ্বংস করাটা অপরাধ হয়েছিল স্বীকার করেও কোর্ট আদেশ দিয়ে দেয় ধ্বংসস্তূপের ওপরই মন্দির নির্মাণের! সরকার ও সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ের এই যুগলবন্দী সংখ্যাগুরুবাদী আচরণে গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচার বারবার হয়েছে বিপন্ন। এক সেনা অধিনায়ককেও দেখা গিয়েছিল হিন্দুত্বের কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করতে। রাজ্যে রাজ্যে রাজ্যপালদের হিন্দু আচার-পার্বণে মেতে ওঠার প্রবণতা বাড়ছে সংবিধানকে অস্বীকার করে। বিপরীতে, ২০২০-র জানুয়ারী থেকেই গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধে জারিত দেশবাসী জারি রেখেছে প্রতিবাদ-প্রতিরোধের প্রয়াস। এই অভিযাত্রায় গত ২৬ জানুয়ারী উঠেছিল গণতন্ত্র ও সংবিধান বাঁচাও শপথ নেওয়ার জনজোয়ার। বিগত অতিমারী ও লক ডাউনের নজিরবিহীন কঠিনতম বছরে আরও বেশ কিছু নতুন নতুন দাবি-শ্লোগানের সংযোজন-সমন্বয়ের মাধ্যমে অব্যাহত রয়েছে লড়াইয়ের এই ধারা। একবছর আগে যার মডেল মুখ ছিল শাহীনবাগ আলোড়ন, এখন কিষাণ আন্দোলন। যে রাষ্ট্রপতি আজ রামমন্দির নির্মাণে অর্থদান করছেন, তাঁর কাছে সমান নাগরিকত্বের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নিতে মোদী সরকারের উদ্যত হওয়া কোন মাথাব্যথার কারণ নয়, তিনি কৃষি ও কৃষক স্বার্থ বিরোধী তথা কর্পোরেট স্বার্থসর্বস্ব তিনটি কৃষি আইনেও কত সহজে অনুমোদন দিয়ে দেন!!! এর পরে আর বুঝতে বাকি থাকে না বর্তমান রাষ্ট্রপ্রধানের ভূমিকা হিন্দুত্ব, মোদীরাজ ও কোম্পানিরাজের পক্ষপাতিত্বে ভরা।ইতিমধ্যে অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণ তহবিল সংগ্রহ অভিযানকে কেন্দ্র করে সংঘটিত হতে শুরু করেছে সাম্প্রদায়িক হুমকি ও আক্রমণ। অর্থ সংগ্রহের এই কর্মসূচী চলবে গোটা দেশজুড়ে দেড়মাস। তার জেরে পরিস্থিতি বিপজ্জনক হচ্ছে রাজ্যে রাজ্যে। দুই বিজেপি শাসিত রাজ্য গুজরাট ও মধ্যপ্রদেশে মন্দির-পন্থীদের মিছিল বের হচ্ছে লাঠি-তরোয়াল-ঝোলা হাতে। আক্রান্ত ও রক্তাক্ত হচ্ছে সংখ্যালঘু এলাকা। গুজরাটে মৃত্যু হয়েছে ঝাড়খন্ড থেকে কাজে যাওয়া এক পরিযায়ী শ্রমিকের। আহতের ও ঘরবাড়ি ভাঙচুর হওয়ার সংখ্যা অনেক। একই ভাবে সাঙ্ঘাতিক অবস্থা তৈরি হয়েছে মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়িনী, ইনদওর, মন্দসৌরে। ‘জয় শ্রীরাম’ আর ‘ভারত মাতা কী জয়’ ধ্বনি তুলে রক্ত ঝরানো, সন্ত্রস্ত করা ও অর্থসম্পদ সংগ্রহ হচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গে সামনে বিধানসভা নির্বাচন। বিজেপি খুবই আগ্রাসী। তাই এখানেও হিন্দুত্বের উন্মাদনার আগুন নতুন করে লাগানোর অপচেষ্টা দেখা দিতে পারে। রামমন্দিরের নামে টাকা তোলার অভিযানে সন্ত্রাস নামাতে পারে আরএসএস-বিশ্ব হিন্দু পরিষদ। গত বিধানসভা ও লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার আগে-পরে গঙ্গার দু’পাড়ের শিল্পাঞ্চলে হামলা সংঘটিত হয়েছিল সংখ্যালঘুদের ওপর। আবার বিধানসভা নির্বাচনকে নিশানা করে গ্রাম-গঞ্জে-শহর-শিল্পাঞ্চলে নেমে পড়েছে বিজেপি-আরএসএস। ওদের উদ্দেশ্য, রাজনীতির সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ। পরিবেশকে হিন্দুত্বের বিদ্বেষ-বিভাজনে বিষিয়ে দিতে ওরা অপচেষ্টা চালাচ্ছে বহুরকমভাবে। ঘৃণার বিষবাস্প ছড়াচ্ছে মতপার্থক্যের বাক স্বাধীনতাকে দাবিয়ে রাখতে। বিজেপির তৈরি ‘দেশদ্রোহী’ সংজ্ঞায়-সোরগোলে বিরুদ্ধমতকে চাপা দেওয়ার প্রয়াস প্রকট। মুক্তবুদ্ধি চর্চার, চিন্তাশীল ও স্বাস্থ্যকর তর্ক-বিতর্কের এবং মানবিক ঔদার্যের উত্তরাধিকার যে বাংলার বৈশিষ্ট্য, সেই পরিবেশ ধ্বংস করতে বেপরোয়া বিজেপি শিবির। তার জন্য হিংস্র ফাঁদ পাতা, প্ররোচনা দেওয়া, খোঁচানো শুরু হয়ে গেছে। হুমকিতে আক্রান্ত হচ্ছেন বিদ্বৎসমাজ, নাগরিক সমাজ ও শিল্পসাহিত্য সমাজের পরিচিতজনরা। এমনকি নানা অজুহাতে যৌনগন্ধী আক্রমণের ভয় দেখানো হচ্ছে নির্ভীক যুক্তিবাদী অভিনেত্রীদের। ওঠানো হচ্ছে ‘গোলি মারো … ...’ আওয়াজও। বিজেপির পাতা ফাঁদে জড়িয়েছে টিএমসি। তার বদলার নামে সুযোগ নিচ্ছে বিজেপি। যে কোনো বিরোধিতাকে উড়িয়ে দাও, ধ্বংস কর—এটাই বিজেপির দৌরাত্ম্য। পাশাপাশি, দুঃসাহস দেখাচ্ছে বাম ভোট রামপন্থীদের দিতে ডাক দেওয়ার !
এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোই একমাত্র বিষপ্রতিষেধক। সামিল হতে হবে সংবিধান ও গণতন্ত্র রক্ষার লড়াইয়ে।