দেশ আজ এক চরম বিপর্যয়ের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। কোভিড পরিস্থিতি, আচম্বিত লকডাউন, বেহিসেবি অর্থনৈতিক নীতি, গণতন্ত্র ও সংবিধানের জলাঞ্জলী, তীব্র সামাজিক ও ধর্মীয় বিভাজন, সর্বোপরি, কৃষক ও শ্রমিকের জীবন-জীবিকার ওপর সার্বিক আক্রমণে আজ জনজীবন সন্ত্রস্ত ও এক অতি সংকটের বলয়ে নিমজ্জমান। এ নিয়ে সংবেদনশীল মানুষের মধ্যে আর কোনও সংশয়ই নেই যে এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির সামনে এনে তিলে তিলে দাঁড় করিয়েছে যে রাজনৈতিক সত্তাটি তার নাম বিজেপি এবং তাদের মতাদর্শ ও উদ্দেশ্য এক কঠিন-কঠোর রাষ্ট্রীয় হিন্দুত্ববাদের নেতৃত্বে কর্পোরেট স্বার্থের বিকাশ।কর্পোরেট বাহিনীর আর্থিক শক্তির ওপর নির্ভর করেই এ দলের প্রচার-প্রসার ও টিকে থাকার প্রয়াস। সারা দেশ জুড়ে তারা যে আজক্ষমতাশালী হয়েছে তার পিছনে এই কর্পোরেট সহায়তা এবং উগ্র জাতীয়তাবাদী হিন্দুত্বের এক সবিশেষ মিশ্রণ ও রাজনীতি নির্ণায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। এ বাদে এ কথাও অনস্বীকার্য, বিরোধী রাজনীতি, বিশেষত কংগ্রেসের তথাকথিত উদারবাদী অর্থনীতি, রাজনৈতিক দেউলিয়াপনা ও চরমতম দুর্নীতি জনসাধারণের মনে এক অন্যতর বিকল্প সন্ধানের জন্যও প্ররোচিত করেছিল। সেই শূন্যস্থানটি অবশ্যই কতকটা ভরাট করতে পেরেছে বিজেপি তাদের নব-উত্থাপিত হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি দিয়ে যা মানুষের মনে তার নতুনতর আঙ্গিকের জন্য কিছুটা ছাপ ফেলেছে। অবশেষে এই ভরাট হয়ে ওঠা জনমানস ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস আজ একযোগে তার হিংস্রতম রূপে সমাজের সামনে যুদ্ধরত অবস্থায় দণ্ডায়মান।
তাহলে উপায়? এই মুহূর্তে জাতীয় স্তরে বিজেপি বিরোধী কোনও জাতীয় দলের অনুপস্থিতি, বিভিন্ন বিরোধী দলগুলির মধ্যে সার্বিক ঐক্যের অভাব এবং বিজেপি’র সুচারু ও সুগঠিত প্রচারযন্ত্রের আক্রমণাত্মক অভিযানের সামনে বিরোধীদের কতকটা দিশেহারা অবস্থা গণতান্ত্রিক ও দেশপ্রেমিক মানুষের সামনে এক চ্যালেঞ্জ উপস্থিত করেছে। সে চ্যালেঞ্জ হল, এক যথাযথ বাস্তবানুগ কর্মসূচি ও আন্দোলন নির্মাণ করা, মানুষের চলমান আন্দোলনগুলির পাশে দাঁড়ানো এবং অধিষ্ঠিত মৌলবাদী বাতাবরণকে নির্মূল করে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে পুনঃস্থাপিত ও বিকশিত করা। আর এ কাজে অগ্রণী ভুমিকা নিতে পারে বামপন্থী শক্তিসমূহ ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে জারিত মানুষেরাই।
এইরকম এক পরিস্থিতি ও সম্ভাবনার মধ্যেই পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের দামামা বেজে উঠেছে। এখনও পর্যন্ত এ নিয়ে মিডিয়া ও রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে যতটা উত্তেজনা ও আকচাআকচি দেখা যাচ্ছে, তা জনসাধারণের মধ্যে ততটা নয়। তা খুব স্বাভাবিক। কারণ, বুঝতে হবে, মানুষ এখন অনেক সচেতন এবং তাঁরা নির্বাচনগুলিকে অনেক সময়েই নিজ অবস্থার উন্নতিকল্পে দরকষাকষির মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করেন। তবে তার জন্য বামপন্থীরা বসে থাকতে পারে না। সারা দেশ জুড়ে যে ভয়ঙ্কর রাজনীতির আধিপত্য চলেছে, তার পরিপ্রেক্ষিতেই এ রাজ্যেও নির্বাচনী সংগ্রামকে দেখতে হবে।
এ দেশের রাজনীতিতে বিজেপির যে প্রাথমিক সাফল্য তা হল এমন কিছু ইস্যুকে তারা আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে যেখান থেকে সাম্প্রদায়িক ও বিভাজনের রাজনীতির সূত্রপাত হয়। বিরোধীরাও সেই ফাঁদে পা দিয়ে ওদের তোলা ইস্যুগুলিতে বিবাদবিতর্কে জড়িয়ে বিজেপির পাল্লাকে আরও ভারী করেছে। সাম্প্রতিক বিহার নির্বাচনে অবশ্য বিজেপির এই সুকৌশলী রণনীতিকে জোর ধাক্কা দেওয়া গেছে। রাম মন্দির, ৩৭০ বা পুলওয়ামা নয়, মানুষের বেঁচে থাকার জন্য তার জীবন-জীবিকার মুদ্দাই যে প্রধান অক্ষ তা বিহার নির্বাচনে বিরোধীদের সবল ঐক্যের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠা করা গেছে। গত কয়েক বছরের মধ্যে সম্ভবত এই প্রথম, নির্বাচনের ইস্যু নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিজেপি নয়, বিরোধীরা নির্ণায়ক ভূমিকা নিয়েছে। ফলে, নির্বাচনী যুদ্ধে জোর টক্করও দেওয়া গেছে। সরকার গঠন না করা গেলেও এক প্রবল বিরোধীপক্ষের অস্তিত্বকে নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে। এটা নিঃসন্দেহে ভারতীয় রাজনীতিতে এই সময়ে এক যুগান্তকারী ঘটনা। আর এর পরপরই এসে পড়েছে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন, যার গুরুত্ব সর্বভারতীয় আঙ্গিনায় অসীম। কারণ, পশ্চিমবঙ্গ হল এমন এক রাজ্য যা মুক্তচিন্তা ও বাম রাজনীতির অন্যতম উৎসস্থল। এ রাজ্যে যদি বিজেপি জয়ী হয় বা নিদেনপক্ষে আসনের বিচারে প্রবল প্রতিপক্ষও হয়ে ওঠে তাহলে তা তাদের পক্ষে পোয়াবারো ও গোটা দেশের পক্ষে অশনি সংকেত হবে। এটা অনুধাবন করে সংঘ পরিবার ও আরএসএস এই মুহূর্তেই এ রাজ্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছে এই উদ্দেশ্যে যে যদি পশ্চিমবঙ্গে বাম ও মুক্তধারাকে পরাস্ত করা যায় তবে মতাদর্শগতভাবে তার ভারত বিজয় সম্পূর্ণ হতে পারে। তাই, পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন আজ বামপন্থীদের কাছে এক দুর্জেয় চ্যালেঞ্জ।
কিন্তু চ্যালেঞ্জ এসে পড়া আর তাকে গ্রহণ করার সক্ষমতা -- এই দুইয়ে দুস্তর ফারাক আছে। কারণ, চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার মধ্যে শুধু সদিচ্ছা থাকাটাই যথেষ্ট নয়, চাই যথাযথ বাস্তববোধ ও লড়াইয়ের রণকৌশল। সেই দিক থেকে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপিকে ঠেকাতে বামপন্থীদের কী রণকৌশল হতে পারে তা ইতিমধ্যেই চর্চার বিষয় হয়ে উঠেছে। কেউ কেউ বলছেন, রাজ্যের শাসনক্ষমতায় যেহেতু তৃণমূলের সরকার রয়েছে তাই শুধুমাত্র বিজেপি’র বিরুদ্ধে বললে তৃণমূল বিরোধী যে ক্ষোভ তা বামেদের হাতছাড়া হয়ে যাবে। অতএব, বিজেপি ও তৃণমূল এই দুই শক্তির বিরুদ্ধেই একযোগে বলতে হবে এবং এইভাবে বামপক্ষ শক্তিশালী হবে। কিন্তু প্রশ্ন হল, যারা এই কথাগুলি বলছেন, সেই বামপন্থীরা কি বামফ্রন্ট বা বামফ্রন্ট-কংগ্রেস জোটের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট আস্থাবান? ভাবের ঘরে চুরি না করে এই কথাটি আগে একটু পরিষ্কার করে নেওয়া যাক। সবচেয়ে বড় কথা, এ রাজ্যে ক্রমাগত বিজেপি’র যে ভোট বেড়েছে ও বামফ্রন্টের ভোট কমেছে- এই দুই প্রবণতায় কোনও যোগসূত্র নেই বলে কি তাঁরা নিশ্চিত? তাই যদি হবে তাহলে ফিসফিসে এ কথা শোনা যায় কেন: ‘একুশে রাম ছাব্বিশে বাম’?আর আশ্চর্যের কথা হল, রাজ্য সরকার বিরোধী পরিসরে বিজেপিই বা কীভাবে প্রধান জায়গা দখল করে নিল যেখানে এক দশক আগেও তারা প্রান্তিক শক্তি হিসেবেই এ রাজ্যে বিচরণ করত? অন্যের দিকে আঙ্গুল তোলার আগে তাই নিজেদের দিকেও প্রশ্ন ছুঁড়তে হবে! বামপন্থার মর্মবস্তুতে কোনও ভেজাল মিশে ছিল না তো!
তাই সামগ্রিক পরিস্থিতি অত সহজ নয়, যেভাবে এক পক্ষ ভাবতে চাইছেন। চ্যালেঞ্জ যদি আজ গ্রহণ করতে হয় তাহলে সে চ্যালেঞ্জ হল বামপন্থার পুনরুত্থানের চ্যালেঞ্জ। এ রাজ্য বরাবরই সজল-শ্যামল ভূমি। এখানকার আলো-বাতাস মুক্ত ও উদার। আর সে পুষ্টিতেই বামপন্থার শিকড় গভীরে প্রোথিত। সেই সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল আজ আক্রান্ত ও বিপন্ন। এক শুষ্ক, কঠোর ও হিংস্র মতাদর্শে বলীয়ান বর্গীরা এসেছে এ রাজ্যকে লুঠ করতে। এই লুঠ শুধু অর্থনীতির নয় ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও পরম্পরারও। যা একবার চলে গেলে তাকে পুনরুদ্ধার করতে অনেক রক্তক্ষয় ও যুগ-যুগান্তের সময় চলে যাবে। তাই এই ভয়াবহ বিপদ থেকে বাঁচতে প্রতি- আক্রমণের বর্শামুখকে নির্দিষ্ট করতে হবে বর্গীদেরই দিকে।
নির্বাচন আসতে এখনও চার-পাঁচ মাস বাকি। তাই এই মুহূর্তে এ জোট সে জোটের আলোচনা প্রাসঙ্গিক নয়। যা জরুরি তা হল, উগ্র হিন্দুত্ববাদের মোড়কে বিজেপির যে কর্পোরেটতন্ত্র প্রতিষ্ঠার খোয়াব, তার বিরুদ্ধে মানুষের জীবন-জীবিকার মুদ্দাকে কেন্দ্র করে নির্মাণ করতে হবে এমন এক ‘গণ এজেন্ডা’ যা আগত নির্বাচনের মূল চরিত্রটাকেই বদলে দেবে। অর্থাৎ, পুলওয়ামা নয়, পাকিস্তান চীন নয়, রামমন্দির নয়, হিন্দু-মুসলমানের বিভাজন নয়, আগামী নির্বাচনের মুদ্দা হবে বেকারত্ব, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ও গণতন্ত্র। সাম্প্রতিক বিহার নির্বাচন এই শিক্ষাই দিয়েছে আর সে কারণে বামপন্থীদের আপেক্ষিক সাফল্যও এসেছে। যদি এই মৌলিক দাবি-দাওয়ার ওপর নির্বাচনী ঝড় তোলা যায় তাহলেই বামপন্থীদের নতুন করে জাগরণ ও ফিরে আসার সম্ভাবনা তৈরি হবে। কিন্তু এই বিষয়গুলিকে বাদ দিয়ে যদি শুধুমাত্র অমুক পার্টি তমুক পার্টি, হেন জোট তেন জোট – এইসব কূটকচালিতে বামপন্থীরা ব্যস্ত হয়ে পড়ে তাহলে নির্বাচনের এজেন্ডাও কিন্তু হাতছাড়া হয়ে যাবে। তখন বিজেপি নির্মিত বিভাজনের রাজনীতির মুদ্দার ওপরেই খেলতে হবে যা বিপর্যয়ের সামিল।
আজ সারা দেশ জুড়ে কৃষক জাগরণ এক অনুকূল পরিস্থিতি নির্মাণ করেছে। আদানি-আম্বানির হাতে কৃষিব্যবস্থাকে তুলে দেওয়ার মোদি সরকারের ফন্দি কৃষকেরা ধরে ফেলেছেন। এই আন্দোলনের রাশকে শক্ত হাতে ধরে এবং শ্রমজীবী মানুষ ও ছাত্রযুব সমাজের সমস্যাকে প্রধান অক্ষ করে যদি এ রাজ্যে নির্বাচনী এজেন্ডাকে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নির্মাণ করা যায় তাহলে বামপন্থার পুনরুত্থান ও সদর্থক লড়াই সময়ের ক্ষণিক অপেক্ষা মাত্র। তাই, দৃষ্টিভঙ্গি এমনটা হওয়া কাম্য নয় যে আগে তৃণমূলের বিদায় তারপর বিজেপিকে মোকাবিলা (যা আত্মহত্যার সামিল), বরং জীবন-জীবিকার মুদ্দাগুলিকে হিমঘরে পাঠিয়ে দিয়ে বিভাজনের রাজনীতি নির্মাণ করার যে বিজেপি মতাদর্শ, তাকেই বর্শামুখ করে সর্বাত্মক লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। তবেই বামপন্থার আলাদা মাত্রা, তাৎপর্য ও গুরুত্ব নির্মিতহবে যা তাকে নতুন করে শক্তি ও কাজের বিস্তৃত পরিসর দেবে। বামপন্থার পুনর্জাগরণের এই হল আজকের পথ। লড়াই কঠিন কিন্তু পরিস্থিতি অনুকূল।
- অনিন্দ্য ভট্টাচার্য