নয়া কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে চলমান কৃষক আন্দোলনের সংহতিতে ও বিহার বিধানসভা নির্বাচনে ছাত্র-যুব-কৃষক আন্দোলনের সাফল্যকে অভিনন্দন জানাতে ৯ ডিসেম্বর কলকাতায় অনুষ্ঠিত হল ‘সংবিধান বাঁচাও, দেশ বাঁচাও সমাবেশ’। আইসা ও আরওয়াই-র ডাকে কলকাতা কর্পোরেশন লাগোয়া চত্ত্বরে কলকাতা সংলগ্ন জেলাগুলি থেকে ছাত্রছাত্রী ও নাগরিকেরা সমাবেশিত হন। ৯ ডিসেম্বর ছিল নারী শিক্ষা আন্দোলনের পথিকৃৎ রোকেয়া শাখাওয়াত হোসেনের জন্ম ও মৃত্যু দিবস। সঞ্চালক ও সভাপতি আইসার রাজ্য প্রেসিডেন্ট নীলাশীষ বসুর আহ্বানে সিপিআইএমএল লিবারেশনের পাঁচ জন বিধায়ক, পার্টির সাধারণ সম্পাদক এবং আইসা ও আরওয়াইএর রাজ্য সম্পাদকগণ রোকেয়া শাখাওয়াতের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করে মঞ্চে উপবিষ্ট হন। আইসা নেত্রী অন্বেষা স্বাগত ভাষণে ফ্যাসিবাদের আগ্রাসন তথা রোহিত বেমুলার প্রাতিষ্ঠানিক হত্যাকাণদের পর শুরু হওয়া ছাত্রযুব আন্দোলনের ধারাবাহিকতা বর্তমানে চলমান কৃষক আন্দোলনের সাথে মিশে যাওয়ার কথা বলেন। বিহারের সদ্য নির্বাচিত বিধায়কদের অভিনন্দন জানিয়ে বলেন যে সেই ছাত্র-যুব আন্দোলনের গর্জন এখন বিহার বিধানসভার অভ্যন্তরেও লড়াইয়ের বার্তা শোনাবে। রোকেয়া শাখাওয়াতের নারীমুক্তি নারীশিক্ষা আন্দোলনের প্রসঙ্গ টেনে অন্বেষা বলেন যে চলমান আন্দোলনে মহিলা ও ছাত্রীরা ক্রমবর্ধমান হারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালম করে চলেছে। সমাবেশে উপস্থিত মানুষদের সামনে পাঁচ বিধায়ককে পরিচিত করার জন্য পার্টির সাধারণ সম্পাদক কমরেড দীপঙ্কর ভট্টাচার্য্যকে ডেকে নেন। কমরেড দীপঙ্কর বলেন নব নির্বাচিত ১২ জনের মধ্যে ৫ জন এই সমাবেশে এসেছেন। একে একে তিনি পাঁচ জনকে পরিচিত করান এবং তাঁদের চাদর পরিয়ে সম্বর্ধনা জানায় আইসা-আরওয়াইএ কমরেডরা।
মেহবুব আলম বিহার বিধানসভায় পার্টির বিধায়ক দল নেতা। বলরামপুর কেন্দ্র, যা আগে বারসোই কেন্দ্র ছিল, সেখান থেকে কমরেড মেহেবুব ৭৪ হাজার ভোটের রেকর্ড ব্যবধানে জয়লাভ করেছেন এবং প্রতিপক্ষ ছিল বিজেপি, যদিও বিজেপি নিজের নামে প্রার্থি দেওয়ার বদলে ভিআইপি দল থেকে তাদের প্রার্থি দাঁড় করিয়েছিল। বীরেন্দ্র গুপ্তা নেপাল সীমান্তের পশ্চিম চম্পারণ জেলার সিকটা ক্ষেত্র থেকে নির্বাচিত হয়েছেন। তৃতীয় পর্বে এখানে ভোট হয়েছিল এবং এই তৃতীয় পর্বে বিজেপি প্রবল সাম্প্রদায়িক বিভাজন করতে সক্ষম হয়, কিন্তু সেই বিভাজনকে পরাস্ত করেই পার্টি জেতে। বীরেন্দ্র গুপ্তা আয়ারলার নেতা, কৃষক গ্রামীণ শ্রমিকদের জনপ্রিয় আন্দোলন পরিচালনা করেন।
সত্যদেও রাম উত্তরপ্রদেশের গোরখপুর লাগোয়া সিওয়ান জেলার দরৌলি কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত বিধায়ক রবং পার্টির দলের উপনেতা, গতবার ২০১৫-র নির্বাচনের প্রাক্কালে বিজেপি-জেডিইউ চক্রান্ত করে মিথ্যা মামলায় তাঁকে কারাবন্দী করে, কিন্তু জেল থেকেই তিনি জিতেছিলেন। আড়াই বছর পর জামিন পান। আরেকজন কমরেড অমরজিত কুশোয়া এখনও জেলেই, এবং জেল থেকেই জিতেছেন। কমরেড দীপঙ্কর বলেন, ৯ ডিসেম্বরের এই সমাবেশ থেকে সত্যদেও ও অমরজিতের মামলা প্রত্যাহারের দাবি উঠুক। প্রশ্নটি কেবল বিহারের নয়। সারা দেশজুড়েই বিজেপি সমস্ত প্রতিবাদী কণ্ঠকে কারাবন্দী করছে। ভারভারা রাওয়ের মতো প্রবীণ কবি, সুধা ভরদ্বাজ বা বৃদ্ধ স্ট্যান স্বামীর মতো মানুষ মিথ্যা মামলায় জেলবন্দী। ভীমা কোরেগাঁওকে কেন্দ্র করে মিথ্যা মামলা ও ইউএপিএ চেপেছে। সমস্ত রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির আওয়াজ জোরালো করার আহ্বান রাখেন সাধারণ সম্পাদক। যুব নেতা মনোজ মঞ্জিলকে পরিচিত করিয়ে দিতে গিয়ে তিনি বলেন, রোহিত ভেমুলার মৃত্যুর পর পার্টি এক মতাদর্শ অভিযান চালিয়েছিল ‘নই ভারত কি ওয়াস্তে, ভগত সিং আম্বেডকর কি রাস্তে’, মনোজ মঞ্জিল বিহারের বুকে এক অভূতপূর্ব শিক্ষা আন্দোলনকে নেতৃত্ব দেন যা ‘সড়ক পর স্কুল’ নামে পরিচিত হয়। মনোজ ৬৩% ভোট পেয়ে জিতেছেন যা এবারের নির্বাচনে শতাংশের হিসেবে সর্বোচ্চ প্রাপ্ত ভোট। আইসার সর্ব ভারতীয় সাধারণ সম্পাদক সন্দীপ সৌরভকে পরিচিত করিয়ে দীপঙ্কর বলেন, জেএনইউ-তে আইসার দীর্ঘ আন্দোলনকে কৃষক আন্দোলনের সাথে একাত্ম করানোর প্রয়াস বরাবর থেকেছে। শহিদ কমরেড চন্দ্রশেখর ছিলেন এক দৃষ্টান্ত। জেএনইউ-এর ছাত্রনেতাকে প্রার্থি করায় বিজেপি ‘বহিরাগত’, ‘টুকরে টুকরে গ্যাং’ ইত্যাদি বলে ব্যাপক বিষোদ্গার করে, কিন্তু মানুষ বিভ্রান্ত হয়নি। লোকসভা নির্বাচনে কানহাইয়া কুমারকে জিতিয়ে আনতে আমরা পারিনি, কিন্তু এবার সন্দীপ জিতেছে। বিধানসভায় ছাত্র আন্দোলনের আওয়াজ পৌঁছবে, সন্দীপকে কেন্দ্র করে ১৮ থেকে ২৫, ২৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সী নব প্রজন্ম জাতিদম্ভের ঊর্ধে উঠে সক্রিয় হয়ে ওঠে শিক্ষার প্রশ্নে। এদের অনেকেই রাজপুত কমিউনিটির এবং দ্বিতীয় পর্বের নির্বাচনে তাঁরা মেহেবুব আলমের জন্য কাজ করতে যাওয়ার ইচ্ছাও প্রকাশ করেন কারণ তাঁদের মতে বিগত দিনে মেহবুব আলম বিহার বিধানসভায় তাঁদের শিক্ষা ও কাজের প্রশ্নগুলি বারবার তুলে ধরেছেন। সবশেষে দীপঙ্কর বলেন যে, অধিকারের প্রশ্নে আন্দোলন জেডিইউ-বিজেপি শিবিরে ফাটল ধরিয়েছে, জাতিদম্ভ ভেঙ্গে যুবরা এভাবে এগিয়ে এসেছে — এই বার্তা বিহার থেকে বাংলায় আসুক, ছড়িয়ে পড়ুক। পাঁচ বিধায়ককে সম্বর্ধনার পর আইসা-আরওয়াইএর পক্ষ থেকে কমরেড দীপঙ্করকে পুষ্পস্তবক দিয়ে সম্বর্ধনা জানান হয়।
দিল্লিতে কৃষকদের যে নাছোড়বান্দা লড়াই চলছে সেখানে ইতিমধ্যে পাঁচজন শহিদ হয়েছেন। উত্তর প্রদেশে যোগি সরকারের পুলিশ এক আন্দলনকারি কৃষককে হেফাজতে হত্যা করেছে। এইসব কৃষক শহিদদের স্মরণে স্পমাবেশে উপস্থিত সকলে উঠে দাঁরিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করেন। এরপর ‘নৈহাটি অগ্নিবীণা’ সংগীত পরিবেশন করে এবং তারপর বিভিন্ন বক্তারা পরপর বক্তব্য রাখেন।
আরওয়াইএ-র রাজ্য সম্পাদক অপূর্ব ঘোষ বলেন, সংবিধান ধ্বংস করা ও সংঘীকরণের বিরুদ্ধে মুখোমুখী লড়াইয়ে আছে ছাত্রযুবরা, বিজেপি ইচ্ছেমতো ঠিক করে সংবিধানের কোনটা মানবে আর কোনটা মানবে না। স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ লাগু না করে কৃষিকে কর্পোরেটদের হাতে দেওয়ার আইন বানায়, রেল নিযুক্তি ধ্বংস করে। ২কোটি চাকরি কোথায় গেল! নতুন বেকার তৈরি হল। লোকাল ট্রেন চালু হয়েছে, কিন্তু অফিস টাইমে ভিড় নাই, কারণ কাজই নাই, চাকরি উধাও। পশ্চিমবঙ্গকেও গোটা ভারতের সাথে সুর মিলিয়ে বিজেপির বিরুদ্ধে সর্বাত্মক লড়াই চালাতে হবে।
সন্দীপ সৌরভ বলেন, একের পর এক হামলা চলছে সংবিধান ও গণতন্ত্রের ওপর। দিল্লির কৃষক জমায়েত অংশ নেওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে সন্দীপ বলেন যে দিল্লির উপকণ্ঠে প্রায় দুই কোটি মানুষ বিভিন্নভাবে সামিল আছে। দিল্লির দরজা থেকে বিশ কিলোমিটার পর্যন্ত কৃষকদের দখলে এবং প্রতিদিন আরও দুইতিন কিমি যুক্ত হচ্ছে। কৃষি আইন তিনটি খতম না হওয়া পর্যন্ত কৃষকেরা লড়বেন। সরকার বিভিন্ন কথা বলে কেবলই অপমান করে চলেছে, কিন্তু কৃষকরা বলছেন যে তাঁরা ঠাণ্ডায় মরে যাবেন তবু আদানি আম্বানির গুলামি করবেন না। কৃষির ওপর, কৃষকের উৎপাদনের ওপর নজর পড়েছে কর্পোরেটদের। সব গ্রাস করতে চায়। এই আইনগুলির ফলে তো রেশনও বন্ধ হয়ে যাবে। কৃষকদের প্রতিটা আহ্বানে ছাত্রসমাজ তথা আইসা আগ বাড়িয়ে যোগ দেবে বলে জানান সন্দীপ। তিনি বলেন, রোকেয়া ছিলেন নারীশিক্ষার অগ্রদূত, সরকার এখন মেয়েদের শিক্ষাজগত থেকে বের করে দিতে চাইছে, প্রতিটা ইউনিভার্সিটিতে আক্রমণ হানছে, ক্যাম্পাসগুলোকে ওয়ার জোন বানিয়ে ফেলেছে, প্রতিদিন নতুন নতুন সার্কুলার। অনেক আগেই আরএসএস তাদের এক মিটিং থেকে সর্বশিক্ষা খতম করার লক্ষ্য ঠিক করেছিল সংবিধান ... দেশ বাঁচাও সমাবেশ একের পাতার পর এবং ‘স্বচ্ছ ভারত’ সামনে এনেছিল। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠক্রম, এডমিনিস্ট্রেশন ও কন্ট্রোল — তিন লেবেলেই একাধিপত্য কায়েম করতে চায় তারা। বাংলাতেও ওদের নজর পড়েছে, ওরা শিক্ষা ও গণতন্ত্রকে সহ্য করতে পারে না। বিহার বিধানসভা নির্বাচনে ওরা ১৯ লক্ষ চাকুরির কথা বলেছিল। বিধানসভার অধিবেশনে প্রশ্ন তুললে এখন ওদের সরকার বলছে যে আগামি পাঁচ বছরে মোট পাঁচ লক্ষ চাকুরি দেবেন তারা! পশ্চিমবঙ্গেও নির্বাচন আসছে, ওরা ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ওদের হারাতে হবে। বিজেপি আরএসএস-এর বিরুদ্ধে সংগ্রামে ছাত্রযুবদের বড় ভূমিকায় থাকতে হবে।
মনোজ মঞ্জিল বলেন, ভোজপুর ও পুরো বিহার রাজ্যে সরকারী স্কুলের অবস্থা অত্যন্ত সঙ্গীণ। কমজোর সমাজের বাচ্চাদের সীক্ষার কোনও সুযোগ নাই। পিছড়ে বর্গের জন্য সংরক্ষিত পৌনে চার লাখ পদ খালি পড়ে আছে। বুনিয়াদি সুবিধা নাই, জমি বা ভবন নাই, খোলা আকাশের নীচে চলে স্কুল। সামন্তি জুলুমের বিরুদ্ধে লড়েছে ভোজপুর, শিক্ষার জন্যও লড়বে। তাই শুরু হল গ্রামে গ্রামে লাল ঝাণ্ডা নিয়ে শিক্ষা নাদোলন। সরকার বলে, জমি দিলে স্কুল হবে। স্কুলের জন্য গ্রামের গরিব দলিতদেরই জমি দান করতে হবে নইলে স্কুল হবে না। আদানি আম্বানিদের জন্য গুলি চালিয়ে জমি দেয় সরকার, আদিবাসীদের উচ্ছেদ করে বনের জমিও দিয়ে দেয়, কিন্তু গরিবদের স্কুল খোলার জন্য সরকারের জমি নাই। ফলত শুরু হয় ‘সড়ক পর স্কুল’ আন্দোলন। গ্রামে গ্রামে সব ছেলেমেয়েরা, সব পরিবার, যে দলেরই হোক না কেন, যখন আইসা বা পার্টি গেছে তখন তারা সকলে এসে সামিল হয়েছে এই আন্দলনে। হাজার হাজার মানুষ সামিল হয়েছে। ডিএম দপ্তরের সামনে এমনকি বিএড কলেজও চালানো হয়েছে। জেডিইউ-বিজেপি সরকার গ্রেপ্তার করেছে, জেলে পাঠিয়েছে, কিন্তু গরিব দলিত মানুষের শিক্ষার আকাঙ্খা দমন করতে পারবে না। এক সময় লাল ঝাণ্ডাকে যারা ঘৃণা করত তারাও লাল ঝাণ্ডাকে ভালোবাসতে শুরু করে, সব ধর্ম জাতি এক সুরে বলে “পড়াইকে লিয়ে বিহার কি বিধানসভায় লড়াই চাহিয়ে”। তাঁরা আমাকে নির্বাচিত করেছেন, নিশ্চিতরূপে সেই লড়াই চলবে, আম্বেদকরের স্বপ্ন সফল করার লড়াই চলবে, আওয়াজ উঠবে রাস্তাতেও দেশ জুড়ে।
মেহেবুব আলম বলেন, ২০০০ সাল থেকে জিতছি। এবারে মুখ্য লড়াই ছিল বিজেপির সাথে। বিজেপি ওখানে সিপিআই(এমএল)-কে মুসলমানদের পার্টি বলে, আমরা খুশিই হই। উত্তর দিনাজপুর ও মালদার লাগোয়া বারসই। নির্বাচনে প্রথম থেকেই আমাদের শ্লোগান ছিল আক্রমণাত্মক। আমরা বলেছিলাম বারসইকে ফ্যাসিবাদী বিজেপির কবরস্থান বানাও। বিজেপি ভেগেই গেল। নিজের নামে প্রার্থি দেওয়ার সাহসই হল না। গতবার ওদের যে প্রার্থিছিল তাকেই ফেক পার্টি ‘ভিআইপি’র টিকিটে দাঁড় করায়। বাংলা থেকেই কমিউনিস্ট অনুপ্রেরণা পেয়েছি, সিপিএম ছেড়েছি প্রকৃত কমিউনিস্ট হতে। সংবিধানের ওপর এখন হামলা চলছে। কিছু না মেনে জবরদস্তি চালাচ্ছে ওরা। বিধানসভাতেও আইন পাশের ক্ষেত্রে ওরকম করে। এমনকি বিধায়ক নন এমন ব্যক্তিকেও সভাকক্ষে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়, তারপর আর বিধায়কেরা ঢুকতে পারেন না। এখন নতুন লড়াই। তবে জমির লড়াইও আছে। কেবল চম্পারণেই সাড়ে তিন লাখ একর খাস জমি আছে। বেগুসরাইয়ে একটি ১৭ হাজার একরের লেক ছিল যা এখন পাঁচ হাজার একরে নেমে এসেছে, বাকি ১২ হাজার একর কারা দখল করল তার জবাব নীতিশ কুমারকে দিতে হবে। আমার মা বাঙালি, ছোটবেলায় একটা কবিতা শুনেছি — হও ধরমেতে ধীর, হও করমেতে বীর, হও উন্নত শির নাহি ভয়। বাংলার প্রথম শত্রু বিজেপি, বিজেপিকে তাড়িয়ে দিন। মাইনরিটি মানে মুসলমান। ওরা মুসলমানদের ভাগাবে বলছে! চাকরির প্রতিশ্রুতি কোথায় গেল? আমরা যখন বিহারে ১০ লক্ষ চাকরির কথা বললাম তখন ওরা ব্যাঙ্গ করে বলল পয়সা কোথায়? তারপর ওরাই বলতে শুরু করল ১৯ লক্ষ চাকরি দেওয়ার কথা। এখন তো তা দিতে হবে। নইলে সরতে হবে। বাংলা থেকেই শিখেছি। এখানে বিজেপি চলবে না। ওরা যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে। সেই যুদ্ধ লড়তে হবে। আমরা শান্তির পক্ষে, কন্তু কেউ যুদ্ধ চাপিয়ে দিলে আমরাও সেই যুদ্ধ চালাব খেটে খাওয়া মানুষের অধিকার কেড়ে নেওয়ার জন্য।
কাজী কামাল নাসের দুটি গান শোনান। ফ্রিজে মাংস থাকার জন্য আখলাককে হত্যা করা হয়েছিল। সেই সময়ে লেখা একটি গান। ‘তোমার ইচ্ছে আমার অনিচ্ছে তল্লাশি নিচ্ছে যারা’ তাদের চিনে নেওয়া রুখে দেওয়ার গান। আরেক গানে চলমান কৃষক আন্দোলনকে সংহতি জানিয়ে ‘আমরা ফসল ফলাই বলেই সবার পাতে সবজি ভাত’… জানতে হলে সঙ্গে থাকো দাও বাড়িয়ে তোমার হাত। সমাবেশকে অভিনন্দিত করে কামাল নাসের লড়াইয়ের বার্তা শোনান। সমাবেশ তাঁকে সম্বর্ধিত করে।
শেষ ও প্রধান বক্তা সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য ভারত জুড়ে চলমান আন্দোলন, ভারত বন্ধ, ধর্মঘট সম্পর্কে বলেন, হঠাৎ করে এত আন্দোলন কেন তা ভাবতে হলে অন্যভাবে ভাবুন যে এত অন্যায় কেন? এত অন্যায় এত অত্যাচার কেন? কৃষকেরা তো সেই অর্ডিন্যান্সের সময় থেকেই বলছেন, কিন্তু সরকার কান দেয়নি, সেই অর্ডিনান্সগুলোকেই বিল হিসেবে এনে তারপর জোর করে সেগুলি আইনে পরিণত করল। এখন যখন কৃষক রাস্তায় তখন ওরা ক্ষতির কথা বলছে। একটা সরকার কৃষকদের আটকাতে রাস্তা খুঁড়ল। ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে ট্রাক্টর চালিয়ে এলেন কৃষকেরা। বিজেপি বলছে ওঁরা নাকি নকল কৃষক। আসল কৃষককি তাহলে আদানি আর আম্বানি? বলছে কৃষকেরা কৃষি আইন বোঝে না। পাঞ্জাব হরিয়ানার সবুজ বিপ্লবের কৃষকেরা না বুঝলে কি হাফ প্যান্ট পরে আরএসএস হয়ে বুঝতে হবে? বলছে শুধু পাঞ্জাব। এখন দেখা যাচ্ছে সারা দেশের কৃষকেরা পথে। বলছে শুধু কৃষক। কিন্তু ভারত বন্ধ করল সমস্ত রকম মানুষ। সরকার এখন পিছু হঠছে। গতকাল বৈঠকে আমাদের কৃষক নেতাও ছিলেন। সরকার বলছে সংশোধন করবে। বলছে মলাট একই থাকুক, ভেতরটা বদলান হবে। কৃষক বলেছে পুরো বইটাই জ্বালিয়ে দাও। ন্যায্য কথা বলছেন তাঁরা। এবং তাঁরা শুধু নিজের জন্য বলছেন এমন নয়। আমাদেরও সেটা বুঝতে হবে। তাঁরা আমাদের সকলের জন্যই বলছেন। আলু পেঁয়াজের দাম বাড়ছে কেন? তার পেছনেও ওই আইন। অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন সংশোধন করে চাল ডাল আলু পেঁয়াজ সহ খাদ্যদ্রব্য তালিকা থেকে বাদ দিয়েছে। এগুলো কি মানুষের বিলাসিতা? এসবের অত্যাবশ্যকীয় চাহিদা থাকবেই, যোগান দেওয়ার ক্ষমতা হাতে থাকবে আদানি আম্বানিদের। কৃষকের কাছ থেকে সস্তায় কিনে যত খুশি স্টক করে রাখবে, তারপর ইচ্ছেমতো দাম নিয়ন্ত্রণ করবে। কৃষকের সাথে আমরাও মরব। আমাদের টাকা যাবে আদানিদের পকেটে। গণবন্টন ব্যবস্থা উঠে যাবে। আদানিরা ব্যবসা করলে রেশন বলে আর কিছু থাকবে না। স্থায়ি দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি বিরাজ করবে, কিন্তু ওদের গোডাউন ভর্তিথাকবে। এত বড় চক্রান্ত করছে বিজেপি। বিজেপি বলছে দালালদের সরাতেই নাকি এই ব্যবস্থা করছে ওরা, আর বলছে দালালরাই নাকি আন্দোলন করছে! কৃষকেরা বলেছে, দালাল তো তোমরাই আদানি আম্বানির, এই দালাল সরকারকেই সরাতে হবে। কৃষক আন্দোলনের ভিত্তিতে যে সংগ্রামী ঐক্য গড়ে উঠছে তার থেকে ভালো কিছু গণতন্ত্রের জন্য আর কিছু হতে পারে না।
কমরেড দীপঙ্কর বিজেপির মিথ্যাচার ও বিপর্যয়কর রাজনীতিকে উন্মোচিত করেন। সংবিধানে যে প্রত্যেকের জন্য সমান নাগরিকত্বের অধিকার ছিল তা ধ্বংস করতে চায়। পশ্চিমবাংলার যে পারস্পরিক মিলমিশের সংস্কৃতি, নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধানের মাঝে মহান মিলন, যত মত তত পথের সহিষ্ণুতা — বাংলার মনন ও সংস্কৃতির সেই সুদীর্ঘ ইতিহাস স্মরণ করিয়ে তিনি বলেন যে বিজেপি-আরএসএস বাংলার বৌদ্ধিক জগতের সেই উদার ধারাকে ধ্বংস করে দিতে চায়। আমাদের ধর্ম ও ভালোবাসার অধিকার সংবিধান প্রদত্ত অধিকার। বিজেপি সরকার ধর্ম বেছে নেওয়ার অধিকারকে আঘাত করতে আইন বানাচ্ছে। হিন্দু মেয়েদের অধিকারের যে সুদীর্ঘ অর্জন তাকে ধ্বংস করতে আইন আনছে। হিন্দু নারী নিজের পছন্দে ভালোবাসতে পারবে না, বিয়ে করতে পারবে না। আজ বলছে ধর্মের বাইরে বিয়ে করতে পারবে না। কাল বলবে নিজের জাতের বাইরে বিয়ে করতে পারবে না। পরশু বলবে হিন্দু মেয়েরা ভালোবেসে বিয়ে করতে পারবে না। অন্য ধর্মে বিয়ে করলে উত্তর প্রদেশের বিজেপি বলছে ৫ বছর জেলে ঢোকাবে তো মধ্যপ্রদেশের বিজেপি সরকার বলছে ১০ বছরের জন্য জেলে পাঠাবে। বিজেপি মানেই আর্থিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক বিপর্যয়। বাংলার ছাত্র যুব সমাজকে এই বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রাচীর হয়ে রুখে দাঁড়াতে হবে। এরাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায় এলে তারপরই বিজেপির আসল রূপ মানুষ বুঝবে — এমন অসাড় তো বাংলার মানুষ এখনও হয়ে যায়নি। ঠেকেই শিখতে হবে এমনটা ভাবার মুর্খামি নয়, দেখেই তো শিখতে পারছে বাংলার মানুষ। রাজ্যে রাজ্যে বিজেপি সরকারগুলি এবং কেন্দ্রের বিজেপি সরকারকে দেখেই শিখতে হবে কোন বিপর্যয় বিজেপি আনতে চলেছে। বহু মানুষ বহুভাবে ওদের বিরুদ্ধে লড়ছেন। কেই কলম নিয়ে, কেউ ছবি এঁকে, কেউ ফেসবুক টুইটারে লিখে, কেউ মিছিল কেই জমায়েত কেউ মিটিং করে লড়ছেন। কিন্তু এই সবকিছুর সাথে সাথে কৃষক ও মেহনতি মানুষের সাতগে একাত্ম হওয়ার কাজ সকলকেই চালিয়ে যেতে হবে। চারু মজুমদার এক সময় ছাত্রযুবদের প্রতি এই আহ্বান রেখেছিলেন, আজ পাঞ্জাবের কৃষকেরাও সেই বার্তাই দিচ্ছে। শহরের ছাত্র যুবদের আবার সেই আহ্বানকে জীবন্ত করতে গ্রামে যেতে হবে, গ্রামে যেতে হবে কেবল মিটিং করতে নয়, কৃষক সাধারণের সাথে একাত্ম হতে। শ্লোগানে অঙ্গীকারে সমাবেশ শেষ হয়।