১২-১৩ ডিসেম্বর কলকাতার মৌলালী যুব কেন্দ্রে রাজ্য কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে পার্টির সাধারণ সম্পাদক কমরেড দীপঙ্কর ভট্টাচার্যও উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকের শুরুতে বিগত দিনে প্রয়াত কমরেডদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। বিশিষ্ঠ সাংস্কৃতিক কর্মী ও সংগঠক প্রবীর বল, নদীয়ার বর্ষীয়ান কমরেড রহিম সেখ, উত্তরবঙ্গের চা শ্রমিক বাঁধনা ওঁরাও, উত্তর ২৪ পরগণার সাংস্কৃতিক কর্মী অমিতাভ সরকার, বাঁকুড়ার প্রবীণ পার্টি কর্মী তরুণ প্রকাশ কুন্ডু, হুগলীর আদিবাসী নেতা বিশ্বনাথ সরেন, চুঁচুড়ার পার্টি কর্মী ভোলানাথ লাহিড়ী, হুগলীর কেতকী ব্যানার্জী, স্বপন বড়ুয়া, কলকাতার মিহির রায়চৌধুরী, মুর্শিদাবাদের মালেক সেখ, ময়নাগুড়ির কার্তিক রায়, দক্ষিণ ২৪ পরগণার উস্থি এলাকার হরেন মন্ডল, মাধবী হালদার, পথ দুর্ঘটনায় প্রয়াত বালীর ছাত্র কর্মী দীপন দাসের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়।
বৈঠকের শুরুতে চলমান কৃষক আন্দোলন সম্পর্কে সাধারণ সম্পাদক বক্তব্য রাখেন। যার মূল কয়েকটি দিক হল : এই কৃষক আন্দোলন মোদী সরকারকে প্রবল চাপের মুখে ফেলে দিয়েছে। সরকার আন্দোলনে বিভাজন সৃষ্টি করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে কিন্তু তাকে মোকাবিলা করেই আন্দোলন এগিয়ে চলেছে। আন্দোলনে সমাবেশিত বিভিন্ন ধরনের শক্তিগুলির মধ্যে বামপন্থীদের একটা ভালো অংশগ্রহণ রয়েছে। আমাদের পার্টির পাঞ্জাবের কমরেডরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছেন যার মধ্যে কৃষক নেতা ও এআইকেএম সভাপতি কমরেড রুলদু সিং একজন প্রতিষ্ঠিত ও সন্মানীয় নেতৃত্বের অবস্থানে রয়েছেন। এই দিকগুলিকে আমাদের প্রচারে নিয়ে যেতে হবে। এই আন্দোলনে এবং সারা দেশ জুড়ে সংগঠিত নানাবিধ কর্মসূচীতে বিভিন্ন শক্তির বড় মাত্রায় অংশগ্রহণ, সমর্থন ও সহানুভূতি গড়ে উঠেছে। শাহিনবাগ আন্দোলনে অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও যে ভীতির পরিবেশ ছিল, এখানে তার বিপরীতে দেখা যাচ্ছে এক উৎসবের মেজাজ। দেশের বুকে এক বিশাল গণআন্দোলন যা কর্পোরেট বিরোধী, বেসরকারীকরণ বিরোধী অভিমুখকে সামনে নিয়ে এসেছে। পশ্চিমবঙ্গে কয়েকটি জায়গায় ধারাবাহিক সংহতিমূলক অবস্থান শুরু করা যায় কিনা আমাদের সেই প্রচেষ্টা নিতে হবে।
এ রাজ্যে বিজেপিকে প্রধান বিপদ হিসাবে চিহ্নিত করে আমাদের বলিষ্ঠ রাজনৈতিক অবস্থান উদারনৈতিক বাম মহল সহ সমাজের বিভিন্ন অংশের মধ্যে ভালো মাত্রায় চর্চিত ও সমাদৃত হয়েছে। পশ্চিমবাংলার বুকে বিজেপির ফ্যাসিষ্ট আগ্রাসন সম্পর্কে রাজনৈতিক সংবেদনশীলতা (সেনসিটাইজেশন) বাড়িয়ে তোলা এবং সেটাকে প্রচারের আলোয় নিয়ে আসার লক্ষ্যে আমরা সচেষ্ট রয়েছি। বিহারে নির্বাচনী সাফল্যের প্রেক্ষাপটে এই ক্ষেত্রে আমরা বেশ খানিকটা সফল হয়েছি। এরাজ্যে আমাদের লক্ষ্য হল বিজেপির ভয়ংকর বিপর্যয়ের মোকাবিলায় জনগণের এক সার্বিক প্রতিরোধ সংগঠিত করা। এ জন্য আমরা বাংলায় জনগণের দাবিসনদ সূত্রবদ্ধ করব,তাকে জনপ্রিয় করে তুলব। এই লক্ষ্যে সমমনোভাবাপন্ন বিভিন্ন শক্তির সাথে মতামত বিনিময় বা গ্রহণ করার কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে। সিপিএম ও কংগ্রেসের যে সমঝোতা গড়ে উঠেছে তাতে কংগ্রেস সম্পূর্ণ প্রাধান্য বজায় রাখছে। বামপন্থার চরম দেউলিয়া অবস্থান থেকে সিপিএম আত্মসমর্পনের পথ গ্রহণ করেছে। এ রাজ্যের শাসক তৃণমূলকে প্রধান বিপদ রূপে চিহ্নিত করে ওরা বিজেপিকে সুবিধা করে দিচ্ছে। তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপিকে একই সারিতে (বন্ধনীতে) রাখার ভ্রান্ত অবস্থান গ্রহণ করেছে। বিগত দিনগুলিতে বাম ভোটের একটা বড় অংশ বিজেপিতে চলে যাওয়ার যে প্রবণতা এ রাজ্যের বুকে দেখা গেছে, তাকে বিপরীতমুখী করার আন্তরিক প্রচেষ্টাও তেমন লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
বামপন্থার এই ক্রমাবনতি বা অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে নিজেদের রাজনৈতিক পার্থক্য বজায় রেখে আমরা বাম-কংগ্রেস নির্বাচনী জোট থেকে সরে থাকছি। যদিও গণআন্দোলনের ময়দানে বামপন্থীদের যৌথ কার্যকলাপ আমরা অব্যাহত রাখব। নির্বাচনে বাছাই করা তুলনামূলক স্বল্প সংখ্যক আসনে আমরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করব। বিগত বিধানসভা নির্বাচনে সাধারণ ভাবে বামেদের জয়ী আসনগুলিতে (২৬টা) তাঁদের সমর্থন জানাব। বাম ঐক্যের একটা সংকেত বা বার্তা তুলে ধরতে সেই কেন্দ্রগুলিতে আমরা সাধারণভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা থেকে বিরত থাকব। কয়েকটি আসনে বন্ধু/আন্দোলনকারী শক্তিদের সমর্থন জানাব। স্বল্প সংখ্যায় হলেও আমাদের কিছু বন্ধু শক্তি রয়েছেন যারা বামপন্থী বা নীচুতলায় আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন তাদের সাথে নির্বাচনী বোঝাপড়া গড়ে তোলার প্রক্রিয়া চালাব। বাকি বড় সংখ্যক আসনগুলিতে আমরা “বিজেপিকে পরাস্ত করুন” আহ্বান জানিয়ে কার্যকরী বা সক্ষম এমন প্রার্থীদের ভোট দেওয়ার জন্য জনগণের কাছে আহ্বান জানাব। বিগত দিনে বামফ্রন্টকে সরিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের ক্ষমতায় আসাকে আমরা স্বাগত জানাইনি। তৃণমূল সরকারের জনবিরোধী নীতি, দুর্নীতি, দলবাজি, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আমাদের আন্দোলন চলছে। এ রাজ্যে বিজেপির বিরোধিতায় তৃণমূলের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা জোরালো করে তুলতে হবে। কিন্তু তৃণমূলকে অপসারিত করে ফ্যাসিষ্টরা ক্ষমতা দখল করতে উদ্যত। এই পরিবর্তিত পরিপ্রেক্ষিতকে আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে। পশ্চিমবাংলায় বাম পুনর্জাগরণ ঘটানো এবং ফ্যাসিস্টদের পরাজিত করা এই দুই কর্তব্য আমরা মেলাতে চাই। সব মিলিয়ে বলা যায় বামপন্থার সবচেয়ে আক্রমনাত্মক অবস্থান থেকে নিজেদের শক্তির বিকাশ ঘটানো, বামফ্রন্টের সাথে আংশিক বোঝাপড়া, আন্দোলনরত ও বাম বন্ধুশক্তির সাথে সমঝোতা গড়ে তোলা এবং বিজেপিকে পরাস্ত করা এই দিকগুলিকে সমন্বিত করে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।
দেশব্যাপী কৃষক আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এ রাজ্যের বুকে বিশেষত গ্রামাঞ্চলে কৃষক ও কৃষিমজুরদের মধ্যে প্রচার অভিযানকে একেবারে নীচুতলায় নিয়ে যেতে হবে। মোদী সরকারের নয়া কৃষি আইনের সর্বনাশা দিকগুলি সম্পর্কে এ রাজ্যের সাধারণ কৃষকদের মধ্যে বিরোধিতা দেখা যাচ্ছে, কিন্তু এই নির্দিষ্ট ইস্যুগুলিতে কৃষকদের আরও সচেতন করে তোলা ও তাঁদের সক্রিয়তা সৃষ্টি করার বিষয়টা বিভিন্ন স্তরের নেতৃত্বের অগ্রণী ভুমিকার উপর নির্ভর করছে। একে স্বতস্ফূর্ততার উপর ছেড়ে দিলে হবে না। বর্তমানে ফসলের ( বিশেষত ধানের) ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ও সরকারী সংগ্রহ ইস্যুতে এলাকা বা ব্লক স্তরে আন্দোলনমুখী উদ্যোগ নেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই আন্দোলনকে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার উভয়ের বিরুদ্ধেই পরিচালিত করতে হবে। আমাদের কৃষক সংগঠনের সক্রিয়তা বা কাঠামোগত যে দুর্বলতাগুলি রয়েছে তাকে কাটিয়ে তুলতে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে নামতে হবে। যে বিধানসভা কেন্দ্রগুলিতে আমরা প্রতিদ্বন্দ্বীতা করার কথা বিবেচনা করছি সেখানে নিবিড় অনুশীলনকে কেন্দ্রীভূত করতে হবে।
গরিব মেহনতি মানুষদের প্রতি বঞ্চনা-প্রতারণা ও সরকারী প্রকল্প রূপায়ণে চরম ব্যর্থতাকে আড়াল করতে তৃণমূল সরকার “দুয়ারে সরকার” নামক এক প্রকল্প শুরু করেছে। এগুলি যে জনগণের অধিকার, সরকারী অনুগ্রহ নয় বা একে দলীয় আনুগত্যর প্রশ্ন করে তোলা চলবে না – এই প্রচারকে আমাদের জোরের সাথে তুলে ধরতে হবে। এর পাশাপাশি “জনগণের কথা শুনুন, জনগণের দাবিগুলি তুলে ধরুন” বিষয়ক জনসংযোগ অভিযান শুরু করতে হবে। এই প্রচার অভিযানকে জনপ্রিয় রূপ দিতে হবে। প্রতিটি বিধানসভা কেন্দ্রে ন্যূনতম পাঁচটি জনগণের বৈঠক করে মানুষের কথা শুনতে হবে। আমাদের নির্বাচনী দাবিসনদ সূত্রবদ্ধ করতে এটি গুরুত্বপূর্ণ ও সহায়ক হয়ে উঠবে।
সাংস্কৃতিক ফ্রন্টে বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে পারস্পরিক কাজের ঐক্য গড়ে তোলার জন্য সকলকে আরও ধৈর্য্যশীলভাবে সচেষ্ট হওয়ার জন্য রাজ্য কমিটি আহ্বান জানাচ্ছে। ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক প্রতিরোধকে আরও শক্তিশালী করে তোলা, ব্যাপকতম প্রগতিশীল, বাম ও গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক ও বৌদ্ধিক ক্ষেত্রে কর্মরত শক্তি ও ব্যক্তিবর্গের সাথে ঐক্য গড়ে তোলা, ক্ষুরধার ও সমৃদ্ধ সৃজনকর্মের অনুশীলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, এবং ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আামাদের যা কিছু ইতিবাচক ঐতিহ্য তাকে হাতিয়ার করে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে।
ছাত্রফ্রন্টের আশাপ্রদ সক্রিয়তা বা অগ্রগতি লক্ষ করা যাচ্ছে। বিহারের বিধায়কদের নিয়ে এসে কলকাতায় অনুষ্ঠিত কর্মসূচী সফল করতে তারা খুবই ইতিবাচক ভুমিকা নিয়েছে। এ জন্য রাজ্য কমিটি ছাত্র কমরেডদের সংগ্রামী অভিনন্দন জানাচ্ছে। যুব সংগঠনও উদ্যোগ নিতে শুরু করেছে। আগামী ফেব্রুয়ারী মাসে তারা রাজ্য যুব সম্মেলন করবে বলে স্থির করেছে।# মিডডেমিল রন্ধনকর্মীদের প্রতি সীমাহীন বঞ্চনার বিরুদ্ধে আগামী জানুয়ারী মাসে কলকাতায় এক বৃহত্তর কর্মসূচী গ্রহণ করা হবে( সম্ভাব্য নবান্ন অভিযান) একে সফল করে তুলতে সমস্ত জেলা পার্টি কমিটিকে সহযোগিতা করতে হবে। (ঈষৎ সংক্ষেপিত)