হরিন্দার কৌর বিন্দুর গল্প দিয়েই শুরু করা যাক।গেরুয়া মিডিয়ার একটি লাগাতার প্রচার হল, কৃষক-আন্দোলন খালিস্তানি জঙ্গীদের দ্বারা পরিচালিত। তাঁরা হরিন্দর কৌর বিন্দুকে চেনেন না, এমন হতে পারে কি? কৃষক আন্দোলনের অগ্রণী নেতাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। অমন দুঁদে মহিলা নেতা হওয়ায় আরওই বেশি চোখে পড়েন। অবশ্য দেখেও না দেখার ভান করা যায়। এই হরিন্দর তাঁর বাবাকে হারিয়েছেন খালিস্তানিদের গুলিতে। তিনি বলেন, “কৃষকদের খালিস্তানি বলে অপমান করা পিতৃবিয়োগের থেকেও মর্মান্তিক। কেন অপপ্রচার করছেন? ইতিহাস পড়ে আসুন বরং।” বিন্দুর বাবা মেঘরাজ ভাতুয়ানা ছিলেন বামপন্থী এবং প্রবল খালিস্তান-বিরোধী। ১৩ বছর বয়সে বাবাকে হারিয়েছেন বিন্দু, তাই অপপ্রচারে আহত।
এতদিনে সকলেই জানে যে দেশের রাজধানীতে গণআন্দোলন চলছে। ২৬শে নভেম্বরের ভোর থেকেই রাজধানীর শীতযাপনের আলস্যকে চিরে ওয়াটার ক্যানন চলেছে। আছড়ে পড়ছে সেই বৃদ্ধ কৃষকের গায়ে যিনি অন্ন জোগান। টিয়ার গ্যাস সেই তরুণ চোখকে অন্ধ করছে যে চোখ চেনে উর্বরতার সম্ভাবনা। প্রথমে হরিয়ানা আর পাঞ্জাবের চাষিরা এসেছেন পায়ে হেঁটে, এসেছেন ট্রাক্টর চেপে৷ ব্যারিকেড ভেঙেছেন। তারপর যোগ দিয়েছেন উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্রের কৃষকরাও। টিকরি আর সিংঘু বর্ডারে ঘাঁটি গেড়েছেন তাঁরা। বুরারির নিরঙ্কারী মাঠের খোলা জেলখানায় তাঁরা যাননি।
অনেক আগে থেকেই তাঁরা প্রতিবাদ করে চলেছিলেন কৃষিবিলের বিরুদ্ধে। জুন মাস থেকেই সঙ্ঘবদ্ধ হচ্ছিলেন রাজ্যে রাজ্যে। সেসময় মূলধারার মিডিয়া ব্যস্ত ছিল সুশান্ত সিংহ রাজপুতের মৃত্যু নিয়ে। এরমধ্যেই বিল পাশ হয়ে অ্যাক্ট হল। রাজ্যে রাজ্যে কৃষকদের বোঝানো হল, এই অ্যাক্ট কৃষকদের ভালোর জন্য। কিন্তু তাঁরা মানলেন না। তাঁরা কর্পোরেট তোষণ ছাড়া আর কিছু পেলেন না অ্যাক্টে। হাজার মাইল সফর করে তাই তাঁরা দিল্লিতে।
কৃষি সংক্রান্ত অর্থনীতি বেশ জটিল। উত্তর ভারতের সুবিস্তৃত কৃষিজমিতে বড় চাষিদের উৎপাদন বেশি, নতুন আইনে ক্ষতিও বেশি। সরকারী মান্ডি তুলে দিলে কি কৃষকের লাভ হবে? মধ্যসত্ত্বভোগীদের অত্যাচারই যদি মাথাব্যথার কারণ হয়, তবে নতুন প্রথম আইন তো বরং কৃষকদের, বা যে কোনো ব্যক্তিকেই সরাসরি খোলাবাজারে নিজের শস্য বিক্রি করার অনুমতি দিচ্ছে৷ তাহলে অসুবিধে কোথায়? অসুবিধে হল এই যে প্রতি কৃষকের পক্ষে ভিনরাজ্যের পুঁজিপতির সঙ্গে মোলাকাত করা সম্ভব নয়। উপরন্তু খোলাবাজারে সকলেই সকলের প্রতিদ্বন্দী হয়ে উঠবে৷ তাতে দাম কমবে পণ্যের। মান্ডি কৃষক ও মধ্যসত্ত্বভোগীদের লাইসেন্স দিত, অর্থাৎ একটা নিয়ন্ত্রণ ছিল। মান্ডি ন্যূনতম দামও (MSP) নির্ধারণ করত। তাহলে মান্ডি উঠে গেলে ন্যূনতম দামও কি কৃষকরা পাবে? নাকি স্বামীনাথন কমিশন যে ন্যূনতম মূল্যের কথা বলেছিল, তার থেকে হাত তুলে নিচ্ছে সরকার (তৃতীয় কৃষি-আইন অনুসারে)?
ন্যূনতম দাম না পেয়ে চাষিরা চুক্তিচাষে ঝুঁকতে পারে। চুক্তিচাষ নিয়েই সরকারের দ্বিতীয় আইন। বৃহৎ কর্পরেট সেই দু’শ বছর আগের নীলকরদের মতো এসে চাষিকে বীজ ও অন্যান্য সামগ্রী এবং থোক টাকা ধরিয়ে বলবে, অমুক নয়, তমুক চাষ করতেই হবে। ধরা যাক, পোটাটো চিপ্স উৎপাদনে জড়িত সংস্থা গমের খেতে গমের সময়ে আলু চাষ করতে বাধ্য করবে। এই ধরনের চুক্তিচাষে চাষিরা আগ্রহী নয়। কারণ চুক্তি হওয়ার পর কোনো কারণে উৎপন্ন ফসল পছন্দ না হলে তা কিনতে বাধ্য নয়। কিংবা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে ফসল নষ্ট হলে সেই আর্থিক ক্ষতির দায় নিতে কোম্পানিগুলো বাধ্য নয়। সরকার বলছে, সেক্ষেত্রে ক্ষতির মূল্য পেতে চাষিরা আইনের সাহায্য নিতে পারে। কিন্তু আদানি-আম্বানির সঙ্গে আইনি লড়াই লড়ার জোর কৃষকের নেই।
আর প্রথম কৃষি আইনটির সঙ্গে সরাসরি সাধারণ মানুষও সম্পৃক্ত। খাদ্যশস্য ‘আবশ্যিক পণ্য’ ছিল। নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি মজুত করা যেত না। এখন করা যাবে। অর্থাৎ ব্যবসায়ী জোগান কমিয়ে যখন ইচ্ছে চাহিদা বাড়াবে, দাম বাড়াবে। কালোবাজারির সমূহ সম্ভাবনা। তাই এই জায়গায় এসে কৃষকদের আন্দোলন সাধারণ মানুষেরও আন্দোলন হয়ে যায়। সর্বোপরি, এই সব বিল পাশ করা হয়েছে কৃষকদের সঙ্গে, রাজ্যের সঙ্গে কোনো বার্তালাপ না করে, লকডাউনের সুযোগ নিয়ে, নিশ্চুপে। তার বিরুদ্ধেই এই আন্দোলন।
এই আন্দোলন আকাশ থেকে পড়েনি। এর পেছনে দীর্ঘদিনের পরিশ্রম আছে। মোদী সরকারের কৃষক-বিরোধী নীতি ২০১৪ সালের পর থেকেই পরিষ্কার হচ্ছে। আমাদের দেশে প্রতি ১২ মিনিট ৩৭ সেকেন্ডে একজন করে কৃষক আত্মহত্যা করেন। কোটি কোটি টাকার কর্পোরেট ঋণ মুকুব হলেও কৃষিঋণ আর মুকুব হয় না। তাই ২০১৬-১৭ সাল থেকেই দেশের সমস্ত কৃষক সংগঠনগুলি ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে। ২০১৭ সালে সারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ২৫০টি কৃষক সংগঠন ‘সমন্বয় কমিটি’ গঠন করে। এই সমন্বয় কমিটির মধ্যে ধনী কৃষকদের সংগঠনগুলি যেমন আছে, তেমনি বামপন্থী বা বাম-ঘেঁষা সংগঠনগুলিও আছে। গত ২৮শে সেপ্টেম্বর সমন্বয় কমিটির মিটিং-এ নভেম্বরের শেষে দিল্লী অভিযানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। দিল্লীর কাছাকাছি রাজ্যগুলি, যথা পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তর-প্রদেশ ইত্যাদি থেকেই মূল দিল্লী-অভিযানটি করা হবে, সেই সিদ্ধান্তও হয়। ‘সমন্বয় কমিটি’র মধ্যেও নানা টানাপোড়েন আছে। আছে ধনী কৃষকদের সংগঠনগুলি এবং বামেদের মধ্যে স্বার্থসংঘাত। কিন্তু ফসলের ন্যয্য দাম এবং মান্ডি বহাল রাখার দাবিতে তাঁরা এক ছাতার তলায় এসেছেন।
এই মুখবন্ধের পর আবার ফিরি হরিন্দরদের গল্পে। এইবার হরিন্দর শুধু খালিস্তানিদের হাতে নিহত কমিউনিস্ট নেতার মেয়ে নয়, ধরা দেবেন নিজেই এক দুঁদে কৃষক নেত্রী হিসেবে। হরিন্দর বিন্দু এই মুহূর্তে ভারতীয় কিষাণ ইউনিয়ন পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছেন, কারণ সেক্রেটারি অসুস্থ। আদতে তিনি উপাধ্যক্ষ। নিজের বারো বছরের ছেলেকে মায়ের জিম্মায় রেখে ইউনিয়নের সঙ্গে এসেছেন সিঙ্গল মাদার হরিন্দর। সিঙ্গল মাদার হরিন্দর নিজে পিতৃপরিবারে আশ্রিতা হিসেবে নয়, থাকেন পরিবারের মূল কৃষক ও জাঁদরেল কৃষিনেত্রী হিসেবে। কৃষিতে তাঁর ছোটবেলা থেকেই আগ্রহ। ত্রিশ বছর ধরে কৃষিকাজ করছেন।
ইতোপূর্বে তিনি সেই সব নারীদের দুই-আড়াই লাখ টাকা সরকারী ক্ষতিপূরণ জোগাড় করে দিয়েছেন, যাঁদের ছেলে/স্বামী আত্মহত্যা করেছেন। চোদ্দটি জেলার দশ হাজার মেয়ে স্বাভাবিক কারণেই এসেছেন তাঁর পিছু পিছু। সবার মাথায় হলুদ ওড়না। হলুদ-সবুজ ভারতীয় কিষাণ ইউনিয়নের পতাকার রঙ। বিন্দু মনে করেন, মেয়েদের আন্দোলনে ঝাঁপানোর এটাই উপযুক্ত সময়। উনুন জ্বলা বন্ধ হয়ে গেলে তাঁরা রাঁধবেন কী? সংসারকে খাওয়াবেন কী?
এই ক্ষণে পৌঁছে আমাদের চোখ ফেরাতেই হয় এযাবৎ অদৃশ্য এক শ্রমশক্তির দিকে। মহিলা কৃষকদের দিকে। মহিলা কৃষকেরা কৃষিকার্যে চিরকালই ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন। সারা পৃথিবীতে ৯০টি দেশে প্রায় ৪০ কোটি নারী কৃষিতেই যুক্ত। কিন্তু পিতৃতান্ত্রিকতার মায়োপিক দৃষ্টি তাদের দেখতে পায়নি। তাঁদের ক্যামেরা ধরে না বা খুব কম সময়েই ধরে। গুগলে ‘ফার্মার’ লিখে সার্চ করলে পুরুষ কৃষকের ছবি ভেসে ওঠে। চাষি বলতেই মানসচক্ষেও কি ফুটে ওঠে না এক পুরুষের ছবি? যে ছবিগুলি কৃষক আন্দোলনের এই খেপে শিল্পীরা আঁকছেন, সেখানেও তো সবাই পুরুষ! তেভাগা আন্দোলনে বঁটি-কাটারি হাতে মেয়েরা যতই ঝাঁপিয়ে পড়ুক, গান বাঁধা হয় ‘চাষিভাই’দের নিয়ে। সেই ঐতিহাসিক ভ্রান্তি থেকে শিক্ষা নিয়ে এইবেলা আরও বেশি করে মেয়েদের খোঁজা কি উচিত নয়? কৃষক ছেলের বিরাট লাফের ‘পুরুষোচিত’ ছবি খুবই নায়কসুলভ, কিন্তু তা তো সবটা নয়!
এই যে চাষিরা ফসলের সময় ক্ষেত ফেলে চলে এলেন, এখন ঘর আর ক্ষেত একসঙ্গে সামলাচ্ছে কে? মেয়েরা। প্রেমচন্দের ‘পুশ কি রাত’ যদি পড়ে থাকেন, জানবেন কীভাবে মুন্নিরা গরম জামা ছাড়া ক্ষেতে রাত জাগে। এই যে পুরুষ চাষিরা আত্মহত্যা করছেন বছরের পর বছর, কে সামলাচ্ছে পরিবার তারপর? মেয়েরা।
মেয়েরা অনেকে হাজার মাইল হেঁটে দিল্লিও এসেছেন৷ খবরে বলছে, তিন লাখ কৃষক এসেছেন দিল্লীতে ও দিল্লীর সীমানায়, যার মধ্যে সত্তর হাজার মহিলা কৃষক। র্যানলির ছেলেদের ছবি তুলছে ক্যামেরা, আর তাদের বউরা তখন ট্রাকের পিছনে ছাউনি খাটিয়ে রুটি সেঁকছেন। এই যে আলোচনায় এসে আন্দোলনের নেতারা সরকারী খাবার খেতে প্রত্যাখ্যান করে মাটিতে বসে নিজেদের সঙ্গে আনা খাবার খাচ্ছেন, তাতেও অদৃশ্য হাতগুলির শ্রম মিশে আছে।
এই মেয়েরা কিন্তু কৃষির বিভিন্ন ধাপেই হাত লাগান। জমিকে চাষের যোগ্য করে তোলা, বপণ, রোপণ, সার ও কীটনাশক ছড়ানো, শস্য কাটা, ঝাড়াই মাড়াই, সবেতেই তাঁরা যোগদান করেন। উপরন্তু কৃষি ও গেরস্তালি কাজ সামলাতে তাঁদের উদয়াস্ত পরিশ্রম করতে হয়। পুরুষেরা অবসরে হয়ত হুকা টানতে পারেন, মহিলারা সেসময়েও গবাদি পশুর যত্ন নেন, বা ঘুঁটে দেন। অথচ দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলনে তাঁদের স্বর ছিল অশ্রুত।
পরিসংখ্যান না দিলে বিষয়টার গুরুত্ব ঠিক বোঝা যাবে না। ভারতের উৎপাদনশীল যাবতীয় কর্মকাণ্ডে যত মেয়ে কাজ করেন, তার ৮০% কাজ করেন কৃষিক্ষেত্রে। ৩৩% ক্ষেতমজুর হলেন নারী। ৪৮% মেয়ে কাজ করেন পারিবারিক জমিতে। এই সবই অক্সফ্যামের ২০১৩ সালের পরিসংখ্যান।
কিন্তু জমির মালিকানা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁদের নয়। একই রিপোর্ট অনুসারে, জমির মালিকানা আছে মাত্র ১৩% মহিলার। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা বিহারে, সেখানে মাত্র ৭% মহিলার নিজস্ব জমি আছে। ২০১১ সেন্সাস দেখাচ্ছে ৩.৬০ কোটি মহিলা কৃষিকর্মী। কিন্তু তাঁদের ‘চাষি’ বলা হচ্ছে না। সেখানে রয়েছে কৃষি-জমির মালিকানার শর্ত। অথচ কৃষিক্ষেত্রে ওয়ার্ক ফোর্সের বেশিরভাগই ভূমিহীন দলিত ও আদিবাসী মহিলা, যাঁদের মধ্যে আবার অশিক্ষিতর সংখ্যাও ৭৫% এর বেশি।
২০১৭-১৮ সালের সমীক্ষা বলছে, কৃষিকার্যের সার্বিক অবনতির জন্য ছেলেদের শহরে পরিযান বেড়েছে এবং মহিলাদের কৃষিক্ষেত্রে যোগদানও বেড়েছে। বিহারে এই মুহূর্তে কৃষিকাজে নিযুক্ত মানুষের ৫০% নাকি মহিলা। ভারতের যাবতীয় খাদ্যশস্যের ৬০-৮০% মহিলাদের উৎপাদিত।
আবার ইউনিভার্সিটি অফ মেরিল্যান্ড আর ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ এপ্লায়েড ইকনমিক রিসার্চের ২০১৮ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, কৃষিশ্রমিকের ৪২% হলেন মহিলা, আর নিজস্ব জমি আছে মাত্র দু’শতাংশের।
হিন্দু ব্যক্তিগত আইন অনুযায়ী মেয়েরা পিতার সম্পত্তির অধিকারী, কিন্তু সামাজিক রীতি মেনে অধিকাংশই সেই অধিকার ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। মুসলমান আইন অনুসারে, কয়েকটি রাজ্য বাদে, মেয়েদের কৃষিজমিতে অধিকার স্বীকৃত নয়।
উত্তর-পশ্চিম ভারতে মেয়েরা বিয়ের পরেই পিতার বাড়ি ও জমি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বিধবারা তাঁদেরই ভায়ের বা শ্বশুরবাড়ির জমিতে জমিহীন কৃষিশ্রমিক হিসেবে কাজ করেন মহারাষ্ট্র বা রাজস্থানে।
জমির মালিকানা না থাকায় তাঁরা বীমা বা ঋণও পান না। ব্যাঙ্ক বা কো-অপারেটিভের সাহায্যও পাননা একই কারণে। অথচ কৃষিক্ষেত্রের সার্বিক উন্নতির জন্যই এই মহিলাদের কৃষকের স্বীকৃতি দেওয়া প্রয়োজন ছিল। রাষ্ট্রসংঘ বলে, মেয়েরা যদি নিজেদের জমির অধিকার পায় পূর্ণরূপে, তাহলে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নতিই হবে। খাদ্য ও কৃষি সংগঠন (FAO) ২০১১ সালে বলেছিল, মেয়েরা জমির অধিকার পেলে ফলনও ২.৫-৪% বাড়বে। পৃথিবীজুড়ে ক্ষুধা কমবে ১২-১৭%।
এই মেয়েরা যেভাবে নুয়ে কাজ করেন, তাতে কম বয়সেই পায়ের, ঘাড়ের, হাতের নানা ধরনের সমস্যায় ভোগেন। অনেকের গর্ভপাত হয়ে যায়, অনেকের সময়ের আগে শিশু ভূমিষ্ঠ হয়ে যায় অতিপরিশ্রমে। অজ্ঞতার কারণে এমন কিছু কীটনাশকও তাঁরা ব্যবহার করে ফ্যালেন, যা স্বাস্থ্যের পক্ষে বিষবৎ। উচ্চ-মানের চাষের যন্ত্রপাতি যা কিছু আছে, তা কিন্তু মূলত ছেলেদের কথা ভেবেই বানানো। তাই সেগুলি ব্যবহার করতেও মেয়েদের বেগ পেতে হয়।
আমরা ক’জন জানি ১৫ অক্টোবর জাতীয় মহিলা কৃষক দিবস? সংবিধানের ১৪ ধারায় লিঙ্গ নির্বিশেষে সমানতার কথা বলা হয়েছে। কৃষিক্ষেত্রে তার অবমাননা অন্যান্য পেশার চেয়ে বেশি৷ কৃষিশ্রমিক হিসেবে কর্মরত মেয়েরা পুরুষদের থেকে কম মজুরি পান। নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রক ২০১৬ সালের জাতীয় নারী নীতি অনুসারে মেয়েদের জমির অধিকার দেওয়ার গুরুত্ব স্বীকার করে নেয়। কিন্তু তাতে কাজের কাজ কিছুই হয় না।
বীণা অগরওয়াল ‘Who Sows Who Reaps’ (কে বোনে আর কে তোলে) বইতে ১৯৯৩ সালেই বলেন, মেয়েদের ভূমি-অধিকারের পথে অনেক বাধা। বাপের বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়ির দূরত্ব, স্বাধীন যাতায়াতে বাধা, বাপের বাড়ির চাপে জমি ভাইকে দিতে বাধ্য হওয়া, সামাজিক লিঙ্গভূমিকা পালন করতে গিয়ে নিজের জমির অধিকার হারানো, অশিক্ষা, অজ্ঞতা, আইনি দরবারে পুরুষের প্রতিপত্তি ইত্যাদি সেইসব বাধার কয়েকটি। মেয়েরা পুরুষ অভিভাবকদের অবাধ্য হতে চায় না৷ দলিলপত্রও সঠিক ভাবে সংরক্ষিতও হয় না, যে তা সম্বল করে আইনি লড়াই করবে। আবার খাতায় কলমে মালিকানা থাকলেও অনেক সময় জমির নিয়ন্ত্রণ মেয়েদের হাতে থাকে না।
চাষিদের আত্মহত্যার কথা বলা হয়, কিন্তু ২০১৪-১৫ সালের NCRB ডেটা অনুসারে যে ৮০০৭ জন আত্মহননকারীদের মধ্যে নিজস্ব জমিওয়ালা ৪৪১ জন মেয়েও ছিলেন, আর ৫৭৭ জন মহিলা কৃষিশ্রমিক ছিলেন, তা এড়িয়ে যাওয়া হয়। ‘মহিলা কিষাণ অধিকার মঞ্চ’ বা ‘মকাম’ ২০১৮ সালে দেখায়, ২০১২-২০১৮ পর্যন্ত বিদর্ভ ও মারাথওয়াড়ার যে সব কৃষকরা আত্মহত্যা করেছেন, তাঁদের বিধবা স্ত্রীদের ৪০% এখনও জমির অধিকার পাননি। মাত্র ৩৫% নিজেদের বাড়িতে থাকার জায়গা পেয়েছেন। ৩৩% বিধবা জানেনই না যে তাঁদের পেনশনের অধিকার আছে। এই মহিলারা কিন্তু নিজেদের বেশ কিছু দাবিদাওয়াকে এই মুহূর্তে পাঠিয়েছেন পিছনের সারিতে। যেমন, যাঁদের স্বামী আত্মহত্যা করেছেন, তিনিও এখন ক্ষতিপূরণের বদলে চাইছেন বিল প্রত্যাহার। দিল্লির আন্দোলনে তাঁদের যোগদান প্রথমবারের জন্য ভারতে মহিলা-কৃষকদের জনসমক্ষে উগ্রভাবে দৃশ্যমান করে তুলল।
অবশ্য আগেও তাঁদের কেউ কেউ দিল্লীতে এসেছিলেন ২০১৮ সালের জুলাইতে। মান্ডি হাউস থেকে পার্লামেন্ট স্ট্রিট পর্যন্ত ছিল কৃষক মার্চ। কিন্তু তাঁরা তখন সংখ্যায় কম ছিলেন। সেবার মেধা পাটেকর ঘোষণা করেছিলেন, কৃষি সর্বতোভাবে মেয়েদেরও বিষয়। উত্তরপ্রদেশ ও পাঞ্জাবের মহিলা-কৃষক দিল্লীর রাস্তায় প্রকাশ্যে বলেছিলেন, কীভাবে ট্রাক্টর চালানোর জন্য স্থানীয় গুণ্ডাদের টিটকরি শুনতে হয়। কীভাবে মান্ডিতে মহিলা কৃষক অস্বস্তিতে পড়েন। ২০২০ সালে তাঁরা সংখ্যায় অনেক বেশি।কিছু কৃষক সংগঠন বলছে, তারা ২০০০ সাল থেকেই একটু একটু করে সংগঠিত করছে মেয়েদের। এখন স্বতন্ত্র মহিলা শাখা আছে তাদের। পিতা বা স্বামীর আত্মহত্যার পর অনেক বাড়িই এখন পুরুষশূন্য। দারিদ্র ও ঋণগ্রস্ত সেই সব পরিবারের দায়িত্ব নিয়েছেন মেয়েরা৷ সংগঠনে তাঁরা যুক্ত হয়েছেন নিজেদের দাবিদাওয়া নিয়ে। যেমন ভারতীয় কিষাণ ইউনিয়ন (একতা উগ্রাহণ)-এর ৪০% সদস্যই মহিলা।
জানা গেল পাঞ্জাবের মানসা জেলায় দলিত মহিলারাই রাস্তা আটকে, পুলিশের মার খেয়ে প্রথম জমি অধিগ্রহণে বাধা দিয়েছেন দৃঢ়ভাবে। পরে সেই আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিল ইউনিয়নগুলি। দলিত নারীরা আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার পর জাট পুরুষের দ্বারা যৌন নিগ্রহের ঘটনার খবরও আসতে লাগল ইউনিয়নে। এভাবে কৃষক ইউনিয়ন মেয়েদের যৌন নিগ্রহ নিয়েও সরব হয়েছে প্রয়োজনে। দিল্লীর ঘটমান আন্দোলনে ছাত্রদের, শিক্ষকদের, যুক্তিবাদী নাগরিক সমাজের মতো মেয়েদের, বিশেষ করে দলিত মেয়েদের অংশগ্রহণও আজ প্রণিধানযোগ্য।
সত্তর বছরের সখবিন্দর কৌর এসেছেন জমি ফেলে। এসেছেন বাহাত্তুরে লাভ কৌরও, পুত্র-পুত্রবধূদের সাথে। সকলেই বলছেন, কাফন বেঁধে এসেছেন, দাবি না মানা হলে মরতেও তাঁরা তৈরি। পরমজিৎ কওর বলেন, গ্রামে থাকার সময়েও কৃষক ইউনিয়নের কাজে গ্রামের মেয়েদের একত্রিত করতে ঘুরে বেড়াতে হত তাঁকে। স্বামী প্রান্তিক কৃষক, তিনি ঘর ও ছেলে সামলাতেন। তাঁর মৃত্যুর পরও হকের লড়াই চালাচ্ছেন পরমজিৎ। পাঞ্জাব কিষাণ ইউনিয়নের জসবীর কওর ষাট বছরেও ইউনিয়নে হিসেব রাখা, শৃঙখলা বজায় রাখার দায়িত্ব নিয়ে ব্যস্ত। একাশির বলবিন্দর কৌর একাই এসেছেন। তিনিও এক প্রভাবশালী সংগঠক। বারবার মেয়ে ও ছেলের ফোন আসছে। তিনি বিরক্তই হচ্ছেন তাতে।
উত্তরপ্রদেশের ফৈজারপুর থেকে ছ’মাসের শিশু কোলে এসেছেন সাঁইত্রিশের মমতা। বলছেন, “এই শিশুর ভবিষ্যতের জন্যই এই আন্দোলন।” সপরিবারে এসেছেন রাধা। স্বামী ও তিন সন্তান সহ। তাঁরা টয়লেট পাচ্ছেন না৷ পাচ্ছেন না জামা বদলের জায়গা। শীতে কাঁপছেন। প্রতিবেশী রাজ্য থেকে আসা অচেনা চাষি কম্বল এগিয়ে দিচ্ছেন। স্থানীয় দোকান, হোটেল ও বাড়িগুলি তাঁদের বাথরুম ব্যবহার করতে দিচ্ছে। এঁরা অনেকেই এর আগে শহরে আসেননি। কেউ কেউ এর আগে শহরের হাসপাতালে গেছেন শুধু বাচ্চা বিয়োতে।
ভারতীয় কিষাণ ইউনিয়নের পুরুষ নেতা হরিন্দর সিং লাখওয়াল বলছেন, “দের ছাড়া আমরা অচল। পাঞ্জাবেও যখন আন্দোলন চলছিল, তখনও এই মেয়েরাই ছিলেন আন্দোলনেত মেরুদণ্ড। আজ এরা দিল্লীতেও এসেছেন। আন্দোলন এদের কাছে কৃতজ্ঞ।”
এই মেয়েরা আজ নির্দ্বিধায় ট্রাকটরে ঘুমোচ্ছেন। সকালে উঠে খাবার বানাচ্ছেন, দুপুর গড়িয়ে বিকেল পর্যন্ত শুনছে কৃষক নেতাদের স্লোগান। সন্ধে নামলে ট্রাক্টরের আড়ালে গিয়ে আবার খাবার বানাচ্ছেন।
কিন্তু তাঁরা বুঝিয়ে দিচ্ছেন, শুধু পুরুষ কৃষকের রুটি সেঁকতে তাঁরা আসেননি। এসেছেন তিনটি বিল পড়ে, তিনটি বিল প্রত্যাহারের দাবি নিয়েই। আমাদের চোখ এতে অভ্যস্ত হোক। লিঙ্গসাম্যের এক শিক্ষাক্ষেত্র হয়ে উঠছে আজকের কৃষক আন্দোলন। তাই মেয়েরা যখন স্লোগানিয়ারিং করছে, তখন আবার খাবার বানানোর কাজে হাত লাগাচ্ছেন পুরুষেরাও। তরুণীরা তরুণদের সঙ্গে নাচে মেতে উঠছে। যে নাচ জীবনের উদযাপন।
অন্য দিকে, মীরাটের ঘেশপুরের ২৩ বর্ষীয়া নিশু চৌধুরিকে স্নাতকোত্তরের পড়া করতে করতে খেত সামলাতে হচ্ছে, কারণ পুরুষেরা গেছে দিল্লীর আন্দোলনে। “এ হল ধান আর আখ কাটার সময়, গমের বীজ বপণের সময়৷ এ সময় খেতের কাজ তো ফেলে রাখা যায় না,” ঘেশপুরের প্রতিবেশী গ্রাম দাউরুলার মুকেশ দেবী বলছেন। অর্থাৎ পুরুষের অবর্তমানে কৃষিকাজ থমকে যেতে দেয়নি মেয়েরা।
আদিমকালে ফসল ফলানোর রহস্য নাকি ছিল নারীরই করায়ত্ত। পুরুষ যখন শিকারে যেত, নারী তখন মাটি আর বীজ নিয়ে নাকি চালাত উর্বরতার নিরীক্ষা। এভাবেই কৃষি শুরু হয়। অথচ ক্রমে নারীই হারিয়ে ফেলে জমির অধিকার, নেতৃত্বের অধিকার। কৃষক আন্দোলনের এই পর্যায়ে, একবিংশ শতকে, অন্তত আদি মাতার সেই মেয়েদের কথা কোনো ইতিহাস মুছে ফেলতে যেন না পারে।
- শতাব্দী দাশ