প্রতিবেদন
‘লাভ জিহাদ’ কানুনগুলি পিতৃতান্ত্রিক ঘৃণার হাতিয়ার
love

২০২০ সালের উত্তর প্রদেশের বেআইনি ‘ধর্ম পরিবর্তন বিরোধী রায়’, যাকে মহিলাদের ‘লাভ জিহাদ’ থেকে রক্ষা করার পন্থা হিসেবে দাবি করা হচ্ছে, তা আসলে মহিলাদের স্বাধিকার ও ইচ্ছার ওপর এক ভয়ানক আক্রমণ। এই রায় এবং অনুরূপ আরও বেশ কিছু রায় যা উত্তরাখণ্ডে রয়েছে এবং অন্যান্য বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতেও আসতে চলেছে, সেগুলি হিন্দু মহিলাদেরকে হিন্দু সম্প্রদায়ের নিছক সম্পত্তি হিসেবে দেখে, স্বাধিকারসম্পন্ন ব্যক্তি হিসেবে নয়।

এই রায়ের সাহায্যে উত্তর প্রদেশ পুলিশ একের পর এক যেসমস্ত কেস ফাইল করেছে, তার প্রত্যেকটিতে দেখা যায় কিভাবে সংঘী গুণ্ডা আর পুলিশের আঁতাতে হিন্দু মহিলাদেরকে তাদের মুসলিম সাথিদের থেকে বলপূর্বক আলাদা রাখা হয়েছে। প্রায় সব ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, এই মহিলারা স্বেচ্ছায় এই সাথীদের ভালোবেসেছেন এবং বিয়ে করেছেন, কিন্তু তাঁদের পরিবার এই সংঘী গুণ্ডাদের প্ররোচনায় মামলাগুলি রুজু করেছে। একটি ঘটনায় দেখা গেছে, পাত্রপাত্রী উভয় পক্ষের পরিবারের অনুমতি থাকা সত্ত্বেও এই গুণ্ডা-পুলিশের মেলবন্ধনে একটি বিয়ের অনুষ্ঠান বলপূর্বক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

অন্তর্ধর্মীয় দম্পতিদের আক্রমণকারী এই অশ্লীলভাষী গুণ্ডাদলের সাহসবৃদ্ধির অন্যতম কারণ, তাদের মত এক ব্যক্তিই উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী। উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী এই রায় আনার সময়েই হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন, “যারা লাভ জিহাদ করছে তারা যেন নিজেদের শেষ যাত্রার জন্য তৈরী থাকে”। এই রায়ের প্রথম শিকার মোরাদাবাদের এক কমবয়সী অন্তর্ধর্মীয় দম্পতির অনাগত সন্তান। একজন অন্তঃসত্ত্বা মহিলাকে তার স্বামীর থেকে বলপুর্বক আলাদা করে একটি “আশ্রয়স্থান”-এ রাখা হয় এবং সরকারি হাসপাতালে জোর করে তাঁর গর্ভপাত করানো হয়। তাঁর জীবন, তাঁর স্বাস্থ্য এবং ভবিষ্যতে তার সন্তানধারণের ক্ষমতাকে সংশয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে সেই ডাক্তাররা, যারা তাঁর ইউটেরাসের সংক্রমণ আটকানোর জন্য প্রয়োজনীয় আয়ন্টিবায়োটিকগুলি দেয়নি।

মোরাদাবাদের ঘটনা আইনের “অপপ্রয়োগের” ঘটনামাত্র নয়। এই আইন তৈরি করাই হয়েছে প্রাপ্তবয়স্ক মহিলাদের ইচ্ছাকে বাতিল ও অগ্রাহ্য করার জন্য কারণ এই আইনানুসারে মহিলার পরিবার মহিলাটির ইচ্ছা ব্যতিরেকেই অভিযোগ দায়ের করতে পারে।

উত্তর প্রদেশের এই রায় মনুস্মৃতির অন্তর্বর্ণ বিবাহের নিষিদ্ধকরণ, নাৎসি জার্মানির আন্ত-জাতীয় বিবাহের অপরাধীকরণ এবং আমেরিকা ও দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবিদ্বেষের দ্বারা অনুপ্রাণিত।

বহু মানুষ এলাহাবাদ হাই কোর্টে ভালোবাসা-বিরোধী এই রায়ের বিপক্ষে আপীল করেছেন এবং আমরা অবশ্যই আশাবাদী যে শেষ পর্যন্ত এই রায়কে খারিজ করা সম্ভব হবে। সাম্প্রতিককালে বহু আদালতই প্রাপ্তবয়স্ক মহিলাদের নিজের পছন্দমতো ভালোবাসা ও বিয়ের অধিকারের সপক্ষে রায় দিয়েছে। কিন্তু বারংবার এই অধিকারের স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য কোর্টের দ্বারস্থ হওয়ার প্রয়োজনই প্রমাণ করে দেয়, সাম্প্রতিককালে এই মৌলিক অধিকারের অবস্থা কতটা ভঙ্গুর।  ভালোবাসা-বিরোধী এই আইনগুলি কাজে লাগিয়ে ভারতবর্ষের ক্ষমতাসীন দল ইতিমধ্যেই ভঙ্গুর এই অধিকারের শ্বাসরোধ করার চেষ্টা করে চলেছে।

বিজেপি এমন ভারত তৈরি করতে চায় যা ভালোবাসাকে ঘৃণা করে ও ঘৃণাকে ভালোবাসে। ভারতের মানুষের লড়াই ঠিক করবে বিজেপি এটা চালিয়ে যেতে পারবে কিনা। প্রত্যেক দম্পতির ভালোবাসার অধিকারের সপক্ষে উঠে দাঁড়াতে হবে আমাদের, ঘৃণা ও ভেদাভেদের বিপক্ষে। ভালোবাসা-বিরোধী এই আইনগুলিকে পদে পদে অস্বীকার করতে হবে, প্রতিহত করতে হবে এবং দাবি করতে হবে যাতে তারা খারিজ হয় এবং তালাবন্দি হয়ে পড়ে থাকে চিরকালের জন্য। বিশেষ বিবাহ আইনেও পরিবর্তনের দাবি করতে হবে যাতে এই আইনের যে জায়গাগুলি পিতৃতান্ত্রিক আগ্রাসনকে সুবিধা করে দেয় বা দম্পতির বিয়ে করার নিজস্ব অধিকারে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের সুযোগ দেয় সেইসব জায়গাগুলি পরিবর্তন ঘটে।  

আন্তঃবর্ণ দম্পতিদের ওপর হিন্দু আধিপত্যবাদী গুণ্ডাদের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধেও একজোট হতে হবে। আমাদের দাবি করতে হবে যেকোনো সরকারী কর্মচারী যদি এই গুণ্ডাদের দালাল হিসেবে কাজ করে বা আগামী কোনো বিয়ের ব্যাপারে এই গুণ্ডাদলগুলিকে খবরের জোগান দেয়, তাহলে তাকে চাকরি থেকে বহিষ্কার করা হবে এবং তার বিরূদ্ধে মামলা করা হবে। ধর্ম পরিবর্তনের অধিকার বিরুদ্ধ সব আইনকে খারিজ করার দাবি করতে হবে। মহিলারা কাকে বিয়ে করবেন তা ঠিক করার অধিকার হবে শুধুমাত্র তার নিজের এবং নিপীড়িত সম্প্রদায়গুলিকে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ ব্যতিরেকে নিজেদের ধর্মাচরণ বেছে নেওয়ার অধিকার দিতে হবে।

সিএএ, ভালোবাসা-বিরোধী  কানুন, তিনটি কৃষি-কানুন,  শ্রম-কোড কানুন এই সবক’টির আসল উদ্দেশ্য বহু কষ্টার্জিত সাংবিধানিক অধিকার ও স্বাধীনতার শ্বাসরোধ এবং স্বৈরাচারী কর্পোরেটমুখী হিন্দুরাষ্ট্রের কাঠামো তৈরি করা যেখানে মজদুর, কৃষক, মহিলা, দলিত ও অল্পসংখ্যকেরা সবাই পরাধীন বস্তুমাত্র হয়ে থাকবে, স্বাধীন অধিকারসম্পন্ন নাগরিক হয়ে নয়। সংবিধানবিরোধী এই আইনগুলির বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে আমাদের। লড়তে হবে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সাম্য এবং ভারতের প্রতিটি মানুষের স্বাধীনতার জন্য।

খণ্ড-27
সংখ্যা-46