গত ২০ ডিসেম্বর, ২০২০-তে বাঙালী জনজীবন এক নতুনতর দৃশ্য প্রত্যক্ষ করলো। ভারত সরকারের প্রধান মহামাত্য পরিদর্শন করলেন রবীন্দ্রনাথের অমর কীর্তি বিশ্বভারতী। মেদিনীপুরে শুভেন্দু-বিজয় পর্ব শেষ করেই ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ আসন্ন বঙ্গবিজয় সম্পূর্ণ করার তাগিদে পা রাখলেন বিশ্বভারতীতে। চারিদিকে, ‘উপরে অমিত শাহ মুখ্য, নীচে রবীন্দ্রনাথ গৌন’ পোস্টারে ভরিয়ে দেয়া হল। গুজরাট-উত্তরপ্রদেশ-দিল্লী দাঙ্গার মন্ত্রণাদাতা, বাঙলাকে ১৯৪৭-এর পর এনআরসি করে আবার উদ্বাস্তু করার চক্রান্তের মহানায়ক, আদানি-আম্বানি কোম্পানিরাজের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মহামাত্য অমিত শাহ বীরদর্পে প্রবেশ করলেন “যত্র বিশ্ব ভবত্যেক নীড়ম” অর্থাৎ “যেখানে বিশ্ব হবে এক নীড়” সেই রবীন্দ্র সৃষ্ট বিশ্বভ্রাতৃত্বর মহা আলয়ে। এই উল্টোপুরাণের যাত্রাপথে ফুল ছড়ানোর লোকের অভাব ঘটেনি, কারণ বিশ্বভারতীর এখনকার উপাচার্য নিজেই অমিত শাহর গুরুদেব, হিন্দুরাজ্য স্থাপনের উদগাতা দামোদর বিনায়ক সাভারকারের গুণগ্রাহী, একজন গেরুয়াধারী রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক। অমিত শাহ, নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি এখন বাংলার আসন্ন নির্বাচনে বঙ্গ-বিজয়ের ছক কষছে। সেই কারণেই বাংলার বহুধা বিচিত্র মননকে ছদ্ম-তুষ্টিবিধানের জন্য ‘মন কি বাতে’তে নরেন্দ্র মোদী অদ্ভুতুড়ে বাংলায় রবীন্দ্র কবিতা পড়ছেন, বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জে পি নাড্ডা রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে কিছুই অবগত নন তবু তাকে বলতে হচ্ছে ‘শান্তিনিকেতন রবীন্দ্রনাথের জন্মভূমি’; অমিত শাহকেও আসতে হচ্ছে শান্তিনিকেতনে, বলতে হচ্ছে ‘ছুটি পেলে সাতদিন রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে সময় কাটাবেন’ (সূত্র-আনন্দবাজার, ২১ ডিসেম্বর, ২০২০)। কি গান শুনবেন উনি? “বহে নিরন্তর অনন্ত আনন্দধারা”? দিল্লির উপকণ্ঠে কৃষকেরা এই ভয়ংকর শীতে চার সপ্তাহের উপর বসে আছে অন্যায্য কৃষি বিল বাতিলের দাবিতে। নয় নয় করে ৩০ এর অধিক কৃষক, আন্দোলন করতে গিয়ে প্রবাসে শহীদ হয়েছেন কঠিন সরকারী উদাসীনতায়। তোমাদের একটুও তাপ উত্তাপ নেই। বরঞ্চ শান্তিপূর্ণ আন্দোলনরত কৃষকদের নামে সরকারের তরফ থেকে নিরন্তর কুৎসা রটাচ্ছ। খাদ্যের যোগানদার অন্নদাতাদের বলছ ‘গদ্দার’। নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার জন্য ভেক ধরেছো হে দাঙ্গাবাজ বৈষ্ণব! রবীন্দ্র গানের সুপ্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্য প্রসূত ‘বসুধেব কুটুম্বকম’ কিংবা ‘আনন্দধেব খল্বিমানি ভূতানি জয়ন্তী’ সদৃশ অনুভূতিবোধ তোমাদের জন্য নয়। “বিবিধের মাঝে মিলন মহান”-এর যে মহাস্বপ্ন রবীন্দ্রনাথ দেখেছিলেন, তোমরা আজ সেই অনন্ত প্রাণ সত্ত্বাকে ভাঙতে উদ্যত। তোমরা এখন ব্যস্ত বাংলায় তোমাদের ছাপ মারা ভন্ড কৃষক, বাসুদেব দাস বাউলদের মতো সত্যি বাউলধর্ম ভুলে যাওয়া শিল্পীদের ঘরে ভাত খেয়ে মেকি আউল-বাউল-কৃষক প্রেম দেখাতে। আজ কৃষক হত্যার রক্ত হাতে নিয়ে তোমরা বিরোধী দলের তথাকথিত কৃষক(!) নেতাকে ভাঙ্গিয়ে আগামী বাংলা বিজয়ের মোচ্ছব করছ। এক দিক থেকে ভালোই হোলো। নন্দীগ্রামের সরল কৃষক জনগণ আজ বুঝতে পারবে এই ভন্ড রংবেরং-এর ক্ষমতালোভী নায়করা, আর তার দিল্লির প্রভুরা কোনোদিনই তাদের বন্ধু ছিল না। ওদিকে শান্তিনিকেতনে বহিস্থ জনগণের অর্থাৎ ‘শোনপাংশু’দের প্রবেশ রোখার জন্য উঠছে অভ্রভেদী প্রাচীর। কবিগুরুর আদর্শকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে নতুন করে নয়া হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শে গড়ে উঠছে ‘অচলায়তন’। আজকের ‘মহাপঞ্চক’রা ছাত্রাবাসের দরজায় দরজায় বসাচ্ছে পাহারা। অমিত শাহর পরিদর্শন পর্বেই তা স্পষ্ট দেখা গেল। উত্তর-দক্ষিণের সমস্ত জানলা বন্ধ করে দিয়ে শান্তিনিকেতনের আকাশে বাতাসে আজ রবীন্দ্র গান চাপা পড়ে গেছে “ওঁ তট তট তোতয় তোতয় স্ফট স্ফট স্ফোটয় স্ফোটয় ঘুণ ঘুণ ঘুণপায় ঘুণপায় স্বর বসত্ত্বানি”র অচলায়তন-সদৃশ অদ্ভূত মন্ত্রে।
আসল কথা নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহদের চিন্তা চেতনায় হিন্দুত্ববাদী ভারতবর্ষর সাথে রবীন্দ্রনাথের ভারতবর্ষের ধারণার কোনো মিল নেই, অমিল সর্বব্যাপী। তাদের গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ নয়, তাদের গুরুদেব মাধবরাও সদাশিবরাও গোলয়ালকর; আরএসএস-এর দ্বিতীয় সরসংঘচালক। জাতিরাষ্ট্র সম্পর্কে তার ধারণাই মোদী-অমিত শাহর বিজেপি আজকের ভারতে ছলেবলে কৌশলে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। গোলওয়ালকর বলেছিলেন হিন্দুত্বের সঙ্গে যা কিছু সম্পর্কিত, একমাত্র সেটাই জাতীয়। যারা হৃদয় দিয়ে হিন্দু জাতির উন্নতির কথা ভাবে, তারাই কেবল দেশপ্রেমী। বাকিরা হয় বিশ্বাসঘাতক নয় শত্রু।আজকের বিজেপি চালিত ভারতবর্ষে এই ধারণারই প্রায়োগিক রূপ দেখা যায় অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে; উচ্চ ন্যায়ালয়কে কাজে লাগিয়ে, সাংবিধানিক ধর্মনিরপেক্ষতাকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ প্রদর্শণ করে রামমন্দির নির্মানে; গোরক্ষার নামে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রবহির্ভূত সন্ত্রাসের বাতাবরণে; লাভ জিহাদের কাল্পনিক জিগির তুলে সংখ্যালঘু দমনের কূটকৌশলে, ইত্যাদি ইত্যাদি।
রবীন্দ্রনাথের ধারণা এই দৃষ্টিভঙ্গী থেকে অনেক দূরে। “ভারতবর্ষের প্রধান সার্থকতা কী, এ কথার স্পষ্ট উত্তর যদি কেহ জিজ্ঞাসা করেন সে উত্তর আছে; ভারতবর্ষের ইতিহাস সেই উত্তরকেই সমর্থন করিবে। ভারতবর্ষের চিরদিনই একমাত্র চেষ্টা দেখিতেছি প্রভেদের মধ্যে ঐক্যস্থাপন করা, নানা পথকে একই লক্ষ্যের অভিমুখীন করিয়া দেওয়া এবং বহুর মধ্যে এককে নিঃসংশয়রূপে অন্তরতররূপে উপলব্ধি করা- বাহিরে যে সকল পার্থক্য প্রতীয়মান হয় তাহাকে নষ্ট না করিয়া তাঁহার ভিতরকার নিগূঢ় যোগকে অধিকার করা” [ভারতবর্ষের ইতিহাস-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর]। “হেথায় আর্য, হেথা অনার্য, হেথায় দ্রাবিড় চীন-/শক-হুন-দল পাঠান মোগল এক দেহে হল লীন”-এর যে উদার ধারণা ভারত আত্মার অন্তর থেকে অন্বেষণ করে রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবন ব্যাপী সাধনায় অর্জন করেছিলেন বিজেপি-আরএসএস-মোদী-অমিত শাহরা আজ সেই উপলব্ধিকে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে একজাতি-এক ধর্ম-হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান ভাবনা দিয়ে শুধুমাত্র মনুস্মৃতি আশ্রিত এক সংকীর্ণ ব্রাহ্মণ্যবাদী ভারত গড়তে চাইছেন যেখানে ভারতবর্ষের মুসলমান পরিত্যাজ্য, দলিত মানুষ অন্ত্যজ, এমনকি নারী সমুদায়ও এক পিছরে বর্গের প্রজাতি,অস্যার্থে ‘নরকের দ্বার’। অমিত শাহ মনে রেখো তোমাদের এই মনুবাদী প্রকল্প বাংলায় ঠাঁই পাবে না। এ বাংলা চৈতন্যের, এ বাংলা মঙ্গলকাব্যের, এ বাংলা রামমোহন, বিদ্যাসাগর, ইয়ংবেঙ্গল, মধুসূদন, ক্ষুদিরাম, বাঘাযতীন, মাষ্টারদা, প্রীতিলতা, তেভাগা, খাদ্য আন্দোলন ও নকশাল বাড়ির বাংলা। আজকের ভারতের ক্রমঘনায়মান সভ্যতার সংকট সন্ধিক্ষণে – “এই কথা আজ বলে যাব, প্রবল প্রতাপশালীরও ক্ষমতা মদমত্ততা আত্মভরিতা যে নিরাপদ নয় তারই প্রমাণ হবার দিন আজ সম্মুখে উপস্থিত হয়েছে; নিশ্চিত এ সত্য প্রমাণিত হবে যে –
অধর্মেনৈধতে তাবৎ ততো ভদ্রাণি পশ্যতি।
ততঃ সপত্নান জয়তি সমূলস্তূ বিনশ্যতি”।
[সভ্যতার সংকট –রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর]
- সিতাংশু চক্রবর্ত্তী