পাঞ্জাব, হরিয়ানা, পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ থেকে কৃষকরা জমায়েত হয়ে রয়েছেন দিল্লির চারপাশে। কার্যত দিল্লি ঘেরাও হয়ে আছে। কেন, কৃষকদের দাবি কী? তাঁরা চান গলার জোর আর রাজ্যসভার উপাধ্যক্ষের অসাধু কৌশলে পাশ হওয়া কৃষি আইনগুলিকে বাতিল করা হোক। ওদিকে মোদি সরকার তো অতিমারির সময়ে ক্রমাগত ‘যুগান্তকারী’ আইন চালু করেই চলেছেন। তারা নাকি কৃষিকে উন্মুক্ত করে কৃষকদের জন্য নবযুগ আনতে চলেছে, কিন্তু ‘চাষাভুষো’রা বুঝছেন না। ভারতীয় জনতা পার্টির নেতারা অবশ্য বলছে যে, এই সমস্ত কৃষি আইনের মধ্য দিয়ে ভারতীয় কৃষিক্ষেত্রের মুক্তি ঘটবে, আর ১৯৯১ সালে যে উন্মুক্ত বাজারের সুবিধে শিল্পক্ষেত্রে ‘যুগান্তর’ এনেছে কৃষিতে তেমন ‘উন্নতি’ আসবে। ফলে এটা বোঝাই যাচ্ছে, শিল্পের উদারিকরণ যেমন আমবানি-আদানিদের মুনাফার দুনিয়াকে মুক্ত করে দেশে অর্থনৈতিক বৈষম্যকে বাড়িয়ে তুলেছে, অর্থনৈতিক ক্ষমতাকে অল্প কয়েকটি পরিবারের হাতে কেন্দ্রিভূত করেছে তেমনটাই কৃষিক্ষেত্রে ঘটানো হবে। কিছুকাল আগেই ভারতের অর্থনীতি নিয়ে একটি গবেষণাপত্রে টমাস পিকেটি লিখেছিলেন, কোম্পানিরাজ থেকে অর্বুদপতিরাজে পৌঁছেছে ভারত, আগে দেশ চালাত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, এখন দেশ চালাচ্ছে অর্বুদপতি বা বিলিয়নেয়াররা। সেই সব বিলিয়নেয়ার কেবল শিল্পক্ষেত্র দখল করেই খুশি থাকতে পারে না, তাদের দরকার ভারতের কৃষির উপরে একচ্ছত্র দখল। সেদিকে এগোতেই মোদি সরকার কৃষি আইনকে পাল্টেছেন।
কেবল কি কৃষি আইন? না, শ্রম আইন, সংবিধান, ব্যাঙ্ক ব্যবস্থা, ক্রিমিনাল আইন সমস্ত কিছুতেই হাত পড়েছে বা পড়তে চলেছে, এবং সমস্তটাই হচ্ছে অর্থনৈতিক ক্ষমতা অধিকতর কেন্দ্রিভবনের লক্ষ্যে, একচেটিয়া পুঁজিকে আরো শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যে। ওদিকে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের আভ্যন্তরীণ গোষ্ঠি প্রস্তাব করেছে যে, ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রকে বৃহৎ শিল্পপতি ও বৃৎ ব্যবসায়ীদের জন্য উন্মুক্ত করা হোক। আশ্চর্যজনক হল যে যে সমস্ত বিশেষজ্ঞের সঙ্গে ওই গোষ্ঠি কথা বলেছিল তাঁদের একজন বাদে সকলেই ওই প্রস্তাবের বিপরীতে মত প্রকাশ করেছেন। কৃষিক্ষেত্রের মতো এক্ষেত্রেও অর্থনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রিভবন হবে বলেই সবাই মনে করছেন।
বৃহৎ ব্যবসায়ীরা ব্যাঙ্ক খুললে তাদের ব্যবসায়গুলি ব্যাঙ্ক থেকে যোগসাজশের দরুণ অনায়াসে ঋণ পেতে পারবে, যাদের সেই যোগসাজশ থাকবে না তারা পাবে না। প্রাক্তন মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রামনিয়ান, শঙ্কর আচার্য ও প্রাক্তন অর্থ সচিব বিজয় কেলকারের মতে, ভারতীয় অর্থনীতি অতিরিক্ত কেন্দ্রিভবন দ্বারা বর্তমানেই আক্রান্ত। কেবল অন্ত:শিল্পক্ষেত্রীয় কেন্দ্রিভবন আছে এমনটাই নয়, বেশ কিছু ক্ষেত্রে অল্পকয়েকটি শিল্পপতি পরিবার অনেকগুলি ক্ষেত্রেই প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। রাষ্ট্র ও শিল্পপতিদের দ্বিমুখি সম্পর্কের কারণে ভারতীয় পুঁজিবাদ অনেকদিন ধরেই কলঙ্কিত, যদি শিল্প-পুঁজি ও লগ্নিপুঁজির মধ্যে পার্থক্যরেখাটিকেও মুছে ফেলা হয়, তাহলে এই কলঙ্ক আরো বাড়বে।
যদিও ভারতীয় অর্থনীতির চরম কেন্দ্রিভবন ও তদদ্ভুত চরম দক্ষিণপন্থী ফ্যাসিবাদের উত্থানের জন্য অন্যতম দায়ী চিদাম্বরমের কথাকে ধর্তব্যের মধ্যে আনা উচিৎ নয়, তিনিও কর্পোরেটদের হাতে ব্যাঙ্ক তুলে দেওয়াকে বিপজ্জনক বলে চিহ্নিত করেছেন। এস এন্ড পি গ্লোবাল রেটিংসএর মতে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ওই প্রস্তাব যথেষ্ট ঝুঁকিবহুল। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর রঘুরাম রাজন ও প্রাক্তন ডেপুটি গভর্নর ভিরাল আচর্যের মতে এই প্রস্তাব একটি বিষ্ফোরণ যা দেশের রাজনীতিতে অর্থশক্তির গুরুত্বকে, এবং আমাদের স্বৈরাচারী সাঙাতি ধান্ধাবাজির কাছে নিমজ্জিত হওয়ার সম্ভাবনাকে আরো বাড়াবে। বৃহৎ কর্পোরেট হাউসগুলি সরাসরি সম্পদ যোগাড় করার অধিকার পেয়ে আরো বড় হয়ে উঠতে সক্ষম হবে। ফলে তারা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রাধান্য আরো বিস্তার করতে পারবে। দেশের গণতন্ত্র এমনিতেই যথেষ্ট দুর্বল হয়ে পড়েছে, তা আরো ক্ষতিগ্রস্ত হবে, সম্ভবত গুরুতরভাবে।
অর্থনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রিভবন মোদি জমানার অন্যতম বৈশিষ্ট। সেমিনার পত্রিকার গত অক্টোবর সংখ্যায় হরিশ দামোদরন “ফ্রম “এন্টরিপ্রিউনারাল” টু “কংগলোমারেট” ক্যাপিটালিজম” শীর্ষক একটি নিবন্ধে দেখিয়েছেন যে গত কয়েক বছরে কীভাবে অর্থনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রিকরণ চলছে দেশ জুড়ে। তাঁর হিসেবে ২০১৪-১৫ সালে ভারতে প্রোমোটার পরিচালিত বিক্রির পরিমাণের নিরিখে বৃহত্তম যে ২০০ টি কোম্পানি ছিলে তার মধ্যে ৫৭টি উঠে গিয়েছে বা অন্য কোম্পানি কর্তৃক অধিগৃহীত হয়েছে। এর মধ্যে এসার, অনিল আম্বানি, ভিডিওকোন, গৌতম থাপারের মতো গোষ্ঠিগুলি রয়েছে। ফলে, কম সংখ্যক কোম্পানির হাতে ক্ষমতার কেন্দ্রিভবন ঘটছে। লক্ষণীয় যে, দেশে প্রায় একদলীয় সরকারের দিকে এগোনোর সঙ্গে কয়েকটি কোম্পানির হাতে ক্ষমতার কেন্দ্রিভবনের একটি সরাসরি সম্পর্ক পাওযা যাচ্ছে। যতদিন পর্যন্ত রাজ্যে রাজ্যে আঞ্চলিক দলগুলি ক্ষমতাশালী ছিল ও কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন মোর্চা ক্ষমতা বজায় রাখার জন্য আঞ্চলিক দলগুলির উপর নির্ভরশীল ছিল, এই ধরনের ক্ষমতার কেন্দ্রিভবন অনেক কম ছিল। কিন্তু গত কয়েক বছরের “শক্তিশালী কেন্দ্র” ও “শক্তিশালী নেতা” শ্লোগানের পিছনে লুকোনো রয়েছে একচেটিয়া শক্তিশালী কর্পোরেট পুঁজির শ্লোগান। সেই অসীম আর্থিক ক্ষমতাবান কর্পোরেটরা অর্থযোগান দেবে নির্বাচনী বন্ড ও অন্যান্য পদ্ধতির মাধ্যমে। বৃহৎ পুঁজিপতির সেই অগাধ ক্ষমতাকে আরো জোরালো করে তোলার জন্য জনসাধারণের সঞ্চয়ের উপরেও তাদের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা দরকার। সেই লক্ষ্যেই কর্পোরেটদের হাতে ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থাকে তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
উত্তরোত্তর ব্যাঙ্ক আমানতে সুদের হার কমানো হচ্ছে, অন্যদিকে সমস্ত লেনদেনকে ব্যাঙ্কের মাধ্যমে করার জন্য প্রতিনিয়ত বন্দোবস্ত করা হচ্ছে, চাপে ফেলা হচ্ছে জনগণকে। ফলে ক্রমাগত ব্যাঙ্ক অপরিহার্য হয়ে উঠবে লেনদেনের ক্ষেত্রে। যদি তেমনটা করা যায়, তাহলে একদিকে ব্যাঙ্ক ব্যবসায়ের রমরমা হবে; অন্যদিকে লেনদেনের জন্য ব্যাঙ্ক ছাড়া গতি না থাকলে ব্যাঙ্ক আমানতের উপর সুদের হার অত্যন্ত কম এমনকি ঋণাত্মক ও হতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রতিদানের জন্য জনগণ শেয়ার বাজার বা মিউচুয়াল ফান্ডের দিকে ঝুঁকতে বাধ্য হবে। যেহেতু শেয়ার বাজারের গতিপ্রকৃতি বৃহৎ পুঁজিপতিদের ব্যবসায়ের লাভ লোকসানের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে জড়িত তাই সেই সূত্রেও অর্থনৈতিক ক্ষমতার আরো কেন্দ্রিভবন ঘটবে। দেখা গেছে যে, অর্থনীতিতে একচেটিয়া পুঁজির রমরমা শেষ বিচারে গণতন্ত্রকে দুর্বল করে, স্বৈরাচারী শাসকের হাতে ঘুরপথে অর্থের যোগান দিয়ে শাসন ক্ষমতা বজায় রাখতে সাহায্য করে। বৃহৎ পুজিপতিদের ব্যাঙ্কিং ব্যবসায় প্রবেশের অনুমতির মাধ্যমে সেটাই করতে আগ্রহী মোদি সরকার। তার উপর ভরসা করেই বিজেপি আগামী ৫০ বছর ক্ষমতায় থাকা নিশ্চিত করতে চাইছে।
- অমিত দাশগুপ্ত