আমাদের দেশে মানবাধিকার দলনে সবচাইতে পারঙ্গমতার পরিচয় যিনি দিয়ে থাকেন উত্তরপ্রদেশের সেই মুখ্যমন্ত্রী যোগি আদিত্যনাথ বলেছেন: আমরা কি অপরাধীদের আরতি করবো? অর্থাৎ তিনি অপরাধীদের আরতি নয়, নিকেশ করার করারই পক্ষপাতী। আর এই কথা তিনি সদর্পে, সদম্ভে প্রকাশ্যে ঘোষণা করে থাকেন। জননির্বাচিত একজন মুখ্যমন্ত্রী এধরনের কথা বলতে পারেন কিনা, এপ্রশ্ন অর্থহীন। কারণ কারা অপরাধী তা তিনি এবং তার দল নিয়ন্ত্রিত প্রশাসনই নির্ধারণ করে থাকেন। আমেরিকার স্বেচ্ছাচারী প্রেসিডেন্টদের কাছে যেমন যারা সরকার এবং প্রশাসনের চোখে মিত্র হিসেবে চিহ্নিত হন না, তাঁরাই সরকার এবং প্রশাসনের কাছে শত্রু হিসেবে গণ্য হয়ে এসেছেন। অনুরূপভাবে আমাদের দেশে বর্তমানে সঙ্ঘের ফ্যাসিস্ত দর্শন-শাসিত বিজেপি সরকারও তাঁদেরই দেশের শত্রু বলে চিহ্নিত করে থাকেন যিনি বা যাঁরাই তাঁদের অমানবিক আচার-আচরণের বিরোধিতায় প্রতিবাদে সামিল হয়ে থাকেন। একসময় ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন যে আন্দোলন হচ্ছে বিলাসিতা। আর এখন শাসক বিজেপির কাছে আন্দোলন দেশবিরোধিতার নামান্তর। স্বভাবতই আন্দোলনকারিরা অতি সহজেই সরকার, সরকারী দল এবং দেশের শত্রু তথা চীন এবং পাকিস্তানের চর বা দালাল হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যান।
১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাস নাগাদ (আষাঢ় ১৩৪৬) অমিয় চক্রবর্তীকে লেখা এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ মুসোলিনি এবং হিটলারকে ‘নরবলি সংগ্রহের কাপালিক’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। এই নরবলি সংগ্রহের কাপালিকরা তো স্বভাবতই কোনও গণতান্ত্রিকতা, নিয়মনীতি কিছু মানবেন না, যে মূল্যবোধ এবং নিয়মনীতি দ্বারা তাঁরা প্রাণিত এবং পরিচালিত হয়ে থাকেন তা তো ফ্যাসিস্ত দর্শন। সেখানে মানুষের ন্যায্য অধিকারের কোনও মূল্য নেই। অধিকার বিষয়টি একমাত্র নির্ধারিত হবে তাঁরা যা করছেন বা করছেন তার দ্বারাই। রবীন্দ্রনাথ তাঁর পূর্বোক্ত বক্তব্যের দু’বছর আগে ১৩৪৪ বঙ্গাব্দের আশ্বিন মাসে ‘প্রচলিত দণ্ডনীতি’ শীর্ষক একটি লেখায় ‘দণ্ডপ্রয়োগের অতিকৃত রূপকে’ বর্বরতা আখ্যা দিয়েছিলেন। তিনি স্পষ্টভাবেই জানিয়েছিলেন যে তিনি কোনও অপরাধীর ‘নির্জন কারাকক্ষবাস’-এর দণ্ড সমর্থন করেন না। শাসকেরা এধরনের অপকর্ম করলে তিনি একাজের প্রতিবাদ করবেন বলে জানিয়েছিলেন।
এই প্রতিবাদ করাটাই মানুষের ন্যায়সঙ্গত অধিকার। সরকার এই মানুষের এই অধিকারকেই খর্ব করতে চায় তার কায়েমি স্বার্থসেবার লক্ষ্যেই। মনে রাখা দরকার ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের অগাস্ট মাসে সুভাষচন্দ্র বসু, কিরণশঙ্কর প্রমুখের উদ্যোগে পালিত হয়েছিল ‘নিখিল ভারত লাঞ্ছিত রাজনৈতিক কর্মীদিবস’। এদিনের এই কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্যে পরিচালকবৃন্দ নয়মাস কারাদণ্ডের শিকার হয়েছিলেন। এর দু’বছর পরে ১৯৩১-এর ২৬ সেপ্টেম্বর হিজলি জেলে গুলিচালনার প্রতিবাদে কলকাতার মনুমেন্টের নিচে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ সভা থেকেই রাজনৈতিক বন্দিমুক্তি এবং ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষার লক্ষ্যে একটি নাগরিক কমিটি গঠন করা হয়েছিল। এই কমিটির প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বয়ং। এঘটনার পাঁচবছর পর ১৯৩৬- এর জুলাই-অগাস্ট মাসে রাজনৈতিক বন্দিমুক্তি, ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার দাবিতে সারা দেশজুড়ে সঙ্ঘবদ্ধ আন্দোলন শুরু হয়েছিল। এর ফলেই গঠিত হয় ‘অল ইন্ডিয়া সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়ন’। এই সংগঠনের অনরারি প্রেসিডেন্ট-এর দায়িত্বপ্রাপ্ত হন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এবং চেয়ারম্যান হন সরোজিনী নাইডু।
২
১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ১০ ডিসেম্বর তারিখটিকে ইউনাইটেড নেশনস জেনারেল অ্যাসেম্বলি মানবাধিকার দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিলেন। এই ঘোষণার প্রায় ষোলো মাস আগে সাতচল্লিশের পনেরোই অগাস্ট অখণ্ড পরাধীন ভারতবর্ষ দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দ্বিধাবিভক্ত দুটি স্বতন্ত্র এবং ‘স্বাধীন’ দেশ হিসেবে গণ্য এবং সর্বজনীন পরিচিতি অর্জন করেছিল। এই দিনটির অবব্যহিত আগে ব্রিটিশ শাসনাধীন পরাধীন ভারতবর্ষে গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার বারবার লাঞ্ছিত এবং লঙ্ঘিত হয়েছে। উত্তর-সাতচল্লিশেও এই দুই দেশের মানুষই গণতান্ত্রিক ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বারবার শিকার হয়েছেন এবং আজও হচ্ছেন। স্বভাবতই ১০ ডিসেম্বর প্রতিবছরই আসে এবং দেশের মানুষের অধিকার বঞ্চনার ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকে। আমাদের দেশে গত ২০১৪ থেকে ২০১৯ খ্রিস্টাব্দের অন্তর্বর্তী সময়ে অন্তত ২০০ জন সাংবাদিক আক্রান্ত হয়েছেন সত্যসন্ধ তদন্তমূলক সাংবাদিকতার জন্যেই! এই পাঁচ বছরে ৪০ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন! ২০১০ খ্রিস্টাব্দ থেকে পরবর্তী চার বছরেও ৩০ জন সাংবাদিক খুন হয়েছেন বলে জানা যায়। আমাদের দেশে সাংবাদিককের ওপর ২১টি আক্রমণের যে তথ্য পাওয়া গিয়েছে সেখানে দেখা গিয়েছে এই আক্রমণের মধ্যে ব্যবসায়িরা জড়িত ২টি ক্ষেত্রে, পুলিশ এবং রাজনৈতিক নেতা জড়িত ১টি ক্ষেত্রে। এছাড়া রাজনীতিবিদ, দক্ষিণপন্থী হিন্দুত্ববাদী, রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা বাহিনী এবং গ্রাম্য মোড়ল/ মাতব্বরের প্রত্যেকে ১টি করে ক্ষেত্রে জড়িত। রাজনৈতিক দলের সমর্থকরা জড়িত ২টি ক্ষেত্রে। খনিমালিক এবং বালিখাদের মালিকেরা জড়িত ২টি করে ঘটনায়। বালি এবং মদ ব্যবসায়ী ও কেরোসিন ব্যবসায়ী জড়িত ১টি করে ক্ষেত্রে। পাথর ছুঁড়ে হত্যার ঘটনা ঘটেছে ১টি। ‘মাওবাদী’ এবং তাদের উপদলীয়রা জড়িত ২টি ক্ষেত্রে। আর অসনাক্তকৃত ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৪ জন সাংবাদিক। ২০১৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে এযাবৎ সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণের কোনও ঘটনায় অভিযুক্ত বা অভিযুক্তদের এখনও শাস্তি হয়নি! প্রতিটি ক্ষেত্রেই তদন্ত চলছে! ১৯ জন মহিলা সাংবাদিকও এই আক্রমণের শিকার হয়েছেন। গত বছরের ডিসেম্বরের ১১ থেকে ২১ তারিখের মধ্যে মোট বারোদিনে ১৪ জন সাংবাদিক পুলিশি হুমকি এবং আক্রমণের শিকার হয়েছেন, আর এঁদের অধিকাংশই মুসলিম!
গত ২০১৭-র ৫ সেপ্টেম্বর ব্যাঙ্গালোরে নিহত হয়েছিলেন সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশ। শ্রীনগরের ‘রাইজিং কাশ্মীর’ পত্রিকার সম্পাদক ও সাংবাদিক সুজাত বুখারি খুন হন ২০১৮-র ১৪ জুন। ইন্ডিয়ান একসপ্রেস পত্রিকার সাংবাদিক শিবানী ভাটনগর খুন হন ২০১৯-এর ২৩ জানুয়ারি। ২০১৫ খ্রিস্টাব্দের প্রতিতুলনায় ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে আমাদের দেশের জেলগুলিতে নিহত বন্দীদের সংখ্যা ৫.৪৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতের জেল হেফাজতে বন্দীমৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১৬৭১। এরমধ্যে ১৩৩ জনের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। পূর্ববর্তী বছরে জেল হেফাজতে বন্দীমৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১৬৫৫। এরমধ্যে ২৩১ জনের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছিল। ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে এই সংখ্যাগুলি ছিল যথাক্রমে ১৫৮৪ এবং ১১৫। ২০১৫-র প্রতিতুলনায় ২০১৭-য় জেল হেফাজতে বন্দীদের অস্বাভাবিক মৃত্যুর হার ছিল ১৫.৭ শতাংশ বেশি। ২০১৭-য় যে ১৩৩ জন বন্দীর অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছিল জেল হেফাজতে তার মধ্যে ১০৯ জন আত্মহত্যা করেছিলেন, ৯ জন দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন, ৫ জন খুন হয়েছিলেন। এছাড়া ৪৪ জন বন্দীর মৃত্যুর কারণ এখনও অজ্ঞাত। ২০১৫, ২০১৬ এবং ২০১৭-য় পুলিশি হেফাজত থেকে বন্দীদের পালিয়ে যাওয়ার প্রচারিত তথ্য হচ্ছে যথাক্রমে ৩৭১, ৫৭৭ এবং ৩৭৮ জন। গুজরাট, রাজস্থান, বিহার এবং পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে এই সংখ্যা যথাক্রমে ৯০, ৮, ৮ এবং ১১ জন। ২০১৪, ২০১৫, ২০১৬ এবং ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে সারাদেশের বিভিন্ন জেলে বন্দীদের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৪১৮৫৯৫, ৪১৯৬২৩, ৪৩৩০০৩ এবং ৪৫০৬৯৬ জন। দেখা যাচ্ছে প্রতিবছরই জেলবন্দির সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটেছে। ২০১১, ২০১২, ২০১৩ এবং ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে জেলহেফাজতে বন্দীমৃত্যুর সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ১২৪৪, ১৩৪৫, ১৪৮২ এবং ১৫০৭ জন। এরমধ্যে অস্বাভাবিক মৃত্যুর সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৮৮, ১২৬, ১১৫ এবং ১৯৫ জন। ২০১৯-এর ৩০ জুন অবধি দেশের আটটি প্রধান হাইকোর্টে ৩৭,২৪৫টি জামিনের আবেদন পড়ে রয়েছে। এই বিচারাধীন বন্দীদের কথা কেউ বলেন না!
৩
মাওবাদীদের সঙ্গে যুক্ত থাকার ‘কথিত’ অভিযোগে নাগপুর সেন্ট্রাল জেলে বন্দী আছেন আশি শতাংশ শারীরিকভাবে পঙ্গু অধ্যাপক জিএন সাইবাবা। তিপ্পান্ন বছর বয়সি এই অধ্যাপক যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ পেয়েছেন আমাদের দেশের মহামান্য আদালতের রায়ে। অসুস্থ এই বন্দির সঙ্গে এমনকি তার স্ত্রীকেও দেখা করার অনুমতি সবসময় দেওয়া হয় না। তিরাশি বছর বয়সি পাদ্রি ফাদার স্টান স্বামীও মাওবাদী সংযোগের অভিযোগে বর্তমানে কারাবন্দী। পারকিনসন রোগাক্রান্ত এই অশীতিপর বন্দীও জেলে সুব্যবস্থার অনধিকারী! বাষট্টি বছর বয়সি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের প্রাক্তন অধ্যাপিকা সোমা সেন ভিমা কোরেগাঁও মামলায় গ্রেফতার হয়ে কারারুদ্ধ অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। তিনি চোখের রোগে ভুগছেন। তিনিও মুম্বাই জেলে কোনোরকম প্রয়োজনীয় সুবিধা থেকে বঞ্চিত। প্রখ্যাত তেলুগু কবি একাশি বছর বয়সি ভারভারা রাও তাঁর জীবনের অর্ধেকের বেশি সময় জেলে কাটিয়েছেন। গত দু’বছরেরও অধিক সময় (২০১৮-র ২৮ অগাস্ট থেকে) তিনি পুনরায় জেলের গরাদের আড়ালে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকে কথিত হত্যার ষড়যন্ত্র মামলায়! এই ভিমা কোরেগাঁও তথা এলগার পরিষদ ষড়যন্ত্র মামলায় আরও যাঁরা বন্দী হয়ে দিনযাপন করছেন তাঁদের মধ্যে আছেন প্রখ্যাত আইনজীবী সুরেন্দ্র গ্যাডলিং, কবি ও প্রকাশক সুধীর ধাওয়ালে, অধিকার আন্দোলনের কর্মীদ্বয় মহেশ রাউত এবং রোনা উইলসন, আইনজীবী এবং ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠক সুধা ভরদ্বাজ, মানবাধিকার কর্মী এবং সাংবাদিক অরুণ ফেরেইরা এবং ভার্নন গনজালভেজ। এছাড়াও বন্দীদশায় দিন কাটাচ্ছেন ইকোনমিক অ্যান্ড পোলিটিক্যাল উইকলি পত্রিকার নিয়মিত কলাম-লেখক আনন্দ তেলতুম্বে, পিপলস ইউনিয়ন ফর ডেমোক্রাটিক রাইটস-এর সদস্য এবং ইপিডব্ল্যু পত্রিকার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গৌতম নভলাখা প্রভৃতি। কবি ভারভারা রাও-এর জামাতা এবং হায়দ্রাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক কে সত্যনারায়ণার বাড়িতে পুলিশ হাজির হয়ে তাঁর কাছে জানতে চেয়েছে: তিনি কেন মাও এবং মার্কস-এর ওপর লেখা বই পড়ছেন, কেন তাঁর ঘরে চীন দেশে ছাপা বইপত্তর রয়েছে এবং কেন তাঁর ঘরে কোনও ঈশ্বরের ছবির পরিবর্তে ফুলে এবং আম্বেদকর-এর ছবি টানানো রয়েছে? এভাবেদেশের যশস্বী কবি, লেখক, আইনজীবী, কলাম-লেখক, অধিকার আন্দোলনের কর্মিদের মাওবাদী সংযোগের কথিত এবং কল্পিত অভিযোগে গ্রেপ্তার করে বিভিন্ন মামলায় অভিযুক্ত করে দীর্ঘদিন কার্যত বিনাবিচারে কারারুদ্ধ করে দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারকে পদদলিত করে চলেছেন বিজেপি সরকার যা তাদের ফ্যাসিস্ত রাজনীতির সঙ্গেই খাপ খায়। দিল্লির জেএনইউএর প্রাক্তন ছাত্রনেতা উমর খলিদ-কেও মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করে কারারুদ্ধ করে রেখেছে এই সঙ্ঘপরিবার নিয়ন্ত্রিত সরকার। এই সরকার এবং দলীয় কাপালিকদের কাছে মানবাধিকার শব্দটি তামাশার সমার্থক।
রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন: “পুলিশ একবার যে চারায় অল্পমাত্রও দাঁত বসাইয়াছে সে চারায় কোনোকালে ফুল ফোটে না, ফলও ধরে না।” ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে তাঁর লেখা ‘ছোটো ও বড়ো’ প্রবন্ধে এই কথা লেখার পর তিনি আবার বলেছিলেন: “পুলিশের মারের তো কথাই নাই, তার স্পর্শই সাঙ্ঘাতিক।” তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন: কেন নিছক সন্দেহের বশে এইভাবে এঁদের সারাজীবনের মতো পঙ্গু করে দেওয়ার মতো কাজ সরকার করে চলেছেন? তিনি প্রশ্ন করেছিলেন: দেশের বালক যুবক সহ মানুষকে এভাবে ‘পুলিশের গুপ্তদলনের হাতে নির্বিচার’ ছেড়ে দেওয়া কী ধরনের রাজনীতি? তিনি কি জানতেন না যে এই পুলিশ রাষ্ট্রের রক্ষাকবচ হিসেবেই কাজ করে? পুলিশকে এই মানবতাবিরোধী ক্ষমতা রাষ্ট্রই দিয়ে থাকে। আর এখন তো দেশে ফ্যাসিস্ত রাজ কায়েম হয়েছে। এখন তো বিরোধী কণ্ঠস্বর রুদ্ধ করাই সরকারের অনুশীলিত রাজনীতির অঙ্গ।
এখন তো আমাদের দেশে বিশ্বাসের মন্দির প্রতিষ্ঠা আর মসজিদ ধ্বংস করাকে সমার্থক বলে গণ্য করে আদালতের রায় দেওয়া হয়। যে কোনও ক্ষমতার মধ্যে যে একটা আধিপত্যের সম্পর্ক থাকে, সেই আধিপত্যের সঙ্গে যে হিংসার সম্পর্ক থাকে একথা তো মিথ্যে নয়। কিন্তু এই নির্জলা সরল সত্যকে যদি দেশের বিরুদ্ধে, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে হিংসা ছড়ানোর প্রচারে ব্যবহারের সাজানো তত্ত্বে যাকে তাকে গ্রেপ্তার করে ইউএপিএ দিয়ে জেলে পোরার নিদান দেওয়া হয়, তবে তা কি আর দেশের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে সুরক্ষিত রাখার প্রক্রিয়ায় সামিল হতে পারে? পাঞ্জাবের কৃষকরা সরকারের কৃষিনীতি সংক্রান্ত তিনটি বিলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের অধিকারের অনুদশীলন করতে নেমে সরকারের আক্রমণের শিকার হয়েও প্রতিবাদী আন্দোলনের পথচ্যুত হননি। ক্রমশই সারাদেশ তাঁদের পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে। ঔপনিবেশিক আইন এবং দণ্ডনীতি সাতচল্লিশের প্রায় সাড়ে সাত দশক পরে এসেও সমান কার্যকারিতায় ঔপনিবেশিক শাসনকেই মনে পড়ায়। এবারের ১০ ডিসেম্বর কি এই স্খলিত স্বাধীনতা, খণ্ডিত অধিকার, ধ্বস্ত মানবতাকে মুক্তির স্বপ্ন দেখাবে?
- অশোক চট্টোপাধ্যায়