প্রতিবেদন
চুক্তি চাষ : কৃষকদের সর্বনাশ
cccf

(নিউজক্লিক-এ ২০ ডিসেম্বর প্রকাশিত হয়েছে শিঞ্জানি জৈনর এক প্রতিবেদন। চুক্তি চাষ পঞ্জাবে কি সর্বনাশ ডেকে এনেছে, এটা তার এক জীবন্ত ছবি। গুরুত্ব বিচারে এর কিছু অংশ অনুবাদ করা হলো পাঠকদের জন্য)

১৯৮৮ সালে ভারত সরকার চুক্তি চাষের সবুজ সংকেত দেওয়ার পর পঞ্জাবে “দ্বিতীয় সবুজ বিপ্লব”-এর সূচনা করতে পেপসি তার প্রজেক্ট শুরু করে। ইতিমধ্যে, পঞ্জাবে প্রথম কৃষি বিপ্লবের গতিভঙ্গ হওয়া শুরু হয়। প্রধান প্রধান ফসলের উৎপাদন কমতে শুরু করে। পেপসি কোম্পানি, ভোল্টাস এবং পঞ্জাব অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রি কর্পোরেশন, এই তিনটে সংস্থার যৌথ প্রকল্পের অধীনে কৃষির বৈচিত্রকরণের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়, তার লক্ষ্য ছিল ধান ও গম উৎপাদন থেকে কৃষকদের সরিয়ে নানা ধরনের সব্জি ও ফল চাষের দিকে নিয়ে যাওয়া। ১৯৮৮ সালে ভারতীয় কিষাণ ইউনিয়ন এবং অকালি দল সোৎসাহে এই প্রকল্পকে সমর্থন করে। ১৯৯০’র গোড়ার দিকে পেপসিকোর সাবসিডিয়ারি পেপসি ফুডস পঞ্জাবে টমেটো ও লঙ্কা ফলানো শুরু করে চুক্তি চাষের মাধ্যমে। স্থানীয় এক সংস্থা নিজ্জের অ্যাগ্রো ফুডস ও টমেটো চাষ শুরু করে দেয়। কিন্তু ১৯৯০-এর শেষ থেকেই পেপসি প্রজেক্টের প্রতি মোহভঙ্গ ঘটতে শুরু করে বিকেইউ-অকালি দল ও পঞ্জাব অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ্ কর্পোরেশন ও ভোল্টাজ এর, যারা কিছুদিন আগে পর্যন্ত ছিল এর প্রবল সমর্থক।

হিন্দুস্থান লিভারের কাছে টমেটো উৎপাদনের প্রকল্পটি বিক্রি করার পর ১৯৯০ দশকের শেষে পেপসি চুক্তি চাষের মাধ্যমে আলু উৎপাদন শুরু করে। ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত শ’য়ে শ’য়ে টমেটো ও লঙ্কা চাষিদের সাথে চুক্তি প্রথায় ব্যবসা করার পর এবার পেপসি মাত্র কয়েক ডজন আলু ও লঙ্কা চাষিদের সাথে চুক্তি করতে শুরু করলো। আলু চাষিরা যে উৎপাদন করতো তার মাত্র দশ শতাংশ তারা সংগ্রহ করতো। তখন বলা হয়েছিল, পেপসি নরম পানীয়র সাতটা বটলিং প্ল্যান্ট পঞ্জাবে স্থাপন করবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মাত্র একটাই দিনের আলো দেখল। যে চাষিরা পেপসির সাথে চুক্তিবদ্ধ ছিল, তারা দেখল পেপসি পরিমাণ ও গুণের দিক থেকে অল্প পরিমাণে কমা বীজ দিচ্ছে। তারা এটাও অভিযোগ করেন, যে সারের সুপারিশ তারা করছে, তার দামও অনেক বেশি।

হিন্দুস্থান লিভার সম্পর্কে চাষিদের অভিযোগ, চুক্তিবদ্ধ চাষিরা উদ্বৃত্ত ফসল ফলালেও চুক্তিবদ্ধ নয় এমন চাষিদের কাছে তারা চারাগাছ বিক্রি করতে শুরু করে। অতিরিক্ত উৎপাদন হলেও চাষিদের কাছ থেকে সেই ফসল তারা কিনতো না। এটা বারবার হয়েছে। পঞ্জাবে পেপসির মতো বৃহৎ এগ্রি-বিজনেসের কাছ থেকে এই  অভিজ্ঞতার দরুণ এ রাজ্যে চুক্তি চাষের প্রতি রীতিমতো নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে।

যে তিনটি কৃষি আইন পাশ হয়েছে, তার মধ্যে একটা আইন চুক্তি চাষ সংক্রান্ত। কৃষকেরা আশংকা প্রকাশ করছেন যে এই আইনের ফলে তারা নিজের জমিতেই মজুরি দাসত্বে বাঁধা পড়বে। বিশাল বিপুল এগ্রি-বিজনেসগুলো অসম ময়দানে নিজের শর্তে ব্যবসা করবে — কখন কি ফসল ফলাতে হবে, তার দাম, গুণমান কি হবে, সব ব্যাপারেই ছড়ি ঘোড়াবে।

সজ্জন সিং, বয়স ৬৮ জানান, “আমাদের মতো ছোট চাষিদের কোনো লাভই হবে না এই চুক্তি চাষে। প্রথম প্রথম কর্পোরেটরা ভাল দাম দেবে। তারপর তারা কব্জা করে নেবে বাজার, ও দাম নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করবে। দিল্লি থেকে ৪৩০ কিলোমিটার দূর তারণ জেলা থেকে তিনি এসেছেন আন্দোলনে যোগ দিতে।

অমৃতসরের কোহালী গ্রামের দেহাতী মজদুর সভার প্রধান লাভ সিং জানালেন, কেন এই দীর্ঘ পথ উঁজিয়ে কৃষিমজুর ও ছোট চাষিরা দিল্লি এসেছেন বিক্ষোভ দেখাতে। তিনি নিজেই ভূমিহীন কৃষক এবং তপশীলী জাতির।

“আমরা জানি এই সমস্ত বৃহৎ কর্পোরেট ঘরানাগুলো আইনের সুযোগ নিয়ে সমস্ত কিছুই নিজেদের কব্জায় রাখবে। তারাই নির্ধারণ করবে ফসলের দাম, আর আমরা রসাতলে যাব”।

যে সমস্ত হাজারে হাজারে কৃষকেরা কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে দিল্লি অভিমুখে যাচ্ছেন, তাদের রয়েছে চুক্তি চাষের বাস্তব নির্মম অভিজ্ঞতা। তাদের কাছে এই সমস্ত কর্পোরেটদের চুক্তি চাষ নতুন কোন ব্যাপার স্যাপার নয়, জীবনের অভিজ্ঞতায় যা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন। কয়েক দশকের অনুশীলনের পর পঞ্জাবে এই চুক্তি চাষ আজ ব্যর্থ, কৃষক স্বার্থবিরোধী হিসাবেই প্রতিপন্ন হয়েছে। পঞ্জাব ছিল প্রথম রাজ্য যেখানে ২০০২ সালে চুক্তি চাষ চালু হয়। আর তার এক দশক পর, ২০১২ সালে তা বাতিল করা হয়।

চুক্তি চাষ হলো, চাষের ও কৃষি পণ্যের যোগানের ব্যবস্থাপনা, যা চাষি ও ব্যবসায়িক কোম্পানিগুলোর মধ্যে পূর্বনির্দ্ধারিত দামের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। এ ক্ষেত্রে, খরিদ্দার (যারা বৃহৎ কর্পোরেট বা ব্যবসায়িক কর্পোরেশন হয়) চাষাবাদের নানা সরঞ্জাম, যেমন, বীজ, সার, কীটনাশক ও তার সাথে প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত সুবিধা সরবরাহ করে থাকে। খরিদ্দারের প্রয়োজন অনুযায়ী কৃষককে উৎপন্ন করতে হবে নির্দিষ্ট পরিমাণ ও গুণ সম্পন্ন ফসল। আধুনিক চুক্তি চাষ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটা সংঘবদ্ধ ব্যবস্থা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে, যেখানে কৃষির কর্পোরেটকরণ পৌঁছেছে শিখরে, আর বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে বহুজাতিক কর্পোরেট সংস্থাগুলো গোটা কৃষি উৎপাদন ও বিপণনকে রেখেছে নিজেদের হাতের মুঠোয়।

১৯৮৬ সালে পঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী অমরিন্দর সিংএর আমলে গঠিত হয় এক বিশেষজ্ঞ কমিটি আর লক্ষ্য ছিল কৃষির বৈচিত্র্যকরণ। এস এস জোহল ছিলেন সেই কমিটির চেয়ারম্যান। এই কমিটি প্রস্তাব দেয়, গম ও ধানের অধীনে কুড়ি শতাংশ জমিতে অন্য বাণিজ্যিক ফসল, যেমন, ফল ও সব্জি চাষ করা হবে। তারপর, আবার ২০০২ সালে এই কমিটি প্রস্তাব দেয়, ধান ও গমের অধীনে থাকা দশ লক্ষ হেক্টর জমিতে ফলানো হবে বাণিজ্যিক ফসল। তারপর, পঞ্জাব সরকার ২০০২ সালে প্রবর্তন করলো চুক্তি চাষ প্রকল্প। চুক্তি চাষকে গতি দিতে গঠিত হয় পঞ্জাব এগ্রো ফুডগ্রেণ কর্পোরেশন (পিএএফসি)-কে নিয়োগ করা হয় নোডাল এজেন্সি হিসাবে, যারা কৃষকদের নানা সরঞ্জাম দেবে, টেকনিক্যাল নজরদারী রাখবে, আর কৃষকদের কাছ থেকে ক্রয় করবে উৎপন্ন ফসল।

পিএএফসি ছাড়াও অনেক এগ্রিবিজনেস সংস্থা পঞ্জাবে সরাসরি কৃষকদের সাথে চুক্তি চাষ শুরু করে। ১৯৮৯-এর গোড়ায় পেপসিকো পঞ্জাবের হোশিয়ারপুরে টমেটো প্রক্রিয়াকরণ প্ল্যান্ট স্থাপন করে। তারপর, টমেটো কেনা বন্ধ করে পটেটো চিপসের জন্য আলু কিনতে শুরু করে। একেবারে প্রথম দিকে মনে করা হচ্ছিল যে পঞ্জাবে চুক্তি চাষ কৃষির বৈচিত্র্যকরণ ও কৃষকদের আয় বাড়াতে সফল হয়েছে। কিন্তু ২০০০-এর পর থেকেই সমস্যার কালো মেঘ জমতে শুরু করে। প্রখ্যাত অর্থশাস্ত্রী জয়তী ঘোষ দেখান, চুক্তি চাষের ফলে কৃষকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তারা ক্রমেই মুখ ফেরাতে শুরু করেন। বহু অনুসন্ধামূলক সমীক্ষা দেখায়, বৃহৎ কর্পোরেট সংস্থাগুলো নানা ধরনের ছক ও অসৎ উপায় নেওয়ায় কিভাবে কৃষকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। দেখা গেছে, পূর্ব নির্দ্ধারিত দাম না দিয়ে কোম্পানিগুলো তার থেকে অনেক কম দামে ফসল বিক্রি করতে কৃষকদের বাধ্য করেছে।

বেশ কিছু ক্ষেত্রে, অবশেষে পিএএফসি-কে ময়দানে নামতে হয় চাষি ও কোম্পানির মধ্যেকার গ্যারান্টার হিসাবে। আর, কোম্পানিগুলো প্রতিশ্রুতি মতো যে ফসল কেনেনি, পিএএফসি-কে তাই কিনতে হয়।

২০১২ সালের পর নতুন সরকার পারিপার্শ্বিক নানা কারণে আগ্রহ হারাতে শুরু করে, কেন্দ্র এ ব্যাপারে সাহায্যের হাত বাড়ায় নি, ফলে তারপর থেকে চুক্তি চাষ বাতিল হতে শুরু করে।

পঞ্জাব হরিয়ানার নানা অনুসন্ধান থেকে এটা স্পষ্ট যে চুক্তি চাষ কৃষকদের সামনে বিরাট এক সমস্যা নিয়ে হাজির হয়েছে। প্রতিশ্রুতি মতো উৎপন্ন ফসল না কেনা, নিম্ন মানের কৃষি সরঞ্জাম দেওয়া, বিলম্বিত পেমেন্ট, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া প্রভৃতি হল নানা কারণ। আমেদাবাদের ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ম্যানেজমেন্ট এর অধ্যাপক শুকপাল সিং বলেছেন, “চুক্তি চাষ কেবলমাত্র কোম্পানির স্বার্থবাহী। এটা কোনোভাবেই কৃষকদের স্বার্থে পরিচালিত হয় না। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে বা বাজারে দাম অস্বাভাবিক হারে পড়ে গেলে কৃষকেরা বিরাটভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।”

সিং এটাও জানিয়েছেন, কোম্পানিগুলো বৃহৎ ও মাঝারি কৃষকদের সঙ্গে চুক্তি চাষ করার আগ্রহ দেখায়। এর ফলে বিপরীত এক প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে পঞ্জাবে। সেখানে বৃহৎ-মাঝারি কৃষকেরা ছোট/মাঝারি কৃষকদের কাছ থেকে জমি লিজে নেয়।

ভারতে এখনও প্রায় ৭০ শতাংশ পরিবার জীবন ধারণের জন্য কৃষির উপর নির্ভরশীল আর তাদের মধ্যে প্রায় ৮২ শতাংশই হলেন ছোট মাঝারি কৃষক। অধ্যাপক শুকপাল সিং জানিয়েছেন, পঞ্জাবে কৃষি অবস্থা তীব্র সংকটাপন্ন, আর ছোট কৃষকেরা বিরাট সমস্যায় জর্জরিত। ছোট কৃষকদের একর পিছু ঋণ সব থেকে বেশি, ছোট মাঝারি কৃষকরাই সব চেয়ে বেশি আত্মঘাতী হচ্ছেন। ছোট কৃষক ও প্রান্তিক চাষিরা ক্রমেই জমি হারাচ্ছেন, কৃষি জমি তাদের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে “কৃষকেরা তাদের জীবনের অভিজ্ঞতার উপর দাঁড়িয়ে তাই কৃষি আইনগুলোর লাগাতার বিরোধিতা করছেন, এই আন্দোলন নতুন নতুন সীমানা, পরিধি জুড়ে ব্যাপ্ত হচ্ছে, টেনে এনেছে সারা ভারতবর্ষের মানুষকে — আবালবৃদ্ধবনিতা আজ সামিল এই মহারণে।

মোদী সরকারের জেদ নাকি কর্পোরেটদের স্বার্থবাহী আইনকে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত করা দুর্দমনীয় হিম্মত, কে জয়ী হবে তা বলবে অনাগত ইতিহাস।

- অতনু চক্রবর্তী    

খণ্ড-27
সংখ্যা-46