২০২০ সন ছিল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতোই ঊনিশ শতকের আর এক বিশিষ্ট চিন্তাবিদ অক্ষয় কুমার দত্তের জন্ম দ্বিশতবর্ষ। দুজনেই জন্মেছিলেন ১৮২০ সালে। উনিশ শতকে বাংলায় ইউরোপীয় শিক্ষা ও শাসনের সূত্র ধরে যে নতুন চিন্তাভাবনা বিকশিত হয়েছিল, সমাজ ও ইহজগৎ সম্পর্কে চর্চায় যে নতুন জোয়ার এসেছিল, বিদ্যাসাগরের মতো অক্ষয় দত্তও ছিলেন তার অন্যতম শরিক।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ধর্মচিন্তা নিয়ে সারাজীবনে কখনোই ব্যস্ত হননি। অক্ষয় কুমার দত্ত আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রাহ্মধর্ম ও সমাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বটে, কিন্তু তিনিও বস্তুজগতের সঙ্গে মানবপ্রকৃতির সম্পর্ক নিয়েই বেশি ব্যস্ত ছিলেন। অক্ষয় দত্তের আগে রাজা রামমোহন রায়ও ব্রাহ্ম ধর্ম আন্দোলনের মধ্যে থেকেই ইহজাগতিক বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তিনি একদিকে ব্রাহ্ম ধর্ম আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা, আবার অন্যদিকে তিনি অর্থনৈতিক সামাজিক নানা বিষয় নিয়ে আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে সামিল। এই উত্তরাধিকার অক্ষয় কুমার দত্তের মধ্যেও আমরা দেখতে পাই।
অক্ষয় দত্ত মাত্র তেইশ বছর বয়সে, ১৯৪৩ সালে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। প্রায় বারো বছর একটানা সেই পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। অক্ষয় দত্তের সম্পাদনা পর্বে ব্রাহ্মধর্ম আন্দোলনের তাত্ত্বিক মুখপত্রের উদ্দিষ্ট পরিসরকে অতিক্রম করে তত্ত্ববোধিনী বহুবিস্তৃত হয়। সমাজজীবন ও বস্তুজগতের নানাকিছু সেখানে নিয়মিত প্রকাশিত হতে থাকে। এমনকি জমিদার পরিবারের মালিকানাধীন এই পত্রিকায় অক্ষয় দত্ত নিজেই লেখেন ‘পল্লীগ্রামস্থ প্রজাদের দূরবস্থা বর্ণন’ নামের প্রবন্ধ। সেখানে জমিদার সহ জমিদারী ব্যবস্থার নানা আমলা – ইজারাদার, পত্তনিদার, নায়েব থেকে শুরু করে পুলিশ প্রশাসন পর্যন্ত একটি বৃহৎ চক্রের যাঁতাকলে কৃষকেরা কীভাবে লাঞ্ছিত ও পিষ্ট হয়, তার বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে।
অক্ষয় দত্ত রামমোহন বা বিদ্যাসাগরের মতো সক্রিয়ভাবে সামাজিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারেননি। এর অন্যতম কারণ তাঁর ভগ্নস্বাস্থ্য। বিশেষ জীবনের শেষ কয়েক দশক তাঁকে একরকম গৃহবন্দী দশাতেই কাটাতে হয়েছিল। কিন্তু শারীরিকভাবে বাইরের জগতের সঙ্গে বিনিময় করতে সক্ষম না হলেও তিনি তাঁর মনের দরজা সব সময়ে খুলে রেখেছিলেন। মূলত বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশুনো ও লেখালিখিতেই বেশিরভাগ সময়ে তিনি নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন।
অক্ষয় দত্তের পড়াশুনো ও লেখালিখির জগৎটি ছিল সুবিস্তৃত। ১৮২০ সালে তাঁর জন্ম, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে একই বছরে। ১৮৩৬ সালে তিনি সেকালের নামজাদা স্কুল ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু বাবা মারা যাওয়ার পর অর্থসঙ্কটের কারণে ১৯৩৮-৩৯ সালে আঠারো বছর বয়েস হতে না হতেই তাঁকে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনো থেকে সরে আসতে হয়। এরপর শুরু হয় তাঁর স্বশিক্ষার পালা, যা আজীবন চলেছিল। ষোল থেকে কুড়ি বছর বয়সের মধ্যেই তিনি ইউক্লিডের জ্যামিতি, জ্যোতিষ, উচ্চতর গণিত, বীজগণিত, ত্রিকোণমিতি, ক্যালকুলাস, মেকানিক্স, হাইড্রোস্ট্যাটিক্স, মেটিরিয়োলজি, এস্ট্রোনমি, ফ্রেনোলজির মতো বহু বিষয় আয়ত্ত করেছিলেন বলে তাঁর জীবনীকার নকুড়চন্দ্র বিশ্বাস ‘অক্ষয় চরিত’এ জানিয়েছেন। ঈশ্বর গুপ্ত মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে অক্ষয় দত্তের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। এই নব্য যুবকের জ্ঞানের গভীরতা দেবেন্দ্রনাথকে মুগ্ধ করে। তিনি তাঁর প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে অক্ষয় দত্তকে বেছে নেন। এই মাসিক পত্রিকাটি সম্পাদনার আগে অক্ষয় দত্ত কিছুদিন বিদ্যাদর্শন নামে একটি স্বল্পস্থায়ী পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন। ১৮৪২ সালে মাত্র চারটি সংখ্যা প্রকাশের পর এটি বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে তিনি বারো বছর একটানা কাজ করেন। অবশেষে ১৯৫৫ সালে তিনি এই পত্রিকা সম্পাদনার জায়গা থেকে সরে আসেন এবং বিদ্যাসাগর পরিচালিত কলকাতা নর্ম্যাল স্কুলের প্রধান শিক্ষকের পদে যোগ দেন। কিন্তু স্বাস্থ্য সমস্যার কারণে ১৯৫৮ সালের অগস্ট মাসে তাঁকে চাকরি ছেড়ে দিতে হয়। বাকি জীবন তিনি প্রায় গৃহবন্দী হয়েই কাটান। পড়াশুনো ও লেখালিখিই জীবনের শেষ তিন দশক তাঁর একমাত্র সঙ্গী ছিল। ১৮৮৬ সালে ছেষট্টি বছর বয়সে তাঁর প্রয়াণ হয়।
চোদ্দ বছর বয়সে অক্ষয় দত্ত তাঁর প্রথম বইটি লিখেছিলেন। সেটি অবশ্য ছিল একটি আদিরসের কাব্য, নাম অনঙ্গমোহন। এরপর তিনি বালক বালিকাদের পাঠ্যপুস্তক হিসেবে ভূগোল নামে একটি বই লেখেন। ১৯৪১ সালে এই বইটি প্রকাশের সময় তাঁর বয়েস ছিল মাত্র একুশ। এর এক দশক পরে তিনি লেখেন চারুপাঠ-এর প্রথম খণ্ড (১৮৫৩)। অতপর ১৮৫৪-তে চারুপাঠের দ্বিতীয় খণ্ড ও ১৮৫৯-এ চারুপাঠের তৃতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয়। এর মধ্যেই তিনি লেখেন পদার্থবিদ্যা (১৮৫৬)।
অক্ষয় দত্তের লেখা ভূগোল বইটি তত্ত্ববোধিনী পাঠশালার জন্য রচিত হয়েছিল। তাঁর চারুপাঠ গ্রন্থেও এসেছে ভূগোলের নানা প্রসঙ্গ, যেমন – আগ্নেয়গিরি, জলপ্রপাত, উষ্ণ প্রস্রবণ, হিমশিলা, প্রবাল, সৌরজগৎ, ধূমকেতু। জীব জগতের অনেক বিষয়, যেমন – সিন্ধুঘোটক, বীবর, পুরুভুজ, বনমানুষ, অতিকায় হস্তী, পতঙ্গভুক বৃক্ষ ইত্যাদি এর অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। মনমোহন তর্কালঙ্কার বা বিদ্যাসাগরের শিশু কিশোর পাঠ্যগ্রন্থগুলিও এই সময়ে প্রকাশিত হচ্ছিল। অক্ষয় দত্তও ছোটদের নানাবিষয়ক জ্ঞানবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে এই প্রকল্পে সামিল হন।
অক্ষয় দত্তের যে বইটি তাঁর মনোজগতের দুয়ারকে আমাদের সামনে সবচেয়ে স্পষ্টভাবে উন্মচিত করে সেটি হল বাহ্যবস্তুর সহিত মানব প্রকৃতির সম্বন্ধ বিচার (১ম খণ্ড ১৮৫১, দ্বিতীয় খণ্ড – ১৮৫৩)। তবে মননশীল পাঠকের চিরকালীন সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে তাঁর যে বইটি, সেটি হল ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায় (১ম খণ্ড ১৮৭০, ২য় খণ্ড ১৮৮৩)। এই বইটি বাংলাভাষায় লেখা ভারতের দার্শনিক সাংস্কৃতিক ইতিহাসের প্রথম ক্লাসিক। শুধু বাংলা নয়, কোনও আধুনিক ভারতীয় ভাষাতেই এই ধরনের বই সেকালে আর লেখা হয়নি। বইটির প্রথম খণ্ড প্রকাশের এটি সার্ধ শতবর্ষ। দেড়শো বছর পরেও এই বইটি একালের মননশীল পাঠককে একইভাবে আকর্ষণ করে, আর এ থেকেই বোঝা যায় বইটির বিশিষ্টতা।
বইয়ের প্রথম খণ্ডে বৈষ্ণব, রামানুজ, রামানন্দী, কবীরপন্থী, রয়দাসী, সেনপন্থী, মলূকদাসী, দাদূপন্থী, রামসনেহী, আচারী, মধ্বাচারী, বল্লভাচারী, মীরাবাই, সনকাদি সম্প্রদায়, চৈতন্য সম্প্রদায়, বাউল, ন্যাড়া, সহজী, গৌরবাদী, দরবেশ, সাঁই, কর্তাভজা, রামবল্লভী, সাহেবধনী, আউল, হরিবোলা, রাতভিখারী, বলরামি, সাধ্বিনী, হজরতী, রাধাবল্লভী, কবিরাজী, সৎকুলী, চামার বৈষ্ণব, চরণদাসী, সৎনামী, হরিশ্চন্দ্রী, বৈরাগী, নাগা প্রভৃতি সুপরিচিত ও স্বল্প পরিচিত সম্প্রদায়ের কথা আলোচিত হয়েছে। দ্বিতীয় খণ্ডে ভারতীয় দর্শনের মূল ধারাগুলি – সাংখ্য, যোগ, ন্যায়, বৈশেষিক, পূর্ব মীমাংসা, বেদান্ত, চার্বাক ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা রয়েছে। আজকে ধর্মকে রাষ্ট্রের সঙ্গে মিলিয়ে মিশিয়ে ফেলে যখন হিন্দুত্বকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এক মনোলিথিক চেহারা দেওয়ার চেষ্টা চলছে, তখন অক্ষয় দত্তের নানাত্ববাদী ভারতীয় সাধনার ধারা নিয়ে লেখা এই বইটি প্রকৃত ইতিহাস ও বৈচিত্র্যকে সামনে আনে ও এই সূত্রে তা সমকালে এক বিশেষ গুরুত্বে উপনীত হয়।
- সৌভিক ঘোষাল