আবেদন
সংকল্প দিবসের আহ্বান
san

১৮ ডিসেম্বর ২০২০ কমরেড বিনোদ মিশ্রের দ্বাবিংশতম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৯৯ থেকে এই দিনটিকে, গোটা পার্টি জুড়ে বিপ্লবী শপথকে নতুনভাবে গ্রহণ করার উদ্দেশ্যে  আমরা ‘সংকল্প দিবস’ হিসাবে পালন করে চলেছি। এই বছর আমরা দিনটি উদযাপন করছি অভূতপূর্ব এক কৃষক আন্দোলনের মধ্যে, যার ক্রমবর্ধমান কর্পোরেট আধিপত্য (যাকে আদানি-আম্বানি-কোম্পানি রাজ বলে অভিহিত করা হয়) ও ভারতে ফ্যাসিস্ট দখলদারীর বিরুদ্ধে এক বলিষ্ঠ গণ-প্রতিরোধ হয়ে ওঠার সমস্ত সম্ভাবনা রয়েছে। সদ্য সমাপ্ত  বিহার নির্বাচনের উদ্দীপনাময় সাফল্য আমাদের ভারতবর্ষকে ফ্যাসিবাদের বিপদ থেকে মুক্ত করার চ্যালেঞ্জের আরও সাহসী মোকাবিলার সুযোগ করে দিয়েছে। আমাদের অবশ্যই এই চ্যালেঞ্জের যথাযথ মোকাবিলা, ব্যক্তিগত এবং সমষ্টিগতভাবে নিজেদের তৈরি করতে হবে।

কমরেড বিনোদ মিশ্র পার্টিকে, গণতান্ত্রিক সংগঠনসমূহের বিস্তৃত নেটওয়ার্ক এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণসহ সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক উদ্যোগ পরিচালনাকারী বিপ্লবী কমিউনিস্টদের এক সর্বভারতীয় কেন্দ্র হিসাবে আত্মপ্রকাশে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। পার্টির ক্রমবর্ধমান নির্বাচনী উপস্থিতি সবচেয়ে নিপীড়িত জনগণের মৌলিক মানবিক মর্যাদা থেকে শুরু করে মানুষের অধিকারের সংগ্রামের শক্তিতে অর্জিত নির্বাচনী বিজয়গুলি রক্ষা করা পর্যন্ত আমাদের দৃঢ় আত্মঘোষণার উত্তরণকে এক জীবন্ত ব্যঞ্জনা দিয়েছে। কমরেড ভি এম আমাদের একটি বৃহৎ কমিউনিস্ট পার্টি হয়ে উঠতে অনুপ্রাণিত করেছেন, কিন্তু তা কখনও একটি বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির মূল মতাদর্শগত নোঙরবন্ধনকে, সুস্থ সজীব প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রাণচঞ্চল গণসংস্কৃতিকে এবং সাংগঠনিক ব্যবস্থাকে এতটুকু শিথিল বা দুর্বল না করেই করার কথা বলেছেন। আমরা পার্টির সমস্ত বিকাশ-সম্ভাবনাকে বাস্তবায়িত করার চ্যালেঞ্জ নিয়েছি, তাই পার্টির মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলির প্রতি আমাদের প্রহরাকে সদাজাগ্রত রাখতে হবে।

গোটা ১৯৯০-এর দশক জুড়ে, কমরেড ভি এম ক্রমশ বেড়ে চলা সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদের বিপদ সম্পর্কে পার্টিকে সচেতন করেছেন। বাথানিটোলা গণহত্যাকে তিনি এক নতুন চোখে দেখেছেন – গরিবদের উপর সামন্ততান্ত্রিক হিংসা যে ক্রমশ সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদী আক্রমণ এবং বিপ্লবী বামেদের উপর ভয়ঙ্কর আক্রমণের চেহারা নিতে চলেছে তার অভ্রান্ত সংকেতকে তিনি জোরের সাথে তুলে ধরেছিলেন। এই ইঙ্গিত পার্টিকে  বিজেপি ও সঙ্ঘ বাহিনীর বিরুদ্ধে সংগ্রামে সতর্ক এবং স্থিরসংকল্প থাকতে সাহায্য করেছে যদিও তখন আমাদের বিহারে আরজেডি এবং পরবর্তীতে কেন্দ্রে ইউপিএ সরকারের মোকাবিলা করতে হয়েছে। আজ ভারত এবং ভারতীয় গণতন্ত্রকে মোদী সরকারের ফ্যাসিবাদী আক্রমণ থেকে রক্ষা করাই বাম এবং অন্যান্য বিরোধী শক্তিগুলির কাছে সবচেয়ে বড় নির্ণায়ক চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। এই জন্যই বিহার নির্বাচনে জয় দেশজুড়ে এত অভিনন্দিত হয়েছে। এইজন্যই আমাদের পশ্চিমবঙ্গের বাম-উদারপন্থী শিবিরের কাছে বিজেপি’কে ক্ষমতা দখল থেকে রোখার আবেদন এত ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। মোদী সরকারের ফ্যাসিবাদী আক্রমণ এবং দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক বিপর্যয় বলিষ্ঠ প্রতিবাদ এবং গণবিরোধিতার জন্ম দিয়েছে। হিংসার বিরুদ্ধে বিশিষ্ট লেখক ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের প্রতিবাদ; রোহিত ভেমুলার প্রাতিষ্ঠানিক হত্যার বিরুদ্ধে ছাত্র জাগরণ যা এখন শিক্ষা, কর্মসংস্থান এবং গণতন্ত্রের জন্য তরুণ প্রজন্মের ভারতের (ইয়ং ইন্ডিয়ার) কাছে এক প্রবল আত্মঘোষণা হয়ে উঠেছে; এনআরসি-এনপিআর-সিএএ’র বিরুদ্ধে অভূতপূর্ব প্রতিবাদ যার সামনের সারিতে ছিলেন মুসলিম নারীসমাজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা এবং নাগরিক সমাজের কর্মীরা; মান্দাসৌর গণহত্যার পর কৃষক আন্দোলন যা দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছিল এবং এখন এক ঐতিহাসিক অভ্যুত্থান হয়ে উঠেছে; মহিলা ও মেহনতি জনগণের বিভিন্ন অংশের পর্যাক্রমিক সংগ্রাম – ভয়ঙ্কর নিপীড়ন ও ফ্যাসিবাদী হিংসা, বিদ্বেষ ও মিথ্যা প্রচার, তথ্য বিকৃতিকে স্পর্ধাভরে উপেক্ষা করে গণপ্রতিরোধ ক্রমশ বেড়ে চলেছে। পুলওয়ামার ঠিক পরপর মোদী দ্বিতীবারের জন্য জিততে সক্ষম হলেও, পরবর্তীতে ঝাড়খণ্ড ও বিহার নির্বাচন পরিষ্কার দেখিয়ে দিয়েছে এই প্রতিরোধ নির্বাচনী মল্লভূমিতেও তার দাগ রেখে যেতে কতটা সক্ষম। বিধানসভা নির্বাচনের আসন্ন দফাগুলিতে, বিজেপি’কে আসামে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করা, পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসা রুখে দেওয়া এবং তামিলনাড়ু, কেরালা ও পুদুচেরীতে বিজেপি’র অনুপ্রবেশ রুখে দেওয়ার জন্য সমস্ত রকম চেষ্টা চালাতে হবে।

মোদী সরকারের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস এবং বিধ্বংসী নীতিগুলির বিরুদ্ধে প্রতিরোধের সময় আমাদের অবশ্যই নজর রাখতে হবে আরএসএস-এর দুষ্ট ভূমিকা, তার অতি সূক্ষ্ম জটিল নেটওয়ার্ক এবং তৃণমূল স্তরে তার জনসংযোগ ও সমাবেশিত করার কার্যকলাপের প্রতি। আরএসএস-এর ফ্যাসিবাদী প্রকল্পগুলির বিরুদ্ধে কমিউনিস্টসুলভ আক্রমণ অভিযানে শুধু নিজস্ব কমিউনিস্ট মতাদর্শগত সাহস ও রাজনৈতিক স্বচ্ছতা থাকলেই হবে না, চাই গণকাজের অনমনীয় জেদ আর একনিষ্ঠতা এবং গভীর সযত্ন শ্রমসাধ্য কর্মরীতি যা কমিউনিস্টদের সুবিদিত বৈশিষ্ট্য। কোভিড১৯ অতিমারীর বিশৃঙ্খলা এবং কু-পরিকল্পিত লকডাউনের নিষ্ঠুরতার পরে ভারত মোদী সরকারের হুকুমদারির কাছে নতিস্বীকার করবে না। পাঞ্জাবের কৃষকদের স্পর্ধিত মেজাজ ইতিমধ্যেই দেশজুড়ে সংগ্রামী জনতাকে পুরোনো স্মৃতি ফিরিয়ে আবেগ-উদ্দীপ্ত করে তুলেছে। বিহার নির্বাচনে সিপিআই(এমএল)-এর চমৎকার সাফল্য দেশের বাম শক্তি এবং পরিবর্তনকামী মানুষের মধ্যে নতুন আশা জাগিয়েছে, প্রবল উৎসাহ-উদ্দীপনার সঞ্চার করেছে। অবশ্যই কমিউনিস্ট আন্দোলনের পুনরুজ্জীবন এবং ফ্যাসিবাদী হুমকিকে ব্যর্থ করার জন্য এই নতুন সন্ধিক্ষণকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে হবে।

কেন্দ্রীয় কমিটি, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি   
(মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)   

খণ্ড-27
সংখ্যা-45