২৬ নভেম্বর বিভিন্ন কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নের ডাকা দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘটের পক্ষে সিপিআই(এমএল) তার সমস্ত শক্তি নিয়ে প্রচারাভিযানে সামিল হয়। বিহার নির্বাচনে বামপন্থীদের, বিশেষ করে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের নজর কাড়া সাফল্য কর্মী সংগঠকদের মধ্যে বাড়তি উৎসাহ ও আত্মবিশ্বাস সঞ্চার করে। পার্টির সাধারণ সম্পাদক কমরেড দীপঙ্কর ভট্টাচার্য বেশ কিছু জনসভায় অংশ নেন। কোলকাতার যাদবপুরে, হুগলির কোন্নগরে, উত্তর ২৪ পরগণার বারাসাতে, নদীয়ার ধুবুলিয়াতে, হাওড়ার বালিতে সাধারণ সম্পাদকের সভাগুলিকে কেন্দ্র করে পার্টি কর্মী সমর্থকদের বাইরেও সাধারণ বামপন্থী মানুষের মধ্যে যথেষ্ট আগ্রহ সঞ্চার হয়। বাংলার বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই এই পর্বে সাধারণ সম্পাদকের সাথে সরাসরি বা বৈদ্যুতিন পদ্ধতিতে আলাপ আলোচনায় অংশ নেন এবং ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক লড়াইয়ের ধারণাটিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সক্রিয়ভাবে কাজ করার মনোভাব ব্যক্ত করেন।
ধর্মঘটের সমর্থনে আয়োজিত পথসভাগুলিতে দীপঙ্কর ভট্টাচার্য কেন এই ধর্মঘট তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র ও সাধারণ মানুষের ওপর নামিয়ে আনা হামলাগুলির কথা বলেন। বিশেষভাবে উল্লেখ করেন নয়া শ্রম আইনগুলি কীভাবে দীর্ঘ লড়াইয়ের মাধ্যমে অর্জিত শ্রমিকদের অধিকারগুলি কেড়ে নিতে চাইছে। কাজের স্থায়িত্ব থাকছে না, মালিকদের দিয়ে দেওয়া হচ্ছে যেমন খুশি ছাঁটাইয়ের অধিকার, যতক্ষণ খুশি শ্রমিককে খাটিয়ে নেওয়ার অধিকার। লাভজনক সরকারী সংস্থা সহ গণপরিষেবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন ক্ষেত্র – রেল, ব্যাঙ্ক, বিমা ইত্যাদিরও ব্যাপক বেসরকারীকরণ হচ্ছে। সরকারী ক্ষেত্রের কর্মসংকোচন একদিকে বেকারত্বের সংকটকে তীব্রতর করছে, অন্যদিকে পিছিয়ে পড়া অংশের জন্য বরাদ্দ সংরক্ষণের অধিকার সরকারী চাকরি কমে যাবার মধ্যে দিয়ে কার্যত অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছে।
শ্রম আইনগুলির মধ্যে দিয়ে শ্রমিকের অধিকার কেড়ে নিয়ে মোদি সরকার যেমন মালিকের হাতে লাগামছাড়া মুনাফার অধিকার দিয়ে দিচ্ছে, তেমনি কৃষকের অধিকারকেও কেড়ে নেবার জন্য বেশ কয়েকটি নতুন কৃষি আইন আনা হয়েছে। স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী কৃষকেরা উৎপাদিত ফসলের খরচের ওপর ‘মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস’ দাবি করেছিল। দাবি করেছিল সরকার তাদের থেকে ফসল কিনে নিন। এই দাবিতে সাড়া না দিয়ে মোদী সরকার যে কৃষি আইন বানালো, তাতে দেখা গেল সরকার কৃষকের ফসল ন্যায্য মূল্যে কেনার বদলে কৃষককে কর্পোরেটের সঙ্গে অসম দরদামের বাজারে ছেড়ে দিল। পাঞ্জাবের কৃষকেরা দেশের অন্যান্য অঞ্চলের কৃষকদের তুলনায় গড়পড়তা বেশি সক্ষম, কিন্তু তারাই এই আইনের ফলে সবচেয়ে অসন্তোষ জানিয়েছেন। তারাও মনে করছেন না কর্পোরেট হাঙরদের তারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। ফলে দেশের বাকি অংশের গরিব, মাঝারি কৃষকদের কর্পোরেট গ্রাসের সামনে কি অবস্থা হবে, তা সহজেই অনুমেয়।
শুধু কৃষকই যে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন তা নয়, ক্রেতারাও যে নয়া কৃষি আইনের ফলে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, তার প্রমাণ বাজারে আলু পেঁয়াজের গগনচুম্বী দাম থেকেই টের পাওয়া যাচ্ছে। এতদিন এগুলি ছিল অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের তালিকায়। অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন শিথিল করে এগুলিকে নিয়ে আসা হয়েছে মজুতদারি কালোবাজারির আওতায়। কৃষিপণ্য ব্যবসায় কর্পোরেটের মুনাফা নিশ্চিত করার জন্য মোদী সরকার কীভাবে কাজ করে যাচ্ছে, জনসভাগুলির ভাষণে কমরেড দীপঙ্কর বিশদে তার ব্যাখ্যা করেন।
এই সরকার যে সাধারণ মানুষের না, আদানি আম্বানি ইত্যাদি কর্পোরেটদের সেটা বারবার দেখা যাচ্ছে। লকডাউন কীভাবে অল্প সময়ের নোটিশে জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল, পরিযায়ী শ্রমিক সহ দেশের কোটি কোটি মানুষ কীভাবে এই সময়ে বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে, সেই কথা বলতে বলতেই কমরেড দীপঙ্কর ভট্টাচার্য এই কঠিন সময়ে বামপন্থীদের লড়াকু ভূমিকার কথা উল্লেখ করেন। বারাসাতের সভায় একটি মর্মস্পর্শী ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা তিনি তুলে ধরেন। বিহারের এক নির্বাচনী ক্ষেত্রে বেশ কিছু শ্রমজীবী মানুষকে সিপিআই(এমএল)-এর হয়ে কাজ করতে দেখে তিনি কৌতূহলী হন, কারণ এরা চেনা মুখ নয়। তাঁদের সাথে কথা বলে জানা যায় যে এর আগে তারা বিজেপি সমর্থক ছিলেন। কিন্তু তাদের দলের সাংসদ তাদের সাহায্য করা দূরে থাক, বিপদের সময় ফোনটুকু ধরেননি। অন্যদিকে অযাচিতভাবে অচেনা অজানা বাম কর্মীদের তারা তাদের পাশে পেয়েছেন। এই অভিজ্ঞতা তাদের দৃষ্টিকোণে পরিবর্তন এনেছে। বিহারের নির্বাচনে বামেদের সাফল্যের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লক ডাউনের কঠিন সময়ে মানুষের পাশে থেকে তাদের আস্থা অর্জনের দিকটির ওপর দীপঙ্কর বিশেষ জোর দেন। সেইসঙ্গে উল্লেখ করেন বিহারের নির্বাচনকে একটি আন্দোলনে রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে সাফল্যের কথা। রুটি রুজির লড়াইয়ের কথাকে নির্বাচনে ইস্যু করে তুলতে পারার কথা।
সাধারণ সম্পাদকের জনসভাগুলিতে বিহারের নির্বাচনের পাশাপাশি বাংলার নির্বাচন প্রসঙ্গে শুনতেও শ্রোতারা উদগ্রীব ছিলেন। এই প্রসঙ্গে দীপঙ্কর ধর্মঘটের দাবিগুলিকে নির্বাচনী প্রচারের দিকে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন। নতুন নতুন শ্রম আইন বানিয়ে, কৃষি আইন বানিয়ে, নতুন শিক্ষানীতিকে সামনে এনে দিল্লির সরকার যখন মানুষের অধিকারগুলো কেড়ে নিতে চাইছে, তখন এর বিরুদ্ধে শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, সাধারণ মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদের ছবি সামনে আসছে। অধিকাংশ কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন যখন ২৬ নভেম্বর দেশজোড়া সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে, সেই সময়েই দেশের ছোট বড় প্রায় পাঁচশোটি কৃষক সংগঠন স্লোগান তুলেছে “দিল্লি চলো”। ছাত্ররা কর্পোরেট বান্ধব নয়া শিক্ষা আইন বাতিলের দাবি তুলেছেন। লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্ত সমস্ত সাধারণ পরিবারকে বিশেষ সাহায্য দেবার দাবি উঠেছে। দাবি উঠেছে ক্ষুদ্র ঋণের জালে আটকা পড়া মানুষের ঋণমুক্তির দাবি। উঠেছে সম কাজে সম বেতনের দাবি। আশা, অঙ্গন ওয়ারি, মিড-ডে-মিল কর্মীদের স্থায়ীকরণ, ভাতা বৃদ্ধির দাবিগুলিও উঠে এসেছে জোরালোভাবে। ধর্ম বা বিভাজনের রাজনীতির ভিত্তিতে নয়, এই দাবিগুলোকে জোরদার করে এই সব ইস্যুগুলিতেই যেন ভোট হয় সেটাকে নিশ্চিত করার কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আহ্বান তিনি রাখেন। রাজ্যে তৃণমূল সরকারের অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপ, দুর্নীতি সত্ত্বেও এ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে সিপিআই(এমএল)-এর আক্রমণের মূল নিশানায় যে বিজেপিই থাকবে, বিজেপি তথা ফ্যাসিবাদী শক্তির রাজ্যে ক্ষমতা দখল আটকাতে সর্বাত্মক চেষ্টা করা হবে – সেকথা কমরেড দীপঙ্কর ভট্টাচার্য প্রতিটি জনসভাতেই স্পষ্ট করে দেন।