ভারতের মানুষজনের আর্থিক অবস্থা আর দেশের অর্থনীতির মধ্যে সম্পর্ক খোঁজা বেশ কঠিন হয়ে পড়ছে দিন কে দিন। শহরের জীবন যাপনের নির্দেশকগুলির দিকে চোখ রাখলে অর্থনীতি কেমন চলছে তার হদিশ পাওযা যায় তেমন কোনো জটিল হিসেব নিকেশ ছাড়াই। বাসগুলিতে এখনও অবধি সেই ভিড় চোখে পড়ে না, যদিও সাবধানী উচ্চ মধ্যবিত্তকে খুশি রাখার সংবাদ মাধ্যমগুলি প্রতিনিয়ত বাসে নির্ধারিত সামাজিক দূরত্ব মানা হচ্ছে না বলে সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত সাধারণ মানুষকে গালিগালাজ করে চলেছে। কলকাতার রাস্তায় অনায়াসে ট্যাক্সি পাওয়া যাচ্ছে, কেউ কেউ তেলের দামের জন্য দশ বিশ টাকা বেশি চাইছেন, কেউ কেউ তাও নয়। শপিং মলে এই উৎসবের মরশুমেও ভিড় নেই। রেস্তরাতে নেই দরজার বাইরে লাইন, ভিতরে বসার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধের জন্য আসন কমে যাওয়া সত্বেও। ট্রেনতো সদ্য চলা শুরু করেছে। দূর পাল্লার ট্রেন এখনো নিয়মিত টাইম টেবল মেনে চলছে না। আমাদের সকলের পরিচিত দু-চার জন রয়েছেন যাদের কাজ চলে গেছে বা নিয়মিত বেতন হচ্ছেনা অথবা বেতন কমেছে। বহু পরিবারেই গৃহ-পরিচারিকাদের কাজ গিয়েছে। বিদ্যালয়গুলি খুলছে না, ফলে ছাত্রীছাত্রদের নিয়ে যাওয়া-আসার গাড়িগুলির এখন অবধি কাজ নেই। শিল্পের যে ক্ষেত্রটি কোভিডের ফলে একটুও ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি বা লাভজনক হযেছে, তথ্যপ্রযুক্তি পরিষেবা ক্ষেত্রে বাড়ি থেকে কাজ চলছে, ফলে সংস্থাগুলির দফতরগুলি প্রায় বন্ধ, এমনকি ব্যাঙ্গালোর হায়দ্রাবাদ, চেন্নাই, দিল্লি, কলকাতা, মুম্বাই-এ ভাড়াবাড়িতে থাকা বহু কর্মী নিজেদের পারিবারিক আবাসে ফিরে গেছেন; ফলে সেই বাড়িগুলির ভাড়া থেকে আয়, সেখানকার গৃহ পরিচারিকাদের আয়ও বন্ধ, যেমন বন্ধ ফাঁকা পড়ে থাকা দফতরগুলির উপর নির্ভরশীল বহু অস্থায়ী কর্মী বা ছোট ব্যবসায়ের কাজ। লকডাউনের দুমাস আগে হায়দ্রাবাদ গিয়ে দেখেছিলাম তথ্যপ্রযুক্তি পরিষেবার পেল্লায় পেল্লায় অফিস, আর তার আশেপাশে ভর্তি ভোজ্য-পানীয়ের দোকান। ওয়ার্ক ফ্রম হোমের জগতে সেগুলির ব্যবসা বন্ধ যদি নাও হয়, কমেছে তো নির্ঘাত। ছুটির মরশুমে মধ্যবিত্তের ভ্রমণ মোটামুটি বন্ধ, শীতের মরশুমেও তাতে খুব ফেরবদল হবে মনে হয় না। পরিচিত পরিজনদের প্রায় কাউকেই পুজোয় বা শীতের ছুটিতে কন্যাকুমারি বা কাশ্মীর যাওয়ার পরিকল্পনা করতে শুনছি না। দেশের অর্থনীতিতে জিডিপির ৯%এর কিছুটা বেশি আসে ভ্রমণ শিল্প থেকে। তার সিংহভাগই ধ্বংস হতে বসেছে।
সাদা চোখে যখন এমন মন্দার ছবি চোখে পড়ছে, তখন শুনতে পাওয়া যাচ্ছে, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, অর্থমন্ত্রী, মায় মুডি বলছে, দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে, বর্তমান আর্থিক বছরের তৃতীয় ত্রৈমাসিকে অর্থাৎ অক্টোবর-ডিসেম্বর ২০২০ সময়কালেই নাকি জিডিপির ইতিবাচক বৃদ্ধি হবে। কেবল ভ্রমণ শিল্পেই যে ঘাটতি হবে তাই তো অর্থনীতিকে পিছনে ঠেলতে যথেষ্ট, কারণ এই ত্রৈমাসিকটি ভারতে ভ্রমণের সব থেকে ব্যস্ত সময়, তাছাড়া সরকার এলটিসি বা ছুটিতে ভ্রমণের টাকাকে অন্যখাতে ব্যয়ের জন্য ছাড় দিয়ে দিয়েছে। ফলে যা সাধারণ মানুষ অনুভব করছে বা সাধারণ বুদ্ধিতে অনুভূত হচ্ছে তার সঙ্গে অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান বা অর্থমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর অনুধাবনের বেশ গরমিল রয়েছে। ওদিকে সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনোমির তথ্য অনুযায়ী অক্টোবর মাসে কর্মসংস্থান বা কাজ কমেছে ৫.৫ লক্ষ মানুষের; কাজ করতে ইচ্ছুক কিন্তু কাজ পাচ্ছে না এমন লোকের সংখ্যা অর্থাৎ বেকারের সংখ্যা বেড়েছে ১ কোটি ২০ লক্ষ, অক্টোবর মাসে। অক্টোবর মাসে শ্রমশক্তিতে অংশ গ্রহণের হার (লেবার ফোর্স পার্টিসিপেশন রেট বা এলএফপিআর), কর্মসংস্থানের হার ও বেকারির হার এই ৩টি সূচকেই অর্থনীতির বেহাল অবস্থা পরিলক্ষিত হয়েছে। এলএফপিআর দাঁড়িয়ে রয়েছে ৪০.৭%-এ, বেকারির হার সেপ্টেম্বরের ৬.৭% থেকে বেড়ে ৭% হয়েছে, কর্মসংস্থানের হার ৩৮.0% থেকে কমে ৩৭.৮% হয়েছে। অক্টোবর মাস উৎসবের মাস হওয়া সত্বেও শ্রম নিয়োগের ক্ষেত্রে এই ছবি কোনোমতেই উৎসাহ ব্যঞ্জক নয়। এলএফপিআর বলতে ১৫ বছরের উপরে বয়স্ক জনসাধারণের মধ্যে কাজ করতে ইচ্ছুক জনগণের অনুপাতকে বোঝানো হয়। সেই অনুপাতটি ক্রমাগত গত কয়েক বছরে কমেছে। সাম্প্রতিক অতীতে লকডাউনের আগে যে অনুপাত ছিল অক্টোবর মাসে তার তুলনায় সেই অনুপাত ২% কম। সিএমআইই-র তথ্য অনুযায়ী ২০১৬-১৭ সালে এলএফপিআর ছিল ৪৬.১%, ২০১৭-১৮ সালে নোট বাতিল ও জিএসটি’র প্রভাবে তা ২.৫৬% কমে যায়, ২০১৮-১৯এ কমে ০.৭৭%, ২০১৯-২০তে ০.১৪% কমে পৌঁছয় ৪২.৭%-এ। আগেই বলেছি অক্টোবর মাসে তা আরো ২% কমে ৪০.৭% হয়েছে। ফলে কর্মক্ষম জনসাধারণের মধ্যে কাজ করতে ইচ্ছুক মানুষের সংখ্যা কমছে। অন্যদিকে এমপ্লয়মেন্ট রেট বা কর্মসংস্থানের হারও কমেছে। ২০১৬-১৭ সালের ৪২.৭% থেকে ২০১৮-১৯ সালে ৪১.৬%, ২০১৮-১৯ বছরে ৪০.১% ও ২০১৯-২০ সালে ৩৯.৪% হওয়ার পরে অক্টোবরে তা আরো ১.৬% কমে দাঁড়িয়েছে ৩৭.৮%-এ।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা বা আইএলও-র মডেল অনুসারে সারা বিশ্বে কর্মক্ষম বয়সের জনসংখ্যার ৫৭.২% কাজ করছে। ওই মডেল অনুসারে ভারতের ক্ষেত্রে ওই হার ৪৭%, দক্ষিণ এশিয়াতে ৪৮%, পাকিস্তানে ৫০%, শ্রীলঙ্কায় ৫১% ও বাংলাদেশে ৫৭%। চিনের হার অনেক বেশি, ৬৫%। ফলে ভারতকে বিশ্বমানে বা প্রতিবেশি দেশের সমমানে পৌঁছতে গেলে বহুদূর পথ যেতে হবে। ভারতের জিডিপি সাম্প্রতিক অতীতে দ্রুত বাড়ছিল। কিন্তু নিয়োজিত জনসংখ্যা কমছিল। মোট নিয়োজিতের সংখ্যা ২০১৬-১৭ সালে ৪০.৭ কোটি থেকে কমে ২০১৯-২০ তে ৪০.৩ কোটিতে পৌঁছেছিল। অক্টোবর, ২০২০ তে তা ৪ কোটির নিচে নেমেছে। ফলে দেশে আগেই কর্মহীন বৃদ্ধি বা জবলেস গ্রোথ হচ্ছিল, তা আরো প্রকট হয়ে উঠছে। একদিকে জনসংখ্যা বাড়ছে, অন্যদিকে কর্মসংস্থান কমছে।
দেশ জোড়া কর্ম সংস্থানের এই দুরবস্থার মধ্যে যখন অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর কথা, আত্মনির্ভর ভারতের কথা শোনানো হয়, তখন সন্দেহ জাগে সত্যিটা কী? গ্রাম শহরের সরকারি বিদ্যালয়ে পড়াশোনা বন্ধ, সেইসব সাধারণ ছেলে মেয়েরা গত ৮-৯ মাস কোনো পড়াশোনার মধ্যে নেই, সরকারের চর্চায় তাদের কোনো কথা নেই। বিশ্বব্যাঙ্কের সমীক্ষা অনুযায়ী শিক্ষায় এই দীর্ঘ লকডাউনের জন্য ভারত প্রায় ২৯ লক্ষ কোটি টাকার সম্মুখিন হবে। মনে রাখা দরকার অনলাইন শিক্ষার ফলে বিত্তবান বেসরকারি বিদ্যালয়ের ছাত্রীছাত্ররা নিম্নবিত্ত ছাত্রদের থেকে অনেক বেশি সুবিধেজনক অবস্থানে আছে। ফলে এই ক্ষতির ভার বহন করতে হবে গরিব পরিবারের ছাত্রীছাত্রদের। একইভাবে প্রতিষ্ঠিত শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলিতে মজুরির তথ্য অনুযায়ী এপ্রিল-জুন ত্রৈমাসিকে মজুরি বৃদ্ধি পেয়েছে চলতি মূল্যে টাকার অঙ্কে ২.২%, জুলাই-সেপ্টেম্বরে তার পরিমাণ ৫%এর আশেপাশে হবে। ফলে সামগ্রিকে তা ৩-৩.৫% হবে। যেহেতু মূল্যবৃদ্ধির হার ৬-৭%এর উপরে যাচ্ছে তাই ওইসব তালিকাভুক্ত কোম্পানিতেও এপ্রিল-সেপ্টেম্বর ষান্মসিকে প্রকৃত মজুরি কমবে। ওই ধরণের সংগঠিত ক্ষেত্রের সংস্থাগুলিতে যখন এই হাল, তখন অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের মজুরি ও নিয়োগের হারের করুণ অবস্থা আন্দাজ করা যেতে পারে।
কর্মসংস্থান, বেকারি, সমস্ত বিষয়ে যখন সাধারণ বিত্তহীন মানুষ দুর্বিপাকে, ঠিক তখনই শেয়ার বাজার অতিদ্রুত বেড়ে চলেছে। লকডাউনের সময়ে শেয়ার সূচকে যে ধ্বস নেমেছিল তাকে পূরণ করে তা উপর দিকে চলেছে। বাস্তব অর্থনীতির সঙ্গে লগ্নিপুঁজির অর্থনীতিতে কতটা সম্পর্করহিত তা ফাটকা বাজার দেখলে বোঝা যাচ্ছে। একই সঙ্গে নিম্নবিত্ত জনতার উপরে চাপ বাড়াচ্ছে ভোগ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির হার। গত সাড়ে ছয় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছেছে সেই হার ৭.৬১%। মনে রাখা দরকার ব্যাঙ্কের ফিক্সড ডিপোজিটে সুদের হার কমতে কমতে ৬%এর নীচে নেমে গেছে। ফলে অর্থনীতির ভাষায় প্রকৃত সুদের হার এখন ঋণাত্মক। কেবল ভোগ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ঘটছে তাই নয়, পাইকারি মূল্যও অক্টোবরে বেড়েছে ১.৪৮%, গত ৮ মাসে সর্বোচ্চ।
সাধারণ যুক্তিতে বোঝাই যায় যে, যাতায়াতের উপরে আরোপিত বিধিনিষেধ যখন উঠে যাচ্ছে, মানুষ আস্তে আস্তে যখন স্বাভাবিক জীবনে ফিরছে তখন অর্থনৈতিক কাজকর্ম কিছুটা বাড়বে। কিন্তু তা দেশের অর্থনীতিতে কাঙ্খিত গতি আনবে তেমনটা নাও হতে পারে। পরপর দুটি ত্রৈমাসিকে ঋণাত্মক অর্থনৈতিক বৃদ্ধি পরিলক্ষিত হয়েছে। ফলে তাকে অর্থনীতির পরিভাষায় মন্দার আক্রমণ বলা যেতে পারে। কিন্তু, যেহেতু, তা বাহ্যিক কারণে, একটি অতিমারীর কারণে ঘটেছে তাই স্বাভাবিক অর্থনীতির সংজ্ঞায় একে মন্দা বলে অভিহিত করা যায়না। তবে যদি এই বছরের শেষ দিকে অর্থনৈতিক বৃদ্ধিতে দেশ পৌঁছায়ও, তা সম্ভবত সরকারী পরিসংখ্যানেই ঘটবে। কারণ সরকারী পরিসংখ্যান অত্যন্ত বেশি সংগঠিত ক্ষেত্রের উপর নির্ভরশীল। অসংগঠিত বা ইনফর্মাল সেক্টরের তথ্যের সঙ্কলন হয় না, তার অনুমান করা হয় সংগঠিত ক্ষেত্রের উৎপাদন, মূল্য সংযোগের তথ্যের উপর নির্ভর করে। যেহেতু এই পুরো অতিমারির প্রক্রিয়ায়, নোট বাতিলে, জিএসটি’তে অসংগঠিত ক্ষেত্রটি অনেক বেশি আক্রান্ত হয়েছে তাই সংগঠিত ক্ষেত্রের উপর নির্ভর করে অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি হিসেব করা ভুল হবে, উদ্দেশ্যপ্রণীতভাবে করে তা হবে অনাচার। যে অনাচারের অন্যায় শাসক দলের রীতি কারণ তারা মনে করে আদানির উন্নতি হলেই দেশের রামা কৈর্বর্ত্য ও রহিম শেখের শ্রীবৃদ্ধি ঘটে। আম্বানির সম্পদ বৃদ্ধি পাওয়ার অর্থ যে রাস্তার ধারের হকার বা চা-দোকানির সম্পদশালী হয়ে ওঠা নয়, এটা তারা জানলেও প্রচার অন্যরকম করে।
- অমিত দাশগুপ্ত