(বিহার বিধানসভা নির্বাচন, ২০২০-তে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের সাফল্য সম্পর্কে বিজেপি-আরএসএস-এর ফ্যাসিবাদী অ্যাজেন্ডার বিরোধিতার দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজের বিভিন্ন মহল থেকে মূল্যবান রাজনৈতিক বিশ্লেষণ উঠে এসেছে। তার থেকে কিছু প্রতিনিধি স্থানীয় প্রাসঙ্গিক বক্তব্য দেশব্রতীর পাতায় তুলে ধরার আগ্রহ থাকবে। এবারের সংখ্যায় ‘দ্য প্রিন্ট’, ১২ নভেম্বর ২০২০তে প্রকাশিত বিশিষ্ট রাজনীতিক, ‘রাষ্ট্রীয় দলিত অধিকার মঞ্চে’র আহ্বায়ক এবং গুজরাট বিধানসভার নির্দল বিধায়ক জিগনেশ মেভানির ভাষ্যটির ভাষান্তর পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল -সম্পাদকমণ্ডলী)
‘নকশালবাদী’, ‘সন্ত্রাসী-দরদী’, ‘চিনের মদতপুষ্ট মাওবাদী’; ‘টুকরে টুকরে গ্যাং’ - এইসব অভিধায় ক্লান্তিহীন অপপ্রচার সত্ত্বেও, বিহারে সিপিআই(এমএল) লিবারেশন ১২টি আসনে জিতেছে।
বিহারে এনডিএ সরকার গঠনের জন্য তৈরি। তাই এসময় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সেই দুর্দমনীয় ‘মোদী রথ’ নিয়ে ব্যাপক চর্চা চলেছে। ভারতীয় জনতা পার্টির বিরাট লাভে, মনে হওয়া স্বাভাবিক যে ভিন রাজ্যে খাটতে যাওয়া বিপুলসংখ্যক শ্রমিক, যারা কোভিডের কারণে লকডাউনে নিজেদের ঘরে ফেরার জন্য লাখে লাখে রাস্তায় নেমে চরমতম দুর্দশার শিকার হয়েছেন, তারাও মোদীর পক্ষে ভোট দিয়েছেন। কিন্তু একটা অবিশ্বাস্য বিষয় হল, বিজেপি’র উপস্থিতি সত্ত্বেও, বিরোধী শিবিরে সর্বোচ্চ স্ট্রাইকিং রেটটি কিন্তু সিপিআই(এমএল) লিবারেশন পরিচালিত বাম জোটের দখলেই!
সিপিআই(এমএল) লিবারেশন ১৯টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ১২টিতে জিতেছে, যদিও আরও কয়েকটি আসনে পুনর্গণনা চেয়েছে। এই সাফল্য এসেছে, ‘নকশালবাদী’, ‘সন্ত্রাসী-দরদী’, ‘চিনা মদতপুষ্ট মাওবাদী’, ‘টুকরে টুকরে গ্যাং’ এইসব অপবাদ দিয়ে মাসের পর মাস অপপ্রচার সত্ত্বেও ।
নকশালবাড়ি আন্দোলনের পর ৭০এর দশকে দলটির প্রথম আত্মপ্রকাশ। কিন্তু ৮০-র দশকে দলটি মূলধারার নির্বাচনী রাজনীতিতে গভীরভাবে ঢুকে পড়ে। তখন থেকে সিপিআই(এমএল) লিবারেশন গ্রামীণ দরিদ্র সমাজের অন্যতম ‘মুখ’ হয়ে ওঠে। আর সেই থেকে দলটি ঐ অঞ্চলের জাতপাত-বিরোধী রাজনীতির ব্যাকরণ পাল্টে চলেছে । কাকতালীয়ভাবেই, যদিও দলটি মতাদর্শগতভাবে বিজেপি’র একেবারে বিপরীত অবস্থানে রয়েছে, দু’টির মধ্যে একটি সাধারণ বিষয়ে মিল আছে – দু’টি দলেই একেবারে নিচুতলা থেকে সংগঠন করা সত্যিকারের দায়বদ্ধ ক্যাডার বাহিনী রয়েছে।
এই ক্যাডার বাহিনী, শুধু যে ২০২০র নির্বাচনের জয়গুলি ছিনিয়ে এনেছে তাই-ই নয়, ভবিষ্যৎ রাজনীতির প্রশ্নে আরও কিছু অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়কে প্রতিষ্ঠিত করেছে। বিহারে সামাজিক ন্যায়ের বলিষ্ঠ রাজনৈতিক সংস্কৃতি সত্ত্বেও, প্রধান উপকারভোগী বলতে, অন্যান্য পিছিয়ে থাকা শ্রেণিগুলির মধ্যে প্রাধান্য বিস্তারকারী গোষ্ঠী হিসাবে যাদবরাই ছিল দীর্ঘদিন ধরে এবং দলিতদের মধ্যে ছিল ‘পাসোয়ান’। ভূমিহীন শ্রেণিগুলির জমি-ভিত্তিক লড়াই থেকে উঠে আসা দলটি আজ মূলধারার রাজনীতির অভিমুখী হতে পেরেছে - সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের সাফল্য এটাই। দলিত এবং মুসাহার মহাদলিত, যাদের পরিবারগুলি ১৯৯০-র দশকে রণবীর সেনার কুখ্যাত সশস্ত্র ভূমিহার বাহিনীর সংঘটিত গণহত্যার শিকার হয়েছিল, তাদের প্রতি এই দলের সমর্থন সুবিদিত। গত বছর ১৯১৯এর লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে আমি বিহারে ছিলাম। সেই সময় নজরে আসে গ্রামীণ বিহারের বিভিন্ন অংশে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের উদ্যোগে তৈরি বাথানিটোলা, লক্ষ্মণপুর বাথে, শঙ্করবিঘা এবং অন্যান্য আরও বহু অঞ্চলে গণহত্যায় নিহত মানুষদের স্মৃতিরক্ষায় তৈরি স্মৃতিফলকগুলি। দেখে তো আমি অভিভূত!
সিপিআই(এমএল) লিবারেশন দলিতদের দরিদ্রতম অংশের মধ্যে নিজের ভিত্তি ধরে রাখার সাথে সাথে বেকারত্ব, কৃষি বিল এবং ভিন রাজ্যে খাটতে যাওয়া শ্রমিকদের সঙ্কটের মত জ্বলন্ত সমস্যাগুলিকে তুলে নিয়েছে। সামাজিক ন্যায়ের মণ্ডল-উত্তর রাজনীতির ভূমিতে সিপিআই(এমএল) লিবারেশন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার রাজনৈতিক প্রশ্নগুলিকে উন্নীত করেছে নতুনতর আঙ্গিকে। বেসরকারীকরণ -জাতপাত, জমির মালিকানা, বস্তুগত সম্পদ-ভিত্তিক প্রশ্নে কীভাবে কতটা প্রাসঙ্গিক তার আলোচনাকে, তার জাতপাত-বিরোধী রাজনীতির পুরোভাগে রেখেছে। শুধু তাই-ই নয়, বাম নেতৃত্বে ব্রাহ্মণ্য, সাবর্ণ-আধিপত্যের প্রচলিত ধারণা থেকে দলটি সরে এসেছে - বিহার নির্বাচনে একজনও উচ্চ বর্ণের প্রার্থী রাখেনি।
আজ বিজেপি আগের যে কোন সময়ের চেয়ে শক্তিশালী। কিন্তু কৃষক-সম্পর্কিত আইনগুলি রাজ্যগুলিকে, এমনকি বিহারকেও সংকটে ফেলে দিয়েছে। এক্ষেত্রে চালু যুক্তিটি হল, আইনগুলি কিছু প্রতিকূল প্রভাব ফেলবে শুধু বৃহৎ, জমির মালিক উচ্চ বর্ণের কৃষকদের উপর। কিন্তু প্রতিবাদের স্বর উঠে এসেছে বাম ও দলিত কণ্ঠ থেকে, যাদের মধ্যে রয়েছেন নির্বাচিত বিধায়ক মনোজ মঞ্জিল, যিনি ক্ষুদ্রতর চাষিদের উপর বাজার-চালিত সংস্কারের প্রভাবের বিরুদ্ধে প্রচার করেছেন, তার সঙ্গে ছিলেন অন্য প্রার্থীরাও। মে মাস থেকে, ভিন রাজ্যে খাটতে যাওয়া লক্ষ লক্ষ শ্রমিক পায়ে হেঁটে ঘরে ফেরার জন্য রাস্তায় নামার পর থেকে সিপিআই(এমএল) লিবারেশন ও তার ছাত্র সংগঠনগুলি ফিরতে থাকা শ্রমিকদের সাহায্য ও ত্রাণের ব্যবস্থা করা, চাঁদা এবং খাবার যোগানোর জন্য তাদের কষ্টার্জিত সীমিত সম্পদ ব্যয় করেছে। বিহারী millennial-দের বেশির ভাগই ৩০ বছর আগে ঘটে যাওয়া মণ্ডল রাজনীতি দেখেনি। এ ছাড়াও, প্রথমবারের ভোটদাতাদের জন্য, মহাগঠবন্ধন বেকারত্ব, অতিমারীর মধ্যে পরীক্ষা নেওয়ার বিরুদ্ধে ছাত্রদের প্রতিবাদ, শ্রমিকদের সংকট এবং কৃষি আইনের প্রশ্ন তুলে এনে জাতপাতের রাজনীতির সমান্তরালে চাকরি, শ্রম অধিকার এবং বেপরোয়া বেসরকারীকরণ সংক্রান্ত ইস্যুগুলিকে অগ্রাধিকার দিয়েছে।
১৯৯০-এর দশক সামাজিক ন্যায়ের লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারগুলি দেখেছে। কিন্তু তার সঙ্গে বেসরকারীকরণের বৃহৎ সংস্কারের তাৎপর্যবাহী পর্বও দেখেছে। আজ মোদী সরকার একে আরও বিস্তৃত করেছে রেলের বেসরকারীকরণের দরজা খুলে দিয়ে এবং কৃষি আইন চালু করে। আমাদের দরকার সেই সব রাজনৈতিক দল, যারা জাত, বর্ণ এবং শ্রেণীকে একসাথে চিন্তার পরিসরে জায়গা করে দেওয়ার অনুশীলনটি আত্মস্থ করছে এবং অবশ্যই যাদের ভিত্তি ভূমিতে সংগঠনরত দক্ষ ক্যাডার বাহিনী আছে যারা এই প্রশ্নগুলিকে সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে যাবেন, ‘রাম মন্দির’ বা ‘কাশ্মীরে জমি কেনা’র প্রস্তাব বা ‘পাকিস্তানে চাকরি’র মতো শূন্যগর্ভ বাগাড়ম্বরের দ্বারা প্রতারিত হওয়ার আগে। সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের এই জয় প্রমাণ করে – এই সমস্যাগুলো ঘিরে উদ্বেগ বাস্তবেও রয়েছে – আমাদের এখন যা দরকার তা হল ‘বহুজন’ জনতার জন্য একেবারে মাটিতে থেকে, এই উদ্বেগের প্রহর অতিক্রমের জন্য কাজ করবে এমন কিছু ‘বিরোধী’ দল।
কয়েকদিন আগে, গুজরাটে একটি কেমিক্যাল বয়লার ফ্যাক্টরিতে বিস্কোরণে ১২ জন শ্রমিকের মৃত্যু ঘটেছে। সংবাদ মাধ্যমের সামান্য কয়েকটি রিপোর্টে এই ঘটনা প্রসঙ্গে ম্যানেজমেন্টের গাফিলতি এবং কারখানার শ্রমিকদের শোষণের কথা বলা হয়েছে। নিহতদের পরিবারের সঙ্গে দেখা করে জানতে পারলাম তাদের প্রায় সকলেই দলিত-বহুজন সম্প্রদায়ের। ১২ জন শ্রমিকের এই মৃত্যুও জাতি-উৎপীড়নের এক নজির, কিন্তু আমাদের রাজনীতি এখনও এই ধরনের শ্রমিকদের প্রতি এই শোষণকে তাদের জাতিগত পরিচয়ের ভিত্তিতে বিচার করে দেখে না। সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের মতো রাজনৈতিক দলগুলো যা করেছে , তা থেকে প্রমাণ হয় যে রুটি-রুজির প্রশ্ন হোক, চাকরি বা জমির মালিকানার প্রশ্নই হোক - সবকিছুই জাতিগত নির্যাতনের সঙ্গে মজ্জায় মজ্জায় জড়িয়ে আছে। বিজেপি’র অ্যাজেন্ডার বিরুদ্ধে সফল হতে চাই একটি বলিষ্ঠ জাতপাত-বিরোধী রাজনীতি। আর তার জন্য আমাদের অবশ্যই প্রতিনিধিত্ব এবং সামাজিক ন্যায়ের সাথে সাথে এই প্রশ্নগুলোকে সামনে তুলে ধরতে হবে।