টিএমসি সরকার বিরোধী প্রবণতার উপর জোর দিয়ে বামপন্থীদের শক্তিবৃদ্ধি সম্ভব হবে না
tm


(বিহার বিধানসভা নির্বাচনে ৬০%-এর বেশি আসনে সাফল্যের হারের ফলাফল বামপন্থিদের মধ্যে, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে ২০২১ নির্বাচনের আগে, আশা জাগিয়েছে। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী), বা সিপিআই (এমএল)এর সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য, বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকার ভাষ্যকার অরিন্দম রায়ের সঙ্গে এক সাক্ষাতকারে, সাম্প্রতিক বিহার নির্বাচন, পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থিদের রণনীতি, এবং তার ভবিষ্যত নিয়ে কথা বলেন। এখানে তার অংশবিশেষ প্রকাশ করা হল।)

আপনারা যে ১৯টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছিলেন তার মধ্যে ১২টিতে জয় করবেন বলে আশা করেছিলেন? বিহারে বামপন্থীদের জন্য কী পরিবর্তন ঘটেছিল?

আমরা ১৫টি আসনে জয়ের প্রত্যাশী ছিলাম এবং খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছিলাম। একটি আসনে ৪৬২ ভোটে হেরেছি, এবং সিসি টিভি ফুটেজ দাবি করেছি। আরেকটি আসনে ভোটের তফাৎ ৩,০০০-এর আশেপাশে। বিহারে নির্বাচন এক খাঁটি গণআন্দোলনে রূপান্তরিত হয়েছিল যার সামনের সারিতে ছিল যুবকেরা ও ঘরছাড়া শ্রমিকরা। লকডাউনের অভিজ্ঞতা আগুনে ঘি ঢেলেছিল। জনতা দুই ইঞ্জিনের সরকারের ফাঁকা আওয়াজের মানে অনুভব করতে পেরেছিল এবং সিপিআই(এমএল) ও অন্যান্য বামপন্থী শক্তির গুরুত্বও অনুধাবন করতে পেরেছিল। যে সরকারকে জনগণ ভোটে নির্বাচিত করেছিল তার দ্বারাই প্রত্যাখ্যাত ও অপমানিত হওয়াটা মানুষ বুঝতে পেরেছিল, এবং বিরোধী মোর্চার দিকে ভোট দিতে জনগণ সংকল্পবদ্ধ হয়েছিল।

মহাজোট নির্বাচনে জিততে পারল না কেন? কোথায় আপনাদের ঘাটতি হল?

মহাজোট তৈরি হতে এত দেরি হল, তবুও তা এনডিএ সরকারকে ক্ষমতা থেকে প্রায় অপসারণ করার মত এত শক্তিশালী একটা ঢেউ তৈরি করতে সমর্থ হল। এটা একটা বিরাট পরিবর্তন, ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে বিহারে এনডিএ-র সার্বিক জয়ের বিশাল বিপরীতযাত্রা। যদি জোটটা একটু আগে তৈরি হত এবং আসন সমঝোতা আরো বেশি বাস্তবসম্মত ভিত্তিতে করে সিপিআই(এমএল) ও অন্যান্য বামেদের আরো কিছু বেশি আসন দেওয়া হোত, তাহলে ফলাফল অন্যরকম হত। বিজেপি’র বিষাক্ত নোংরা প্রচার সত্বেও প্রথম পর্যায়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা ৮টির মধ্যে ৭টি আসনে আমরা জিতেছি। আমাদের শক্তিশালী জায়গা দক্ষিণ বিহারে মালেকে আরো ১০টি আসন ছাড়লে নির্বাচন মহাজোটের পক্ষে প্রথম পর্যায়েই নির্ধারিত হয়ে যেত।

আপনি কি মনে করেন যে, রাজ্যে এবং সেভাবে বললে সারা দেশে নরেন্দ্র মোদীর জনপ্রিয়তা এখনো অটুট রয়েছে?

এটা ভুললে চলবে না যে মোদী-পূর্ববর্তী বিজেপি ২০১০ সালে বিহারে ৯০এর বেশি আসন পেয়েছিল। জেডি(ইউ) তখন ১১৫টি আসনে জিতেছিল। বিহারে নীতীশ কুমার সরকারের ১০ বছরের ও কেন্দ্রে  মোদী শাসনের ৬ বছরের পরে এনডিএ-র আসন ৮০টির বেশি কমেছে। বিজেপির আসল সাফল্য হল এই যে তারা নীতীশ কুমারের অধিকতর ক্ষতি করতে পেরেছে, যার ফলে জেডি(ইউ)-র ৭০এর থেকে বেশি আসন কমেছে, যেখানে বিজেপি নিজের ক্ষতি ১৫টি আসনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু এটি পরিস্কার যে মোদীর জনপ্রিয়তা যথেষ্ট ক্ষয় পেয়েছে এবং জনগণের উপরে তার বাকচাতুর্যের সেই মনভোলানো প্রভাব আর নেই।

আপনি কি মনে করেন যে বামপন্থীরা বাংলায় পুনরুজ্জীবিত হতে পারবে, যেখানে বিজেপির উল্কার মতো উত্থান ঘটেছে?

বিজেপি ও সঙ্ঘবাহিনীর বিপর্যয় সৃষ্টিকারী নীতি ও রাজনীতির সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ আদর্শগত রাজনৈতিক বিপ্রতীপ হিসেবে বামেরাই রয়েছে। বিহারে আমাদের পার্টির উপরে বিজেপি’র জঘন্য আক্রমণ এই বক্তব্যকে জোরদার করেছে এবং গণতন্ত্রের জন্য লড়াইএ বামপন্থিদের শক্তিকে তুলে ধরেছে আমাদের নির্বাচনী সাফল্য। ১৯৭০এর জরুরী অবস্থার সময়ে গণতন্ত্রের পুন:প্রতিষ্ঠার লড়াই বামপন্থীদের জনপ্রিয় করে তুলেছিল। ফ্যাসিবিরোধী প্রতিরোধ এবং জনগণের অধিকারের জন্য বহমুখি সংগ্রাম আজকের প্রেক্ষিতে সিপিআই(এমএল)-কে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে।

বিজেপিকে বৃহত্তর শত্রু বলে চিহ্নিত করে তৃণমূল কংগ্রেস(টিএমসি)-কে ছাড় দেওয়ার যে কথা আপনি বলছেন সীতারাম ইয়েচুরি ও বিমান বসু তাকে বাতিল করছে। তাঁরা বলছেন যে বিজেপি ও টিএমসি-কে সমানভাবে আক্রমণ করতে হবে। আপনার ভাবনা...

আমি কখনো চাইনি যে বামেরা টিএমসির প্রতি নরম হোক; আমি বলেছি যে বিজেপিকে বাংলায় প্রতিরোধহীনভাবে বামেরা যেন বাড়তে না দেয়। বিজেপি ও টিএমসিকে এক করে দেখা পশ্চিমবঙ্গের সমাজের কোন অংশই গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করেনি – সেই সমান ভাবে দেখার তত্ব সিপিআই(এম)-কে কেবল দ্বিমুখি চাপে ফেলছে; যারা টিএমসি-কে মূল লক্ষ্য মনে করে তারা বিজেপি’র দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে এবং বিজেপি’র উত্থানে বিব্রত মানুষজন টিএমসির’র দিকে সরে যাচ্ছে। কেবল টিএমসি সরকার বিরোধিতার বাজনা বাজিয়ে বামেরা শক্তিশালী হতে পারবে না।  

২০১৯এর নির্বাচনে বিজেপি ৪০% ভোট পেয়েছিল। রাজ্য ক্রমাগত বিজেপি ও টিএমসি’র মধ্যে মেরুকৃত হচ্ছে। কীভাবে বামেরা নিজস্ব জায়গা তৈরি করতে পারবে?

লোকসভা ও বিধানসভা  নির্বাচনের প্রেক্ষিত আলাদা। মোদীর দ্বিতীয় দফা দেশের পক্ষে এক নিরবিচ্ছিন্ন বিপর্যয়ে রূপান্তরিত হচ্ছে। শ্রমিক, কর্মপ্রার্থী যুবক এবং সাধারণ জনগণ বেসরকারিকরণ এবং অর্থনৈতিক বিপর্যয়, বিপুল কর্মহীনতা, মজুরি ছাঁটাই, মূল্যবৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতার ধাক্কার মুখোমুখি হচ্ছে। এই অবস্থায় বিজেপি’র ভোট মারাত্মকভাবে কমতে পারে।

বিজেপি’র ২০১৯ লোকসভার ভোটের সঙ্গে ঝাড়খন্ড ও বিহারের বিধানসভা নির্বাচনের ভোটের তুলনা করলে আমরা কীভাবে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির ভোট কমতে পারে তার একটা পরিস্কার ধারণা পেতে পারি।

পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থী আন্দোলনের এক শক্তিশালী ঐতিহ্য আছে, ২৬ নভেম্বরের ধর্মঘটের সাড়া এবং কৃষকদের প্রতিবাদ বামেদের জন্য বিপুল সম্ভাবনার প্রতি ইঙ্গিত করছে। মূল বিষয়টি হল যে এই ধারাটা বজায় রাখতে হবে এবং বিজেপি’কে আবহাওযাকে বিষিয়ে দিতে, বিষয়বস্তুকে বিপথগামী করতে এবং জনগণের ক্রোধকে হাইজ্যাক করতে এবং তাকে তাদের বিভাজনের কর্মসূচীর অনুকূলে নিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না।

অনেকেই বলেন যে বিজেপি’র উত্থান বামেদের পতনের বিনিময়ে ঘটছে বলে মনে হয়। যখন আপনি বলছেন যে, বিজেপি অনেক বড় বিপদ, তখন কি আপনি মনে করেন না যে তা ভোটারদের আরো দূরে ঠেলে দেবে?

পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির উত্থান সমস্ত দলের ক্ষতি করেই হয়েছে, কংগ্রেস, টিএমসি এবং বাম। আমরা বামেদের ভোটের অংশ কমে যাওয়াতে চিন্তিত কারণ বিজেপির সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিস্ট রাজনীতির বিরুদ্ধে আদর্শগতভাবে সবথেকে বেশি দৃঢ় এবং দায়বদ্ধ থাকা উচিৎ বাম ভোটারদের। প্রথমত, সংজ্ঞাগতভাবেই বাম ভোট বিজেপিবিরোধী হওয়ার কথা। টিএমসি’র বিরুদ্ধে ক্রোধের কারণে বিজেপি’র পক্ষে ভোট দেওয়া বাম ভোটারদের পক্ষে আত্মঘাতী হবে, আমরা কেন বামেদের বলশালী করে একটি কার্যকরী রাজনৈতিক বিকল্প হিসেবে তাকে জনগণকে একত্র করার ক্ষমতাশালী কেন্দ্রে পরিণত করতে পারব না?

খণ্ড-27
সংখ্যা-43