প্রতিবেদন
‘বাড়িতে থাকুন, সুস্থ থাকুন’!
ddareee

লকডাউন পরিস্থিতিতে এমন আবেদন রাখা হয়েছিল সর্বসাধারণের কাছে। আপাতত সংক্রমণ তুঙ্গে থাকলেও লকডাউন নেই। যথাযথ নিরাপত্তা নিয়ে বেরোতে বাধা নেই। কিন্তু এই আবেদন, থুড়ি, নির্দেশটা মেয়েদের জন্যে একটা ‘স্ট্যান্ডিং অর্ডার’, সে করোনা থাক বা না থাক! মেয়েরা কাজে বেরিয়ে বা স্কুল-কলেজে যাওয়ার পথে ধর্ষিতা হলে, চরম অত্যাচারের পর তাদের ছিন্নভিন্ন লাশ এখানে ওখানে পড়ে থাকলে, নীতি-পুলিশ বিজেপি তথা আরএসএস নেতা-মন্ত্রীরা তিরস্কারের সঙ্গ সেই নির্দেশ মনে করিয়ে দেন একান্ত উপযাচক হয়ে। সরাসরিই বলেন ‘প্রশাসন নয়, পারিবারিক সংস্কারই ধর্ষণ রুখতে পারে’ কিংবা ‘ধর্ষিতার মৃত্যুই কাম্য’ ইত্যাদি। অর্থাৎ প্রশাসন মেয়েদের সুরক্ষার দায় নেবে না। তাই বাড়িতে থাকাই নিরাপদ! কিন্তু, মেয়েদের কাছে এর থেকে ব্যঙ্গাত্মক কি আর কিছু আছে?

অতিমারীর ভয়ে, করোনার ভয়ে আমরা বাধ্য হয়েছি বাড়িতে থাকতে। কিন্তু সেই বাড়িতেই অন্য এক অতিমারী থাবা বসিয়েছে মহিলাদের ও কন্যা শিশুদের উপর। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে গার্হস্থ্য হিংসা এবং পারিবারিক নির্যাতন। শুধু কলকাতা নয়, ভারত নয়, সারা পৃথিবী জুড়ে, প্রত্যেকটি ঘরে ঘরে অতিমারীর আকার ধারণ করেছে পারিবারিক নির্যাতন। সেজন্য এই অতিমারীকে ‘শ্যাডো প্যান্ডেমিক’ আখ্যা দিয়েছে ‘ইউএন উমেন’।

অতিমারীর আগেও, ভারতে গার্হস্থ্য হিংসার শিকার হয়েছেন প্রায় ২৯ শতাংশ মহিলা (ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে, ৪), আট থেকে আশি, সমস্ত ধরনের মহিলা থেকে শুরু করে শিশু কন্যা কেউই বাদ নেই এই পরিসংখ্যানে। ২০১৮ সালের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর রিপোর্ট বলছে প্রতিদিন ভারতে ২৮ জন মহিলা এই গার্হস্থ্য হিংসার জেরে প্রাণ হারান।

কিন্তু এসব ঘটনায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মেয়েটির উপরেই বর্তায় সমস্ত দোষ – ‘মেয়েটি মানিয়ে নিতে পারেনি’, ‘স্বামী সংসার ছেড়ে অত বন্ধুবান্ধব কিসের?’ বা, ‘অল্প বয়সে পাকলে বাবা মা মারবে না তো কি পুজো করবে?’ ইত্যাদি ইত্যাদি। গা সওয়া হয়ে যায় আমাদেরও যতক্ষণ না আরও বীভৎস, আরও শোচনীয় হয় অত্যাচার। অর্থাৎ ঘরে-বাইরে ধর্ষিতা নির্যাতিতা হলে, এমনকি প্রাণ হারালেও দায় মেয়েটিরই!

প্রশ্ন আগেও ছিল কিন্তু লকডাউন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে যে ‘মেয়েরা বাড়িতেই নিরাপদ’ কথাটা কতটা ভুল। লকডাউনের পর সারা বিশ্বে পারিবারিক নির্যাতন বেড়েছে ২০-৭০ শতাংশ। জাতীয় মহিলা কমিশন জানাচ্ছে মার্চ-এপ্রিলের তুলনায় এপ্রিল-মে মাসে অর্থাৎ লকডাউন শুরুর পর গার্হস্থ্য হিংসার মাত্রা বেড়েছে দ্বিগুণ।

লকডাউন শুরুর পর থেকেই ঘরবন্দী মেয়েরা। আর সেই বাড়িতেই নির্যাতনকারী থেকে শুরু করে শিশু সহ পরিবারের সকলে। ফল? মেয়েদের উপর বেড়েছে গৃহকর্ম তথা সেবাযত্নের বোঝা। যেহেতু মেয়েদের ছোট থেকেই বাড়ি সামলানো, সেবা যত্ন এগুলোকেই তার মূল ভূমিকা হিসেবে শেখানো হয়। তথাকথিত ভালো মেয়ের ধাঁচা। পাল্লা দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে নির্যাতন ও হিংসা। আর নির্যাতনকারী যেহেতু ২৪ ঘণ্টা বাড়িতেই উপস্থিত সেহেতু অভিযোগ জানানো, সাহায্য চাওয়া – এসব দুরস্ত হয়ে উঠেছে মেয়েদের জন্য। আর অভিযোগ জানালেও আরও করুণ হচ্ছে পরিস্থিতি। উল্টে বাড়ছে নির্যাতন। ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছে প্রয়োজনীয় তথ্যাদি যেমন – রেশন কার্ড, ভোটার কার্ড ইত্যাদি। বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া বা সেই সংক্রান্ত হুমকি, সন্তানদের কেড়ে নেওয়া – এসব তো আছেই। অনেকেই বলবেন বিবাহিত মহিলাদের ক্ষেত্রে বাপের বাড়ি চলে এলেই তো সমস্যা মিটে যায়। কিন্তু বাস্তব চিত্রটা অন্য। প্রথমত এই মানিয়ে নেওয়ার গল্প, স্বামীর ঘরই ঘর – এগুলো মেয়েরা পরিবার নামক প্রতিষ্ঠান থেকেই শেখে। বাবা-মাও অংশ সেটার। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাবা মা-ই বাধ্য করছেন আবার মেয়েদের ফিরে যেতে নির্যাতনকারীদের কাছে। আর লকডাউনে আরও ভয়ানক পরিস্থিতি তৈরি করেছে কাজ চলে যাওয়া। অনেক ক্ষেত্রে বাবা মা চেয়েও হয়ত রাখতে পারছেন না মেয়েদের কারণ খাওয়ানোর সঙ্গতি নেই। আবার মেয়েরা যারা নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে নিজেরটুকু উপার্জন করত সেই সংস্থানও হারিয়েছে এই লকডাউনে। সরকারি তরফ থেকে চালু করা হয়েছিল হেল্পলাইন। কিন্তু উপার্জনই যেখানে নেই, পেটের খাবার জোটানোই দায় যেখানে সেখানে ফোনে রিচার্জ করে কি করে অভিযোগ জানাবেন মহিলারা? তাহলে কি সরকারি পরিষেবা, পুলিশ প্রশাসন এগুলো শুধুমাত্র সমাজের সুবিধাভোগী উচ্চবিত্ত শ্রেণীর জন্য? ‘শারীরিক দূরত্ববিধি’ না বলে প্রচার করা হয়েছিল ‘সামাজিক দূরত্ববিধি’। মানুষের মনে তৈরি করা হয়েছিল ভীতি। এমনিতেই পারিবারিক নির্যাতনের ক্ষেত্রে ‘ছোটোখাটো’ পারিবারিক বিষয়, ‘মানিয়ে নিতে হয়’ বলে এড়িয়ে যায় চারপাশের সমাজ, প্রতিবেশীরা। মানতেই চাওয়া হয় না এটা ‘পারিবারিক’ নয় ‘সামাজিক’ সমস্যা। সেখানে এই ‘দূরত্ববিধি’ সংক্রান্ত ভীতির ফলে যেটুকু সাহায্য প্রতিবেশীদের থেকে পাওয়া যেত সেটাও বন্ধ করে দিয়েছে লকডাউন। ফলে শারীরিক, মানসিক ও আর্থিক নির্যাতন এক বীভৎস আগ্রাসী রূপ ধারণ করেছে এই লকডাউনে। যেসমস্ত মহিলারা বেরিয়ে আসতে চেয়েছেন তাদের কাছে সুরক্ষিত আশ্রয় পাওয়াটাই বড় চ্যালেঞ্জ। সম্পত্তিতে মেয়েদের অধিকার সামাজিকভাবে কোনোকালেই স্বীকৃত নয় আমাদের এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজে। তারা জানে তারা বেরিয়ে গেলেও বাবা মা আবার ফেরত পাঠাবেন। এমনিতেই  দেশে শেলটার হোমের সংখ্যা অপ্রতুল। তার উপর করোনা ভীতি ও সংক্রমনের ভয়ে হোমগুলি লকডাউন পরিস্থিতিতে নতুন কোনও আবাসিক নিতে চায়নি। একই অবস্থা পুলিশ, প্রশাসনের। একেই যানবাহন বন্ধ, ২৪ ঘণ্টা নির্যাতনকারীও উপস্থিত বাড়িতে। এই সমস্ত বাধা পেরিয়ে যেসব মহিলারা অভিযোগ জানাতেও গেছে তাদেরও অনেকক্ষেত্রে সংক্রমণের ভয়ে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে থানা থেকে, পরামর্শ দেওয়া হয়েছে নিজেদের মধ্যে মিটিয়ে নেওয়ার জন্য।

বর্তমানে কিছুদিন হল আনলক প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। কর্মরত মহিলাদের ক্ষেত্রে এমনিতেই লকডাউন দ্বিগুণ বোঝার কাজ করেছে। উপরের সমস্তকিছু সামলেও তাদের অফিস বা কর্মজীবন সামলাতে হয়েছে। কারণ বেশিরভাগ মহিলাদেরই বাড়িতে নিজের মতো করে সময় কাটানো বা ‘নিজের জায়গা’ বলে কিছু থাকে না। পিতৃতান্ত্রিক অধিকারবোধ সেই স্পেস মেয়েদের দেয়না। ফলত ওয়ার্ক ফ্রম হোম করতে হলে যে স্পেসের প্রয়োজন সেটা মহিলাদের ক্ষেত্রে নেই। অর্থাৎ একদিকে পারিবারিক নির্যাতন বা সেই সংক্রান্ত মানসিক চাপ, অন্যদিকে কর্মজীবন! আনলক শুরু হওয়ার পরও সেই পর্বের পুরোপুরি অবসান হয়নি। বরং লকডাউনে এক অদ্ভুত প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে মহিলাদের প্রতি যা আনলক হওয়ার পরও অব্যাহত। যে যাই করুক, যেখানেই যাক পরিবারের দ্বিগুণ চাপ সামলেই করতে হবে। সঙ্গে দৃঢ় হয়েছে ‘ঘরটাই মেয়েদের জন্য’ এই ধারণা। ফলত আরও কঠিন হয়েছে অধিকারের, স্বাধীনভাবে বাঁচার লড়াই। গার্হস্থ্য হিংসা আগেও ছিল কিন্তু লকডাউনের ফলে আরও প্রকাশ্যে এসেছে অবাধ গার্হস্থ্য হিংসার চিত্র। সঙ্গে বেরিয়ে পড়েছে মহিলাদের জন্য নির্ধারিত ‘সাপোর্ট সার্ভিস’গুলোর নগ্ন রূপ। ‘কন্যাশ্রী’ যে মেয়েদের বাঁচাতে পারে না, ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’ যে আদপে ধাপ্পা ছাড়া কিছুই নয় এবং ‘নারীর ক্ষমতায়ন’ যে আদপে সেই তলানিতেই রয়েছে আরও একবার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে লকডাউন।

- সৌমি জানা   

খণ্ড-27
সংখ্যা-40