মোদী সরকারের গায়ের জোরে এবং অবৈধভাবে চাপিয়ে দেওয়া কৃষক-বিরোধী, কর্পোরেট-তোষণকারী তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে এক অভূতপূর্ব ঐতিহাসিক প্রতিবাদে লক্ষ লক্ষ কৃষক দিল্লীর সীমানায় ধর্ণায় বসেছেন। দিল্লী অভিযানের পথে কৃষকরা পুলিশের হিংস্র আক্রমণের মুখোমুখি হয়েছিলেন। বাধা ভেঙে, কাঁদানে গ্যাস আর জল কামানের আক্রমণকে হিম্মতের সাথে মোকাবিলা করে সেই থেকে প্রতিবাদী কৃষকরা জাতীয় সড়ক অবরোধ করে দেশের রাজধানী শহরের সীমানায় অবস্থান করছেন। সড়ক থেকে দিল্লীর প্রত্যন্তে বুরারির ময়দানে সরে যাওয়ার সরকারি প্রস্তাব খুব সঠিক ভাবেই তাঁরা খারিজ করে দিয়েছেন ।
কৃষক আন্দোলন নিয়ে মোদী সরকার এবং শাসকদল বিজেপি'র প্রতিক্রিয়া আদৌ অপ্রত্যাশিত নয় – একেবারে পূর্বানুমান মাফিক। বহু ব্যবহারে জীর্ণ সেই একঘেয়ে চিত্রনাট্য, আমরা যা ইতিমধ্যেই সমান নাগরিকত্ব আন্দোলন ও প্রতিবাদী ছাত্রদের উদ্দেশে ব্যবহৃত হতে দেখেছি — এই বাহিনীর প্রচার যন্ত্র এই বিশাল কৃষক আন্দোলনকে "খালিস্তানী সন্ত্রাসবাদীদের" মদতপুষ্ট বলে দাবি করার চেষ্টা করেছে যাদের সঙ্গে নাকি বিরোধী দলগুলোর আঁতাত রয়েছে। এই প্রচার ব্যর্থ হয়েছে এবং সমাজের সর্বস্তরের মানুষ কৃষকদের প্রতি আন্তরিক সংহতি জানিয়েছেন।
একদিকে যেমন বিজেপি'র পোষা "গণ্যমান্যরা" এবং সংবাদমাধ্যম গোষ্ঠীগুলো কৃষকদের প্রতি অবিরাম হিংস্র গালিগালাজ আর কুৎসা ছিটিয়ে চলেছে, অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং ঘোষণা করেছেন, সরকারের অভিপ্রায় নাকি "গঙ্গার মতই পবিত্র" ছিল! তাঁর দাবি, কৃষকরা কায়েমি স্বার্থের দ্বারা বিভ্রান্ত হয়েছে। কৃষকদের সঙ্গে প্রথম দফার আলোচনায় সরকার প্রধানমন্ত্রীর সংলাপই আউড়ে গেছে। কৃষি আইন নিয়ে "আলোচনার"র জন্য সরকার একটি প্যানেল গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিল। কৃষকদের সঙ্গে সম্পর্কিত এই আইনগুলো বলবৎ করার আগেই কৃষকদের সঙ্গে এই "আলোচনা" হওয়া উচিত ছিল। বর্তমান পর্যায়ে, মনে হচ্ছে সরকারি "প্যানেল"-এর উদ্দেশ্য, কৃষকদের প্রণোদিত করা এবং এই "শিক্ষা"দেওয়া যে এই কৃষি আইনগুলি তাদেরই স্বার্থে। কৃষকদের প্রতিনিধিরা এইরকম একটি প্রস্তাবকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতেই অনড় থেকেছেন।
যে আইনগুলো কৃষিকে প্রভাবিত করছে, সেগুলো সম্পর্কে কৃষকদের "শিক্ষিত" হওয়ার দরকার আছে — এই প্রস্তাব রাখাটা তাদের দাঁড় করিয়ে অপমান করা। কৃষিতে যখন এটি লাগু হচ্ছে, এই কৃষকরাই সেক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ—তারা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছেন যে এই নতুন আইনগুলো তাদের কর্পোরেট-স্বার্থের দয়ার ভিখারী করে তুলবে। সরকার যখন দাবি করছে যে এই আইনগুলি কৃষকদের "মুক্ত" করবে, সত্যিটা হল — এই আইনগুলো সরকারকে কৃষি ও কৃষকের পাশে থাকার যে কোনোরকম দায় থেকে "মুক্ত" করে দেবে। এই আইনগুলি কর্পোরেটদের অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যসামগ্রী যথেচ্ছ মজুত করার এবং এইভাবে দাম ও বাজারকে নিজেদের ইচ্ছেমতো নিয়ন্ত্রণ করার স্বাধীনতা দিয়েছে।
বড় বড় কর্পোরেশন যারা ভারতের কৃষক এবং দেশের খাদ্য স্বনির্ভরতার শিরদাঁড়া ভেঙে দিতে উদ্যত, তাদের দালাল, এজেন্ট হিসেবে মোদী সরকার নিজেকে উন্মোচিত করে ফেলেছে। কৃষকদের বর্তমান আন্দোলন শুরু হয়েছে ২৬ নভেম্বর থেকে : ঐ একই দিনে ছিল ভারতব্যাপী ঐতিহাসিক শ্রমিক ধর্মঘট —শ্রমিক আইনের শিথিলকরণ যা শ্রমিকদের মালিক ও বড় কর্পোরেশনগুলোর দয়ার উপর ছেড়ে দিয়েছে — তার বিরুদ্ধে। ২৬ নভেম্বর সংবিধান দিবসও বটে — যেদিন ভারতের জনগণ "নিজেদের ভারতের সংবিধান উপহার দিয়েছেন"। ফ্যাসিস্ট বিজেপি সরকারের হাত থেকে জনগণের অধিকারসমূহ ও ভারতের সাংবিধানিক গণতন্ত্র রক্ষার্থে সিএএ-এনপিআর-এনআরসি'র বিরুদ্ধে সমান নাগরিকত্ব আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এসেছে শ্রমিক ধর্মঘট এবং চলমান কৃষক আন্দোলন।
দিল্লী সীমানায় জাতীয় সড়কের উপর কৃষকদের ধর্ণা অবস্থানকে খুব সঠিকভাবেই 'নয়া শাহিনবাগ' বলে অভিহিত করা হয়েছে। শাহিনবাগ ছিল সমান নাগরিকত্ব রক্ষায় মহিলা-নেতৃত্বে পরিচালিত ধর্ণা। কুমন্তব্যকারী বিজেপি নেতৃবর্গ যারা নিজেরাই প্রতিবাদীদের বিরুদ্ধে হিংসাকে উস্কে দিয়েছে, তারা আন্দোলনকারীদের "সন্ত্রাসবাদী", "দাঙ্গাবাজ", "ভারত ভাঙার গোষ্ঠী" এবং "বাজারের মেয়ে মানুষ" অপবাদ দিয়েছিল। আজ কৃষক-ধর্ণার বিরুদ্ধেও সেই একই কুৎসা, কুমন্তব্য বর্ষিত হচ্ছে। ২০১৬-তে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীদের ঐ একই ভাষায় গালিবর্ষণ করা হয়েছিল। আজ ছাত্র যুব কৃষক শ্রমিক মহিলা, ভারতবর্ষের সমস্ত মানুষ বিজেপি'র সেই কুৎসিত অপপ্রচারের যোগ্য জবাব দিতে, যথার্থ প্রত্যাঘাত হানতে একজোট হয়েছেন। প্রতিবাদী নাগরিকরা গণতন্ত্রের প্রাণশক্তি। যে সরকার প্রতিবাদীদের "দেশ-দ্রোহী" আখ্যা দেয়, তারা গণতন্ত্রের শত্রু। আমাদের অবশ্যই স্বৈরাচারী এবং কৃষকবিরোধী মোদী সরকারের বিরুদ্ধে ভারতীয় কৃষকদের পাশে দাঁড়াতে হবে এবং নতুন তিনটি কৃষি আইন বাতিলের দাবি জানাতে হবে।
(এম এল আপডেট সম্পাদকীয়, ১ ডিসেম্বর ২০২০)