সিনেমা জগত থেকে গোটা শিল্প সাহিত্য পরিসরে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণে কত কথাই না উঠে আসছে। ভাষ্যকাররা মনে করাচ্ছেন সব্যসাচী হয়ে ওঠা মানুষটির জীবনের নানা দিক। তাঁর সম্পর্কে কেউ বলেছেন “অধ্যবসায় ছিল একইরকম”, কেউ বলেছেন “আত্মসন্ধান ছিল আজীবন সঙ্গী”, “জীবনকে মূল্যবান করে তোলা ছিল মূলমন্ত্র”, কেউ বলেছেন “সার্থক অলরাউন্ডার”। তবু কোথায় যেন ফোকাসে ধরায় ফাঁক থেকে যাচ্ছে। একটা দিককে যেন সেভাবে ঠিক স্মরণ করা হচ্ছে না। তা হল রাজনৈতিক সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। তিনি কোনও দলের ছিলেন না। তবে চিরপরিচিত ছিলেন মার্কসবাদের প্রতি অনুগত, বামপন্থী হিসেবেই। এই দিকটা, বিশেষ করে এই দেশ এই রাজ্য আজ যখন ফ্যাসিবাদের ঘোর অমানিশায় কবলিত হওয়ার নজীরবিহীন বিপর্যয়ের সম্মুখীন তখন তার মোকাবিলায় এক পাথেয় হিসাবে সৌমিত্রের রাজনৈতিক দিকটা স্মরণাস্ত্র করে তোলা দরকার। কারণ, তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন একমাত্র বামপন্থাই প্রকৃত মানবিক গণতান্ত্রিক জীবন-জীবিকার পরিবর্তন আনতে পারে। এই চর্চা তিনি যেমন একসময় তাঁদের ‘এক্ষণ’ পত্রিকায় করতেন, তেমনি জীবনের শেষ লেখা রাজনৈতিক রচনায়ও প্রকাশ করে গেছেন একই আশা। অথচ তাঁর মৃত্যুর পরে উল্টোদিকে তাঁকেও আত্মসাৎ করতে চাইছে হিন্দুত্বের ফ্যাসিবাদীরা ।
আসা যাক সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক চরিত্রের কিছু টুকরো স্মৃতিকথায়।
সৌমিত্রের মার্কসবাদ ও বামপন্থার সাথে প্রথম পরিচিত হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রাবস্থা থেকে। সেই বোধোদয়ে শুরু হয়ে যায় পথে নামা, কফি হাউসে আনাগোনা। চলার পথে ঘনিয়ে আসে ১৯৬৫-র খাদ্য সংকট। ত্রাণ সংগ্রহে নামেন চলচ্চিত্র ক্ষেত্রের শিল্পী ও কলাকুশলীরা, সামনে সৌমিত্র। ষাটের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত বাংলার টলিপাড়ার শিল্পী-কলাকুশলীদের একটিই বড় ছাতা সংস্থা ছিল। সেই সমিতি ন্যায়-অন্যায়ের অন্তর্বিরোধে অগত্যা দুটুকরো হল। সংস্থার অর্থভান্ডার থেকে ধর্মঘটি সিনেমা হলের কর্মচারীদের অর্থসাহায্য করা নিয়েই দ্বন্দ্ব। সৌমিত্ররা ছিলেন সাহায্য করার পক্ষে, বিপক্ষীয়রা সিনেমা হল মালিক ও প্রযোজকদের আঁতাতের চাপে ধর্মঘটি শ্রমিকদের পাশে দাঁড়াতে গড়রাজি ছিলেন। দ্বন্দ্ব গড়ায় সংঘাতে, তা থেকে বিচ্ছেদ, জন্ম নেয় এক নতুন সংস্থা “অভিনেতৃ সংঘ”, চিন্তায় ও কাজে নেতৃত্বের শীর্ষে নির্বাচিত হলেন সৌমিত্র। সংস্থাটি অঘোষিত পরিচিতি পেতে শুরু করল বামপ্রিয়। বাংলায় তখন তীব্র অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক সংকটের পরিস্থিতি। বাংলার আকাশে বাতাসে তখন নকশালবাড়ির ঝড়। তখন সৌমিত্রের অনুভূতিতে ‘কি’ ‘কেমন’ বোধ হচ্ছিল! অনেক বছর পরে আজকাল পত্রিকার এক শারদ সংখ্যায় প্রয়াত অভিনেতা দিলীপ রায় তাঁর ফিরে দেখা রচনায় সত্তর দশকের ঘটনাপ্রবাহ প্রসঙ্গে এক গোপন ঘটনা প্রকাশ করে দেন। সৌমিত্র উদ্বিগ্ন হয়ে ছুটে এসেছিলেন এক সিপিআই(এমএল) নেতাকে গোপন আশ্রয়ে রাখার ব্যবস্থা করার দায় নিয়ে। দিলীপ রায় বন্ধুর দেওয়া দায়িত্ব পালন করেছিলেন। পরে জেনেছিলেন যিনি গোপনে ছিলেন তিনি দলের সর্বোচ্চ স্তরের নেতৃস্থানীয় একজন, সুনীতি ঘোষ। এক সিনেমা ম্যাগাজিনের পাতায় প্রয়াতা অভিনেত্রী সুপ্রিয়া দেবী ‘আমার উত্তম’ প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন, শেষরাতে ময়দানে পুলিশের হাতে একজন বৃদ্ধকে খুন হতে দেখে বাড়ি ফিরে প্রথম সেকথা জানান ‘পুলু’কে (সৌমিত্র)। উত্তমকুমারের ধারণা ছিল ঘটনার রাজনৈতিক গুরুতর ব্যাপারটা একমাত্র পুলুই বুঝবেন এবং খবরটা যাদের জানার তাদের জানাতে পারবেন। সেই রাত শেষে গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছিলেন সিপিআই(এমএল) নেতা সরোজ দত্ত। এই তথ্যগুলো সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মনভুবন, অবস্থান ও অবদান সংক্রান্ত কিছু অজানা সত্যকে পরিচিত করায়। তারপরে দেশে চলতে থাকে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, জারি হয় জরুরি অবস্থা। তা যে তিনি কখনই মানতে পারেননি সেই প্রতিক্রিয়া যেভাবে পেরেছেন প্রকাশ করেছেন। জরুরি অবস্থার শেষদিক থেকে শুরু হল হাজার হাজার রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির দাবিতে আন্দোলন। মিছিলে সামিল হতেন সৌমিত্র। তাঁর “উদয়ন পন্ডিত” চরিত্র শুধুমাত্র রূপোলী পর্দায় সীমাবদ্ধ ছিল না, প্রত্যক্ষ হোত পথে পথে। দেশজুড়ে পালা বদল হল, রাজনৈতিক আবহাওয়ায় এল বড় বড় পরিবর্তন। তারপর থেকে যখনই গণতন্ত্র আক্রান্ত হয়েছে, ধর্মনিরপেক্ষতা বিপন্নতার মুখে পড়েছে, যুক্তিবাদের ওপর নেমেছে আক্রমণ, সৌমিত্র অংশ নিয়েছেন প্রতিবাদে। ব্যথা পেয়েছেন সমাজতন্ত্রের পতনে। ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বাবরি মসজিদ ধ্বংসের বিরুদ্ধে। কখনও কখনও বামফ্রন্টের নির্বাচনী প্রচারে সামিল হলেও ‘বামফ্রন্টের লোক’ ছিলেন না। বামফ্রন্ট বহির্ভূত বহু বামপন্থী আবেদনে স্বাক্ষর দিয়ে দিতেন নির্দ্বিধায়। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম ইস্যুতে তাঁর বুদ্ধ সরকারের ভ্রান্ত অবস্থানে প্রভাবিত হয়ে পড়াটা ছিল এক ব্যতিক্রম বেমানান বিষয়। পরে বোধহয় ভুল বুঝতে পেরেছিলেন, কারণ তা নিয়ে পড়ে থাকেননি। সবচেয়ে চিন্তিত হতেন রাষ্ট্রক্ষমতায় বিপজ্জনক ফ্যাসিবাদী শক্তি বিজেপির ধেয়ে আসা ও আধিপত্য কায়েম হওয়া দেখে। গুজরাটে দুই সহস্রাধিক সংখ্যালঘুদের গণহত্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন। সরব ছিলেন ‘মব লিঞ্চিং’ ও ‘লাভ জেহাদ’ মার্কা গেরুয়া দাপাদাপির বিরুদ্ধে। সিএএ-এনপিআর-এনআরসি-র বিরুদ্ধে “বেশ করেছি সই দিয়েছি” অবস্থান শরীরী বার্ধক্যের মধ্যেও প্রকৃত দেশচেতনার টানটান মেজাজকেই মনে করিয়ে দেয়। এইসব দৃষ্টান্তের দৌলতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এক অনন্য বামমনস্ক চরিত্র, চিরজীবী থাকবেন মানবিক আন্দোলনের ময়দানে।