প্রতিবেদন
দয়া দাক্ষিণ্য নয়, রেল আমাদের অধিকার
dare

দীর্ঘ টালবাহানার পর বঙ্গে লোকাল ট্রেন চলার ছাড়পত্র মিলেছে একটা অংশের মানুষকে বাদ দিয়েই। কিছু নীতিমালা সাজিয়ে। ভাবখানা এমন যে – দিলাম। দেশের জাতীয় সম্পদ রেলের দখলদারি যাদের হাতে, সেই কেন্দ্রীয় ক্ষমতাসীন দাম্ভিক সরকারটির নাম বিজেপি। যারা ক্ষমতায় এসে বাংলার মানুষকে ‘সোনার বাংলা’ উপহার দিতে চায়। যার নমুনা আমরা দেখি বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলির দিকে তাকালেই।

প্রথমত, ট্রেন যাত্রায় অগ্রাধিকার দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে সমস্ত রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারি সহ আর্থিক নির্ভরশীলতায় এগিয়ে থাকার ভিত্তিতে এবং বাদের তালিকায় সরাসরি ঘোষণা করা হয়েছে হকার ও ভেন্ডারদের, যাদের লোকাল ট্রেনের উপর নির্ভর করে জীবন বাহিত হয় দিনের পরদিন। ইহা তৎক্ষণাৎ পদক্ষেপ নয়, হকার উচ্ছেদের পরিকল্পনা বহুদিনের। যা এই পেন্ডামিক সময়কালকে এক সুবর্ন সুযোগ হিসাবে কাজে লাগিয়েছে। অতিমারীর সুযোগ নিয়ে, অপরিকল্পিত লকডাউন মানুষকে ঘরবন্দী করে আর্থিক ভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষকে আরও ভয়ংকর সংকটের মুখোমুখি দাড় করিয়ে দিয়েছে এই মুনাফা লোভী সরকার। মানুষের প্রয়োজনকে অস্বীকার করে যে এক নির্লজ্জ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে কেন্দ্র, তাতে কিছু হলেও তাল মিলিয়েছেন বঙ্গ।

ট্রেন চালানোর দীর্ঘদিনের প্রয়োজনীয় দাবিকে ধর্তব্যে না রেখে লাভ ক্ষতির ব্যবসায়ী হিসাবে বিচার করে নিজেদের এজেন্ডা রুপায়নে ব্যস্ত থেকেছে এই নরেন্দ্র মোদির সরকার। আর দিনের পর দিন শুনিয়ে যাচ্ছে আতঙ্কের বাণী। সরকারি নির্দেশ কার্যকরী করতে রেলমন্ত্রী সমগ্র রেলটাকে এক বড়ো ব্যবসায়ীক ক্ষেত্রে পরিনত করতে চায় কর্পোরেট সহযোগে। দেশিয় সম্পদ ভারতীয় রেলকে বিকিয়ে দিতে তারা বদ্ধপরিকর।

কিন্তু, কীভাবে? আর্থিক ভাবে পিছিয়ে পড়া একদম নিচের মানুষটিও যে রেলযাত্রী হিসেবে নিজের অধিকার বোধ রাখে। নুন্যতম ভাড়ায় অনেকটা পথ পাড়ি দেওয়ার হিম্মত রাখে। এ অভ্যাস বহুদিনের। মুনাফাবাজের যা না-পছন্দ। কর্পোরেট-রাজেই যাদের বিশ্বাস, লুঠেরাদের কাছে একটার পর একটা সরকারী সম্পদ বিকিয়ে দিয়েই যারা উন্নয়নের ধ্বজা উড়ায়, উল্লাসে মেতে থাকে, তাদের দায়িত্বও থাকে মালিকের পছন্দসই ব্যবস্থায় সাজিয়ে দেবার। সেই প্রয়াস চলছে। একটা অংশের মানুষকে রেলের উপর নির্ভরতা কমাতে চায় এবং এই কাজে মধ্য-ভোগী একটা অংশের মানুষকে প্রতিপক্ষ হিসেবেই দাঁড় করাতে পারছে। এই গরিব মানুষই যেন সব সমস্যার কারণ। যেমনটা ভাবানো হয়, সরকারি কর্মচারিদের অ-কর্মন্যতা, ফাঁকিবাজিই বেসরকারীকরণের কারণ। গরিব মানুষের উপস্থিতি সবসময়ই পরিপাটি ব্যবস্থার বাধা হয়ে দাঁড়ায়, ‘সাচ্ছন্দ্য’ কমিয়ে দেয়। তাইতো উন্নয়নে বস্তি উচ্ছেদ হয়, আবার কোথাও গরিবি ঢাকতে সাদা বা কালো কাপড় মুড়ে দেওয়া হয়। রেলও আজ পরিপাটি ব্যবস্থার শরিক। যা আজ সাময়িক বলে মনে হলেও তা আগামীর মহরা। রেল বেসরকারীকরণ শুধুই যাত্রী পরিবহনেই নয়, ইহা সমগ্র রেল-যাত্রীর প্রয়োজনীয় সামগ্রীর বিকিকিনির কর্পোরেট দখলদারিও। যেমন মেল এক্সপ্রেস ট্রেন-যাত্রায় খাদ্যসামগ্রীর যোগানদাতা আইআরসিটিসি সহ কয়েকটি সংস্থা। এই ব্যাবস্থার প্রাথমিক কার্যকরী পদক্ষেপই হল হকার হটাও, যে পদক্ষেপ সরকার নিতে চলেছে।

ভাড়া বাড়তে চলেছে কয়েক গুণ। ইতিমধ্যেই দূরপাল্লার ট্রেনের ক্ষেত্রে তা কার্যকর হচ্ছে। মেল-এক্সপ্রেস ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক না হলেও স্পেশাল নামে কিছু ট্রেন ইতিমধ্যেই চলছে। সমস্ত কিছু একই আছে, কেবল ট্রেন নাম্বারের আগে একটা শূন্য বসিয়েই তা স্পেশাল করা হয়েছে। মজা হলো এই শূন্য বসানোর মধ্যে দিয়ে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ ভাড়ার বৃদ্ধি ঘটানো হয়েছে। আর ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক না করে, যাত্রী চাহিদা বাড়িয়ে এই বাড়তি ভাড়া নেওয়ার অভ্যাসটা স্বাভাবিক করে নেওয়া হচ্ছে। এটাও মহরা। নাম্বারের আগের শুন্য উঠে যাবে, ট্রেন বাড়বে চাহিদা মতো (কর্পোরেট চাহিদা) কিন্তু বাড়তি ভাড়া দেওয়ার বাধ্যবাধকতা থেকেই যাবে। জেনারেল কম্পার্টমেন্ট নেই। অতি কষ্ট হলেও একটা অংশের গরিব মানুষের আপৎকালীন কম পয়সার ট্রেনযাত্রা ছিলো এই জেনারেল কম্পার্টমেন্ট। এই অতিমারীর সুজোগ নিয়ে তা সংরক্ষণের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। সিট ভাড়া, পরিসেবা ভাড়া জুড়ে বাড়তি ভাড়া দিয়ে টিকিট কনফার্ম হলে তবেই যাত্রার অনুমতি মেলে। উচ্চ শ্রেণির যাত্রীর ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট টাকার টিকিটের সাথে যে সুবিধা থাকতো তা বাদ দিয়ে আলাদা বাড়তি টাকার বিনিময়েই তা পাওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে, চাদর, জল, চা থেকে স্বাস্থ্য পরিসেবা সংক্রান্ত সমস্তই। ধীরে ধীরে তা নীচে নামানো হবে। একদিকে ঝাঁ-চকচকে পরিপাটি রেল যাত্রার স্বপ্ন অন্য দিকে নির্ভরতার সংকট মুখোমুখি। নির্ভরতার প্রশ্নে মানুষের আঙ্গুল যথাযথ মুনাফালোভী সরকারের দিকে থাকলেও ভিন্ন পক্ষকে সুচতুরভাবে কাজে লাগাতে চায় সরকার। কাজে লাগাতে চায় জীবন যাপনে রেল-নির্ভর মানুষগুলির বিরুদ্ধেই। আমরা একবার যদি ভাবতে পারি, রেল আমাদের, আমাদেরই দেশীয় সম্পদ, ইহা কারো ব্যক্তি মালিকানার অধিনে নয়, এ পরিসেবা কারও দয়া দাক্ষিণ্য নয়, অধিকার। রেল পরিপাটি হোক এবং সাচ্ছন্দ্য বাড়ুক। তা তখনই সুন্দর হয় যখন এই ব্যবস্থার শরিক হতে পারি আমরা সবাই। সব্বাই।

- শঙ্কর রায়    

খণ্ড-27
সংখ্যা-40