করোনা ভাইরাস সংক্রমণ ও প্রস্তুতিহীন লকডাউনের ধাক্কায় বাংলার চা শিল্পে উৎপাদন বন্ধ থাকে। ফলে মার্চ-এপ্রিল মাসে দার্জিলিং চায়ের বিশ্বখ্যাত ‘ফার্স্ট ফ্লাশ’ -- বিক্রি করে বিপুল লাভের সম্ভাবনা থেকে বঞ্চিত হয় অসম সহ পশ্চিমবঙ্গের চা শিল্পপতিরা। তাঁদের মরিয়া প্রচেষ্টা ও রাজ্য/কেন্দ্র সরকারের প্রশ্রয়ে কোভিড সংক্রমণের সম্ভাবনাকে পাশ কাটিয়ে মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে শ্রমিকদের আপত্তিকে দূরে ঠেলে চা শিল্পের তালাবন্দী ঘুচিয়ে দেওয়া হয়। লকডাউন পর্যায়ের ন্যায্য মজুরি প্রদান ও কোভিড স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার প্রতিশ্রুতি অচিরেই বাজে কাগজের ঝুড়িতে নিক্ষিপ্ত হয়। শ্রমিক বিক্ষোভ ঠেকাতে কোনও কোনও বাগানের স্থায়ী শ্রমিকদের মজুরির অগ্রিম হিসাবে অল্পকিছু টাকা হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়। একমাসের অধিক সময় মজুরি বঞ্চিত শ্রমিক পরিবারগুলি অগত্যা পরবর্তীতে ঋণদায়ী সংস্থাগুলির উপর আরো বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। তরাইয়ের ৪৫টি বাগান শ্রমিক পরিবারের প্রায় ৪৩,০০০ সদস্য মোদী সরকারের মাথা পিছু ৫ কেজি চালের খয়রাতি সাহায্যের আওতার বাইরে থেকে যায়। ‘সেকেন্ড ফ্লাশ’ চায়ের বাজারি চাহিদা ও যোগানের মধ্যে আপৎকালীন তফাতে উৎপাদন শুরুর প্রথম থেকেই মালিক কর্তৃপক্ষ চা অকশন কেন্দ্রের মাধ্যমে ও খোলা বাজারে বিগত বছরগুলির থেকে দ্বিগুনেরও বেশি দাম আদায় করতে পেরে বিপুল মুনাফা কামিয়ে নেয়। অতঃপর শ্রমিক সংগঠনগুলির লাগাতার লেগে থাকা ও পরবর্তীতে শ্রমিক অসন্তোষের ভয়ে আগষ্ট মাসে বোনাস সংক্রান্ত দ্বিতীয় বৈঠকেই চা শিল্পপতিরা সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ বোনাস ঘোষণা করতে বাধ্য হয়।
লকডাউনের সমস্ত পর্যায় জুড়ে কেন্দ্রীয় সরকারের শ্রমিক সুরক্ষা আইনের মান্যতাকে খর্ব করতে শ্রমকোড চাপিয়ে দেওয়া, ৮ ঘন্টার বদলে ১২ ঘন্টা কাজের সুপারিশ, শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থার গাফিলতি ইত্যাদির বিরুদ্ধে এবং লকডাউন ওয়েজ, ন্যূনতম মজুরি কাঠামো ঘোষণা, চা বাগানের স্থায়ী শ্রমিকদের বাসভূমির পাট্টা প্রদান, খাদ্য নিরাপত্তা, বন্ধ বাগান খোলা, শ্রমিক পরিবারগুলির সুরক্ষা বাবদ আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণার দাবিতে তরাই সংগ্রামী চা শ্রমিক ইউনিয়ন সহ জয়েন্ট ফোরাম অন্তর্ভুক্ত অন্যান্য শ্রমিক ইউনিয়নগুলি সাধ্যমত সক্রিয় ভূমিকা পালন করে চলে। ইতিমধ্যে অসম, বাংলা, তামিলনাড়ু, কর্নাটক ও কেরালাতে কর্মরত এআইসিসিটিইউ অনুমোদিত ইউনিয়নগুলির একটি কোঅর্ডিনেশন টিম অনলাইন আলোচনার মাধ্যমে ১০ দফা দাবিপত্র নিয়ে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলিকে পাঠিয়ে দেয় এবং বাগান ভিত্তিতে সক্রিয়তাকে এগিয়ে নিয়ে চলে।
২৬ নভেম্বর সর্বভারতীয় সাধারণ ধর্মঘটকে সর্বাত্মকভাবে সফল করে তুলতে ইতিমধ্যে এলাকা ভিত্তিক কনভেনশন ও বাগানভিত্তিক গ্রুপ মিটিংগুলি সম্পন্ন হয়েছে। দুর্গাপূজা, দেওয়ালী ও আসন্ন ছটপুজোর দিনগুলির প্রতিকূলতা ও এতদ্অঞ্চলে কোভিডের বাড়তি সংক্রমণের বিপদকে অগ্রাহ্য করে শ্রমিক সংগঠনের নেতা ও কর্মীরা সক্রিয়তা বা তুলতে ব্যস্ত থাকছেন।
পাহাড়-তরাই-ডুয়ার্সের চা শিল্পে বিজেপি-আরএসএস পরিচালিত শ্রমিক ইউনিয়ন মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চাইছে। অন্যদিকে, নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করে আগামী বিধানসভা নির্বাচনে ভাঙন রুখতে চায় তৃণমূল পরিচালিত তিনটি ভাগে বিভক্ত বাগান ইউনিয়নগুলি। দার্জিলিং পাহাড়ের রাজনীতিতে বিমল গুরুংয়ের সাম্প্রতিক আত্মপ্রকাশ সঞ্জাত বিক্ষিপ্ত রাজনৈতিক বাতাবরণের এমত জটিল বাতাবরণের মধ্যেও বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়নগুলি চা শ্রমিকদের সংগঠিত রেখে ধর্মঘটকে সফল করে তুলতে বদ্ধপরিকর।
-- অভিজিৎ মজুমদার
দশটি কেন্দ্রীয় শ্রমিক সংগঠন ও ফেডারেশন সমুহের ডাকে আগামী ২৬ নভেম্বর ২০২০ সারা দেশজুড়ে কেন্দ্রীয় সরকারের জনবিরোধী ও শ্রমিক বিরোধী নীতির বিরুদ্ধে এবং সাত দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে সাধারণ ধর্মঘট পালিত হবে। সারা দেশের ৪১টি প্রতিরক্ষা কারখানা, ইএমই ওয়ার্কসপ, এমইএস সহ প্রতিটি দফতরে কৃষক-বিরোধী আইন এবং শ্রমিক-বিরোধী শ্রম কোড সমূহ বাতিল, রাষ্ট্রায়ত্ব শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলির বেসরকারীকরণ বন্ধ করা, সরকারী ক্ষেত্র যেমন রেলওয়ে, অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি এবং বন্দর ইত্যাদি কর্পোরেটদের হাতে তুলে না দেওয়া ও এনপিএস বাতিল করে পুরোনো পেনশন চালু করা, সরকারি এবং রাষ্ট্রায়ত্ব ক্ষেত্রগুলির কর্মীদের চাকরির মেয়াদ শেষ হবার আগেই তাদের অবসর নিতে বাধ্য করার মতো দানবীয় আইন বাতিল ও ডিএ পুণর্বহাল করা ইত্যাদি দাবিগুলো নিয়ে পোষ্টারিং ও ছোট ছোট গ্রুপে আলোচনার মাধ্যমে শ্রমিকদের মধ্যে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এছাড়াও আয়কর ভুক্ত নন এমন প্রতিটি পরিবারকে প্রতি মাসে নগদ ৭,৫০০ টাকা, অভাবগ্রস্ত পরিবারের সদস্য পিছু মাসে ১০ কেজি বিনামূল্যে রেশন, ১০০ দিনের পরিবর্তে বছরে ২০০ দিনের কাজ ও শহর এলাকায় কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা এই দাবিগুলো নিয়েও প্রচার চলছে। তবে প্রতিরক্ষা শিল্পের ক্ষেত্রে এই প্রচার মূলত সংহতি মূলক স্তরেই সীমাবদ্ধ।
এরসঙ্গে বলে রাখা প্রয়োজন গত ৪ আগষ্ট ২০২০ প্রতিরক্ষা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত এনপিডিইএফ (জিএসএফ ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন যার অন্তর্ভুক্ত) সহ চারটি ফেডারেশন ১২ অক্টোবর ২০২০ থেকে একক ভাবে প্রতিরক্ষা শিল্পে লাগাতার ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল, এই ক্ষেত্রকে কর্পোরাটাইজেশন করার কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে। এই বিষয়ে গত ৯ অক্টোবর ২০২০ দিল্লিতে চিফ লেবার কমিশনারের উপস্থিতিতে সরকারপক্ষ ও ফেডারেশন নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনায় সিদ্ধান্ত হয় আলোচনা চলা অবস্থায় সরকার পক্ষ কর্পোরেশনের সিদ্ধান্ত লাগু করবে না এবং ফেডারেশনগুলোও ধর্মঘটে যাবে না। এই পরিপ্রেক্ষিতে ধর্মঘট স্থগিতঘোষণা করা হয়। এই অজুহাতে প্রতিরক্ষা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ফেডারেশনগুলো ২৬ নভেম্বরের ডাকা ধর্মঘটে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হওয়ার ডাক দেয়নি, অথচ ফেডারেশনগুলোও এই ধর্মঘটের সিদ্ধান্তের শরিক ছিল।
জিএসএফ ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন (এনপিডিইএফ এবং এআইসিসিটিইউ অনুমোদিত) ফেডারেশনগুলোর এই দায় সারা মনোভাবকে অনুমোদন করেনা। আবার এককভাবে শুধুমাত্র একটি কারখানাতে একটি ইউনিয়নের পক্ষেও আলাদাভাবে কিছু করা সম্ভব নয়। তাই জিএসএফ ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন ও অন্য তিনটি ফেডারেটেড ইউনিয়নের সঙ্গে যৌথভাবে কর্মসূচী পালন করছে।
ফেডারেশন সমূহের নির্দেশ অনুযায়ী আগামী ২৫ নভেম্বর পর্যন্ত ধর্মঘটের দাবিগুলো তুল ধরে গেট মিটিং ও পোষ্টারিং-এর মাধ্যমে প্রচার চলবে। ২৬ নভেম্বর ধর্মঘটের সমর্থনে কালো ব্যাজ ধারণ ও কালো পতাকা সহ সমস্ত কারখানায় সামনে সংহতি সভা অনুষ্ঠিত হবে ।
ধর্মঘট বিষয়ে জিএসএফ ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের কিছু আলদা দৃষ্টিভঙ্গি আছে যা এই ক্ষুদ্র পরিসরে রাখা হল। কেন্দ্রীয় সরকারের শ্রমিক বিরোধী নীতিগুলোর বিরুদ্ধে বিভিন্ন সরকারী ও রাষ্ট্রয়ত্ব সংস্থার সঙ্গে যুক্ত শ্রমিক সংগঠনগুলো আলাদা আলাদা সময়ে একক ভাবে ধর্মঘটের ডাক দেয়। অন্যান্য সংগঠনগুলো সেখানে সংহতি জানায় দায়সারা ভাবে মিটিংএ উপস্থিত হয়ে বা ঐদিনে সংহতি সভা করে। আবার কেন্দ্রীয় শ্রমিক সংগঠনগুলোও এক বা একাধিক সময়ে সারাদেশ ব্যাপী সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয়। এক্ষেত্রে জণগণের সাধারণ সমস্যা ও দাবিগুলোর সঙ্গে অসংগঠিত ক্ষেত্র, সংগঠিত সরকারি ও রাষ্ট্রায়ত্ব ক্ষেত্র এবং অন্যান্য সমস্ত ক্ষেত্রের সমস্যা ও দাবিসমূহ যুক্ত থাকে। তাহলে আলদা আলাদাভাবে ধর্মঘট ডাকার যৌক্তকতা কোথায়? এক্ষেত্রেও বাকির দায়সারাভাবে সংহতি জানায়। একটা সময় এই সংহতি বিষয়টা চালু হয়েছিল শধুমাত্র লড়াইএ পাশে আছি এটা বোঝাতে কিন্তু ধর্মঘটে এই সংহতির কোন গুরুত্ব নেই। ধর্মঘটের ক্ষেত্রে সংহতি জানানো সোনার পাথর বাটির মত। আগামী দিনে এই দুই-এর মেল বন্ধনের লক্ষ্যে ২৬ নভেম্বর ২০২০ সারা দেশে সাধারণ ধর্মঘটকে সফল করে তুলতে হবে ।
রেল শিল্পের বর্তমান পরিস্থিতি ১৯৭৪ সালের ঐতিহাসিক রেল ধর্মঘটের সময়ের চেয়েও অগ্নিগর্ভ। রেল শ্রমিকের অস্তিত্ব আজ ভয়ঙ্করভাবে বিপন্ন। এক সর্বাত্মক হামলা নামিয়ে এনেছে মোদী সরকার। স্বয়ংসম্পূর্ণরেল ব্যবস্থাকে পুরোপুরি ভেঙে তছনছ করে বড় পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দিচ্ছে। রেল বাজেট তুলে দিয়েছে, রেল বোর্ড ভেঙে সেখানে টাটা-আম্বানিদের জায়গা করে দিয়েছে। রেলের বিরাট বিরাট কারখানাগুলো, এমনকি স্টেশন আর ট্রেনও বেসরকারী হাতে তুলে দিচ্ছে। এবারে এক ধাক্কায় ১৫১টি ট্রেন বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। হামলা নেমে আসছে আরো নানাভাবে -- প্রিন্টিং প্রেস বন্ধ, ই-অফিস, মেয়াদের আগেই রিটায়ারমেন্ট, নাইট ডিউটি ভাতা বন্ধ ইত্যাদি বিভিন্ন রূপে। রেল শ্রমিকরা প্রতিনিয়ত এই হামলার আঁচ অনুভব করছেন এবং তাদের ভবিষ্যত প্রতিদিনই আরো বেশি অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। এত বড় হামলা এর আগে কখনো হয়নি
কিন্তু শুধু রেল শ্রমিকদেরই নয়, রেল বেসরকারীকরণের আঁচ এসে লাগবে সাধারণ মানুষের ওপরেও। ইতিমধ্যেই ‘তেজস’ নামে যে বেসরকারি ট্রেন চালু হয়েছে সেখানে শুধু যে ভাড়া বেশি তাই নয়, ভাড়ায় সব ধরনের ছাড়ও বন্ধ। অতীতে স্থানীয় মানুষের সুবিধার্থে এমনকি তাদের অনুরোধেও ট্রেনের স্টপ দেওয়া হতো, নতুন স্টেশনও স্থাপন করা হোত। কিন্তু এখন ট্রেন চালনাকারী বেসরকারী সংস্থার ইচ্ছাতে ট্রেনের স্টপ নির্ধারিত হবে। ট্রেন স্টেশন এলাকায় বা চলন্ত ট্রেনে যে সমস্ত হকার জীবিকা নির্বাহ করেন তাদের জীবিকার ওপর ভয়ঙ্কর আঘাত নামিয়ে আনবে রেলের বেসরকারীকরণ। মূলত শ্রমনিবিড় রেল শিল্প যুব সমাজের কর্মসংস্থানের সবচেয়ে বড় সংগঠিত ক্ষেত্র ছিল, বেসরকারীকরণ সেখানে কর্মসংস্থানের সুযোগ ব্যাপক ভাবে সংকুচিত করে দেবে।
রেল শ্রমিকরা তাদের ওপর নামিয়ে আনা এই আক্রমণ এবং জনগণের সম্পত্তি রেল শিল্পকে বেসরকারিকরণের এই প্রচেষ্টার সামনে নতিস্বীকার করতে রাজি নন। রেল শিল্পের একমাত্র বামপন্থী ফেডারেশন, এআইসিসিটিইউ অনুমোদিত ইন্ডিয়ান রেলওয়ে এম্প্লয়িজ ফেডারেশন (আইআরইএফ)-র উদ্যোগে রেল শিল্পের বেসরকারীকরণের বিরুদ্ধে রেল শ্রমিক ও জনগণের সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তোলার লক্ষ্যে ন্যাশনাল মুভমেন্ট টু সেভ রেলওয়ে (এনএমএসআর, রেল বাঁচাও রাষ্ট্রীয় আন্দোলন) নামক ঐক্যমঞ্চ গড়ে উঠেছে। বেসরকারী হাঙরদের হাত থেকে রেল শিল্পকে রক্ষা করতে এই মঞ্চকে আগামীদিনে আরো বিস্তৃত করার লক্ষ্যে প্রচেষ্টা চলছে।
এই পরিস্থিতিতে আগামী ২৬ নভেম্বরের ধর্মঘট রেল শিল্প তথা শ্রমিকের কাছে এক বিশেষ তাৎপর্য নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। ধর্মঘট ঘোষণা হওয়ার সাথে সাথে আইআরইএফ অন্তর্ভুক্ত জোনাল ইউনিয়নগুলি কখনো একক উদ্যোগে কখনো যৌথভাবে ধর্মঘটের সমর্থনে প্রচার শুরু করে দেয়। দক্ষিণ-পূর্বরেলওয়ে মজদুর ইউনিয়নের উদ্যোগে ৭ অক্টোবর সাঁতরাগাছিতে এআইসিসিটিইউ পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ সম্পাদক বাসুদেব বোসের উপস্থিতিতে এক বিরাট বিক্ষোভ সমাবেশের মধ্য দিয়ে ধর্মঘটের প্রচারের সূচনা হয়। এরপর আদ্রায় একাধিক বিক্ষোভ সমাবেশ এবং গত ৬ নভেম্বর গার্ডেনরীচে বিক্ষোভ সমাবেশ সংগঠিত করা হয়। সিএলডব্লু রেলওয়ে এম্প্লয়িজ ইউনিয়নের পক্ষ থেকেও একের পর এক প্রচার কর্মসূচী নেওয়া হয়। তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য ৮ নভেম্বর আমলাদহি বাজারে বাসুদেব বোসের উপস্থিতিতে প্রচার সভা হয়। পশ্চিমবঙ্গে আইআরইএফ অনুমোদিত অপর ইউনিয়ন, ইস্টার্নরেলওয়ে এম্প্লয়িজ ইউনিয়নের উদ্যোগেও ধর্মঘটের সমর্থনে প্রচার কর্মসূচী শুরু হয়ে গেছে। ১৭ নভেম্বর কাঁচরাপাড়া কারখানা গেটে প্রচার কর্মসূচী অনুষ্ঠিত হয় এবং আগামী সপ্তাহে হাওড়া, ব্যান্ডেল সহ বিভিন্ন জায়গায় প্রচার কর্মসূচীর পরিকল্পনাও তারা নিয়েছে। ১১ নভেম্বর অনুষ্ঠিত আইআরইএফ-এর কোর কমিটির মিটিং থেকে ২৬-এর ধর্মঘটের সমর্থনে ২৩ থেকে ২৬ নভেম্বর প্রতিটি জোনে লিফলেট বিলি, কালো ব্যাজ ধারণ, গেট মিটিং ইত্যাদি কার্যক্রম করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সেই অনুযায়ী পূর্ব, দক্ষিণপূর্বরেলে ও চিত্তরঞ্জন লোকোমোটিভ ওয়ার্কসে ধর্মঘটের সমর্থনে রেলশ্রমিকদের সংগঠিত করতে জোরদার কর্মসূচী নিতে আইআরইএফ অনুমোদিত ইউনিয়নগুলি সংকল্পবদ্ধ।
২৬ নভেম্বর সাধারণ ধর্মঘট। চটকলে এআইসিসিটিইউ অন্তর্ভুক্ত ‘বেঙ্গল চটকল মজদুর ফোরাম’ সহ অন্যান্য ২১টি ট্রেড ইউনিয়ন ৭ অক্টোবরের মিটিং থেকে ধর্মঘটে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ২৬ নভেম্বরের সাধারণ ধর্মঘটে কেন্দ্রীয় ৭ দফা দাবির সাথে চটকল শ্রমিকদের নিজেদের ১০ দফা দাবি যুক্ত করা হয়েছে। ইতিমধ্যেই চটকলের সব ইউনিয়ন একসাথে মিলে ধর্মঘটের বিজ্ঞপ্তি কেন্দ্রীয় সরকার, রাজ্যসরকার, আইজেএমএ, জুট কমিশনার এবং প্রতিটি মিল কর্তৃপক্ষকে দিয়েছে।
ধর্মঘটের নোটিশে কেন্দ্রীয় সরকারের শ্রমিক বিরোধী শ্রমবিধি প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়েছে। বলা হয়েছে শ্রম আইন সংশোধন করে শ্রমিকদের সর্বনাশ করা হচ্ছে। মধ্যশযুগীয় বর্বর শোষণ ব্যেবস্থা কায়েম করার চেষ্টা চলছে। এছাড়াও বকেয়া লকডাউন মজুরি বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। চটকল মালিকদের শ্রমিক বিরোধী ভূমিকায় তীব্র ক্ষোভ শ্রমিকদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে। চটকল অধ্যুষিত হাওড়া, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, হুগলি এবং উত্তর ২৪ পরগনায় যৌথ ভাবে মিটিং মিছিল গেট সভা প্রচার কর্মসূচী শুরু হয়েছে। সিদ্ধান্ত হয়েছে শ্রমিক মহল্লায় মশাল মিছিল ও প্রধানমন্ত্রীর কুশপুতুল দাহ করার কর্মসূচী। দেওয়ান লিখন, পোস্টিরিং-এর কাজ প্রায় শেষের মুখে। মিলে মিলে স্ট্রাইক কমিটি গঠনের চেষ্টা চলছে। ধর্মঘটের দিন ভোর থেকেই গেটে পিকেটিং করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ধর্মঘটের দিন যত এগিয়ে আসছে শ্রমিকদের একতা ও মেজাজ ততো বাড়ছে। শ্রমিকদের দাবিতে চিন্তিত রাজ্যের শ্রমমন্ত্রী মলয় ঘটক তড়িঘড়ি ইউনিয়নগুলোর সাথে ২৩ নভেম্বর দ্বিপক্ষীয় মিটিং ডাকতে বাধ্য হয়েছেন।
এদিকে আবার মিল কর্তৃপক্ষ এবং জুট বিক্রেতাদের মধ্যে নতুন সংঘাত দেখা দিয়েছে। কাঁচা পাটের দর আকাশ ছোঁয়া! আইজেএমএ চেয়ারম্যান রাঘবেন্দ্র গুপ্তা রাজ্যের অর্থ ও বানিজ্য মন্ত্রীকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন জুনজুলাই মাসে কাঁচা পাট ওঠার পর থেকেই দাম বাড়তে থাকে। জুন মাসে কুইন্টাল প্রতি কাঁচা পাটের দাম ছিল ৪,৬০০টাকা, যা নভেম্বরে এসে দাঁড়িয়েছে ৬,১০০ টাকায়। অভিযোগ পাট ব্যবসায়ীদের একটা বড় অংশ (এই পাট ব্যবসায়ীরা বেশিরভাগই চটকল মালিক) পাটের বেআইনি মজুত করাতেই কাঁচা পাটের দাম বাড়ছে। আইজেএমের অভিযোগ পাওয়ার পর ‘জুট কমিশনার অব ইন্ডিয়া’ পাটের যোগান বাড়াতে মজুতের পরিমাণ ১,৫০০ কুইন্টাল থেকে কমিয়ে ৫০০ কুইন্টাল করার নির্দেশ জারি করেছে এবং ১৭ নভেম্বর থেকে তা কর্যকর হবে। পাটের মজুতদারি কমাবার নির্দেশের ক্ষুব্ধ কাঁচা পাট ব্যবসায়ী সংগঠন ‘দ্য জুট বেলার্স অ্যাসোসিয়েশন’ ২৩ নভেম্বর থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ব্যবসা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। চটকল মালিকরা জানাচ্ছে কেন্দ্রের বরাত পাওয়া চটের বস্তার তাদের চার লক্ষ বেল সরবারহ বাকি রয়েছে, এরকম চলতে থাকলে নির্দিষ্ট সময়কালে ৫০ শতাংশ বস্তাও সরবারহ করা যাবেনা। রাজ্য সরকার ২৪ নভেম্বর সমস্যা সমাধানে ‘দ্য জুট বেলার্স অ্যাসোসিয়েশন’ এবং আইজেএমএ-কেও এই মিটিং-এ ডেকেছে। দেখা যাক এই মজুতদারি, পাটের দর এবং বস্তা সরবারহ কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়? তবে এই দ্বন্দ্বে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শ্রমিকরা। কারণ কাঁচা পাটের কৃত্রিম অভাব ও মূল্যবৃদ্ধিতে উৎপাদন কম হচ্ছে এবং উদ্বৃত্ত শ্রমিক সংখ্যা বাড়ছে। এরকম সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতিতে চটকল শ্রমিকরা ধর্মঘটের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আমাদের আশা যতই প্ররোচনা আসুক শ্রমিকরা তার মোকাবিলা করেই ১০০ শতাংশ ধর্মঘট সফল করবেন।
- নবেন্দু দাশগুপ্ত, বিসিএমএফ
আমরা আজ সারা দেশজুড়ে এক ভয়ঙ্কর সংকটের মুখে এসে পড়েছি। একদিকে মহামারির প্রকোপ, অন্যদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। শ্রমিকরা কাজ হারিয়েছে। কম মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য হয়েছে বহু মানুষ, বিশেষ করে মেয়েরা। আজ ভারতবর্ষে ২৫.৩% মহিলা কাজ পায়।
মার্চ মাসে এক অপরিকল্পিত লকডাউন বহু কোটি শ্রমিককে এক অসহায় অবস্থায় ফেলে দিয়েছিল বোম্বাই, দিল্লী, বেঙ্গালুরুর মত শহরে। কাজ বন্ধ থাকার জন্য তাঁদের না ছিল হাতে কোন পয়সা, না ছিল খাদ্য, না ছিল বাসস্থান। কিন্তু ভাষণ দেওয়া ছাড়া আর কিছুই সুরাহা করে নি এই মোদী সরকার। তাই বাধ্য হয়েই প্রতিকুলতার মধ্যেই শ্রমিকরা তাদের পরিবার নিয়ে পথ হাঁটতে শুরু করে নিজেদের গ্রামে ফিরে যাবার জন্য। আর মহিলারা অসহায় নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে নিজের শিশুকে কোলে নিয়ে পথ চলতে বাধ্য হয়েছে। এই রকম অনেক দৃশ্য সোশ্যাল মিডিয়া, টিভি, খাবরের কাগজে আমরা সকলেই দেখতে পেয়েছি। সেই সময় মোদী সরকারের অমানবিক চেহারাও দেখেছে দেশের মানুষ।
লকডাউনকে কাজে লাগিয়ে ইতিমধ্যেই মোদি সরকার শ্রম আইনকে বাঞ্চাল করে দিয়েছে। শ্রমিকদের আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে অর্জিত ৪৪টি শ্রম আইনকে খর্ব করে চারটে শ্রম কোডের ছাতার তলায় আনা হল। মহিলা শ্রমিকরা তাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হলেন। ২০১২ সালের নির্ভয়া আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে মহিলাদের উপর যৌন হেনস্থার বিরুদ্ধে অভ্যন্তরীণ অভিযোগ জানানোর জন্য কমিটি গঠন করা বাধ্যতামূলক ছিল কিন্তু এই শ্রম কোডে তা নেই। এতদিন মহিলারা নাইটশিফটে কাজ করতেন না। সকাল সাতটার আগে আর সন্ধ্যা সাতটার পরও এবার মহিলাদের কাজে লাগাতে পারবে মালিকপক্ষ। আগে কোন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে মহিলাদের নিয়োগ করাটা ছিল আইন বিরুদ্ধ। কিন্তু নতুন শ্রম কোড এই সমস্ত কিছু বদলে দিল। এখন থেকে খনি সহ যে কোনো বিপজ্জনক কাজে/পেশায় মহিলাদের নিয়োগ করা যাবে। এর ফলে অত্যন্ত শ্রম সাধ্য, ঝুঁকিপূর্ণ কাজে কম মজুরিতে মহিলাদের নিয়োগ করার অবাধ ছাড়পত্র পেয়ে গেল মালিকপক্ষ। শ্রম কোডে অত্যন্ত ভাসাভাসা কথায় বলা হয়েছে যে মহিলাদের নিয়োগের প্রশ্নে নিয়োগকর্তাকে কিছু রক্ষাকবচ রাখতে হবে, অর্থাৎ, এ ব্যাপারে মালিক পক্ষের মর্জির উপরই গোটা ব্যাপারটা ছেড়ে দেওয়া হোল। নিয়োগকর্তাকে কোন আইনি বাধ্যতায় নিয়ন্ত্রিত রাখল না সরকার। মাতৃত্বকালীন ছুটির উপর নেবে এসেছে নানাধরনের শর্ত। ফলে সন্তান সম্ভবা মহিলাদের কর্মচ্যুত করাটা অনেক সহজ হয়ে যাবে। যে শ্রম কমিশনের সুপারিশে ৪৪টি কেন্দ্রীয় শ্রম কানুনকে চারটে কানুনে মিশিয়ে দেওয়া হল সেই কমিশনের আরও সুপারিশ ছিল — আশা, অঙ্গনওয়াড়ি, মিড ডে মিল কর্মীদের যেন কেন্দ্রীয় সরকার ‘শ্রমিক/কর্মচারি’ হিসাবে স্বীকৃতি দেয়, তাঁরা যেন পায় পি এফ, ইএসআই-এর মতো সামাজিক সুরক্ষা, আর তারা যেন পায় ন্যূনতম মজুরি। কিন্তু এইসব সুপারিশকে আমলই দিল না মোদি সরকার। মূলত ৭০% মহিলারাই দেশব্যাপী এইসব পেশার সঙ্গে যুক্ত। চরম ঝুঁকি নিয়ে কোভিড যুদ্ধে সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে লড়াই করলেও মোদী সরকার তাদের বঞ্চিতই রাখল।
বিরোধীদের কথা বলতে না দিয়ে সংসদে জোর করে পাশ করা হল কৃষি বিল। প্রায় ৮০% কৃষিক্ষেত্রে মহিলা শ্রমিক কাজ করে। তবে মহিলাদের জমির মালিকানা ২%- এরও কম। এমনকি নারী কর্ষকদের মজুরি পুরুষদের তুলনায় কম। আজ ও ক্ষেতে কাজ করা মহিলারা চাষির মর্যাদা পান না। ফলে নানা রকম সরকারি সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকেন। বীজ, সার, আর সেচের ব্যবস্থা করতে কৃষক পরিবারের মহিলাদের ঋণ নিতে হয়, মাইক্রো ফিনান্স বা অন্যান্য ঋণজালে তারা জড়িয়ে পরে। এবং পরিশোধ না করতে পারলে নানা রকম অত্যাচারের সম্মুখীন হয়। বর্তমানে পশ্চিমবাংলায় লকডাউন ও তার পর আম্ফানের ফলে বিক্রি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে স্বনির্ভরগোষ্ঠি সহ সমস্ত খেটে খাওয়া মহিলারা। তাই ঋণ মুক্তির দাবিতে সরব হয়েছেন তারা। আদানি আম্বানিদের কোটি কোটি টাকা ছাড় দিলেও মোদী আমিত শাহ সরকার এই গরিব মহিলাদের এক পয়সাও ছাড় দিতে নারাজ। তারই মাঝে বর্তমানে এই নয়া কৃষি আইন কৃষিপণ্যের সরকারী সংগ্রহ বা ফসল কেনার ব্যবস্থা পুরোপুরি বন্ধ করে দিল। নয়া কেন্দ্রীয় কৃষি আইন আসলে কর্পোরেট পুঁজিপতিদের হাতেই কৃষিকে তুলে দিচ্ছে। এই আইনের মধ্যে দিয়ে চুক্তিচাষের কথা বলে জমি হাতাতে পাড়বে পুঁজিপতিরা, চাষিকে গোলাম বানাতে পারবে, জলের দরে কিনে কৃষিপণ্য মজুত করে আইন সংগতভাবে চড়া দামে কালোবাজারি চালাতে পাড়বে, এ ছাড়াও জমির লুটেরা বা কালোবাজারিরা সমস্ত রকম ট্যাক্স, লেভি বা সেস ছাড়ের সুবিধা পাবে। যেমন ভাবে রেল, কয়লা টেলিকমকে বেসরকারীকরণ করা হচ্ছে একইভাবে এখন কৃষিক্ষেত্রকে কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়াও নতুন যে শিক্ষা নীতি এই সরকার এনেছে তার মধ্যে দিয়ে সরকারের শিক্ষা ক্ষেত্রে যাও বা দায়িত্ব ছিল তাও ঝাড়ে ফেলে দিয়ে চূড়ান্ত বেসরকারীকরণ করে দিচ্ছে শিক্ষাকে। দেখা যাবে যেটুকুনও মেয়েরা পড়ার সুযোগ পাচ্ছিলো তাও আর পাবে না।
এইসব প্রশ্ন নিয়েই আমরা আগামী ২৬ নভেম্বার ধর্মঘট করব। বিভিন্ন কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন, বহু কৃষক সংগঠন, গ্রামীণ মজুরদের সংগঠন, ছাত্র-যুব-মহিলা সংগঠন একত্রিত হয়ে এই সাধারণ ধর্মঘটকে ভারত বন্ধের চেহারা দেবে। শোষণ অত্যাচারের চাকাকে একদিনের জন্য হলেও স্তব্ধ করে দিতে আপনিও সামিল হোন এই সাধারন ধর্মঘটে।