অসামান্য, কিংবদন্তী, সর্বকালের সেরা ফুটবলারদের মধ্যে একজন। বিরলতম প্রতিভা অথচ সদা বিতর্কিত! সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সামনে চোখে চোখ রেখে পক্ষ বেছে নেওয়া এক অকুতোভয় মানুষ এবং তৃতীয় বিশ্বের প্রতি অমলিন ভালোবাসা - ফুটবলের জগতে এই বিপরীত বৈশিষ্ট্যযুক্ত চরিত্রের উদয় খুবই কম দেখা গিয়েছে। মারাদোনাকে হয়তো এই ভাবেই মনে রাখবে গোটা দুনিয়া।
বুয়েনস আইরেসে ৬০ বছর আগে জন্মানো দরিদ্র শিশুটার জীবন্ত কিংবদন্তী হয়ে উঠার কাহিনী-ই আর্মান্দোর জীবন। তাঁর শৈশবের দল লস সেবোলিটাসকে টানা ১৩৮টা ম্যাচ অপরাজিত রেখেছিলেন এই বিস্ময় প্রতিভা। মাত্র ১৬ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক ফুটবলে ‘পরিচিত’ নীল-সাদা জার্সি গায়ে আর্জেন্টিনার হয়ে মাঠে নামেন দিয়েগো। তাঁর পায়ের ‘অবিশ্বাস্য’ শিল্পের জোর বিশ্বের তামাম ডিফেন্ডারের সামনে কার্যত তাঁকে অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছিল। দেশের হয়ে ৯১টি ম্যাচে ৩৪টি গোল করেন মারাদোনা। কেবল সংখ্যার বিচারেই এর গুরুত্ব বিচার করা চলে না। ১৯৮৬-র বিশ্বকাপ সেই বিরলতম প্রতিভার সাক্ষী এখনও। যার জেরে তামাম বিশ্ব ফুটবল বিশেষত ভারতীয় উপমহাদেশের ফুটবল দুনিয়া ভাগ হয়ে যায় ব্রাজিলের পাশাপাশি আর্জেন্টিনা শিবিরে। ইংল্যাণ্ডের সাথে তাঁর সেই বিখ্যাত ‘হ্যান্ড অফ গড’ গোল ফুটবল দুনিয়ায় আজও প্রবল বিতর্কিত। ম্যাচের কিছু আগেই ইংল্যাণ্ড ও আর্জেন্টিনা দুই দেশের মধ্যে রাজনৈতিক বিবাদ তুঙ্গে। চলছে ফকল্যান্ডের যুদ্ধ।
ম্যাচের ৫১ মিনিটের মাথায় ইংল্যাণ্ডের গোলকিপার পিটার শিলটনের মাথার উপরে লাফিয়ে মুষ্টিবদ্ধ হাতের ঠেলায় গোল করেন দিয়েগো। স্বভাবতই বিতর্ক-টিপ্পনী চলছিল মাঠেই। কিন্তু তাঁর নাম তো মারাদোনা। জবাব দেওয়া যাঁর স্বভাবগত। ঠিক ঐ বিতর্কিত গোলের চার মিনিট পরেই ফুটবলের ইতিহাসে সেরা ‘বিস্ময় গোল’ উপহার দিলেন তিনি। নিজেদের হাফে বল ধরে স্বপ্নের দৌড়ে একের পর এক ইংরেজ ফুটবলারকে ধরাশায়ী করে গোলকিপার শিলটনের প্রতিরোধ ভেদ করে গোল করলেন তিনি। ধারাভাষ্যকার বলে উঠেছিলেন “নিজেদের চোখে অলৌকিক দেখলাম আমরা। এমন গোলও হয়?” ম্যাচ জেতার পরে আর্মান্দো বলেছিলেন “ম্যাচ জেতাটাই লক্ষ্য ছিল না। উদ্দেশ্য ছিল ইংরেজদের পর্যুদস্ত করা”। হ্যাঁ, এমনটাই ছিলেন মারাদোনা।
প্রবাদপ্রতীম ফুটবলার হয়েও আন্তর্জাতিক সমস্ত চাপ অগ্রাহ্য করেই ৮৬-র বিশ্বকাপ জেতার পরেই আর্মান্দো ছুটে যান সমাজতান্ত্রিক কিউবায়!! যার দুই পায়ের জাদুতে সারা বিশ্ব মুগ্ধ তিনি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেলেন ফিদেল কাস্ত্রোর বিপ্লবের কাহিনীতে। মাদকাসক্ত হয়ে পড়ায় জাতীয় দল থেকে ছিটকে গিয়েছিলেন ১৯৯০ সালে। নিজের দেশের দরজা বন্ধ হয়ে গেলেও সেদিন পাশে পেয়েছিলেন কিউবা ও কাস্ত্রোকে। হাভানার “লা পেদ্রেরা”-তে চিকিৎসার পরে সুস্থ হয়ে ফিদেলকে তার ‘দ্বিতীয় পিতা’র আখ্যা দিয়েছিলেন মারাদোনা। বহুবার সরাসরি বলেছেন, “সাম্রাজ্যবাদ নয় সমাজতন্ত্রই ভবিষ্যৎ”। তাঁর এই নির্ভয়চিত্ততা তাঁর অজান্তেই তাঁকে করে তুলেছিল তৃতীয় বিশ্বের স্বপ্নের মুখ। যে মুখটা স্বপ্ন দেখার স্বাধীনতা দিয়েছিল তরুণ-তরুণীদের, যে মুখটা স্পষ্টভাবে পক্ষ নিতে শিখিয়েছিল মানুষকে, যে মুখটা সমার্থক হয়ে উঠেছিল ‘অবিশ্বাস্য’ শব্দটার সাথে, সেই মুখটার নাম মারাদোনা। বুক চিতিয়ে বাঁচতে শেখানো আর্মান্দোর এই আকস্মিক মৃত্যুতে শেষ হল এক স্বপ্নালু অধ্যায়ের। তবে তাঁর কিংবদন্তী চিরকাল থেকে যাবে যাবতীয় বিতর্ক নিয়েই।
- অঙ্কিত মজুমদার