বিহার ২০২০ বিধানসভা নির্বাচনের একটি নজরকাড়া বৈশিষ্ট্য হল পার্টি এবং জোটের ইস্তাহার নিয়ে ভোটদাতাদের মধ্যে তীব্র আগ্রহ ও তাদের অংশগ্রহণ। এবার, বিহারের জনসাধারণ – তার যুব সম্প্রদায়, শ্রমিক, কর্মচারি, মহিলারাই বিহার রাজনীতির কেন্দ্রে ছুঁড়ে দিলেন চাকরি, সম কাজে সম মজুরি, অধিকার এবং মর্যাদার প্রশ্ন।
আরজেডি, কংগ্রেস, সিপিআই(এমএল), সিপিআই এবং সিপিএম-এর মহাজোটের (মহাগাঠবন্ধন) প্রচারে এবার বিহারের তরুণ সম্প্রদায়ের এইসব জরুরি ভাবনাগুলিই প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, সঙ্গে রয়েছে কর্মসংস্থান সমস্যার মোকাবিলায় প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে সরকারী দপ্তরে কয়েক লক্ষ শূন্য পদ পূরণের দৃঢ় অঙ্গীকার। ‘পরিবর্তনের জন্য প্রতিশ্রুতি’র ২৫ দফা সনদে মূল জোর রয়েছে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দীর্ঘদিন ধরে শূন্য পড়ে থাকা পদগুলি পূরণ, শোষণমূলক চুক্তিভিত্তিক কাজ বন্ধ করা, সম কাজে সম বেতন সুনিশ্চিত করা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে আরও ব্যয় বাড়ানো এবং কৃষকদের মোদী সরকারের পাস করা কৃষক-বিরোধী আইন থেকে সুরক্ষিত করা।
মুখ্যত শূন্য পড়ে থাকা সরকারী পদগুলি পূরণের মাধ্যমে ১০ লক্ষ চাকরি সুনিশ্চিত করার যে প্রতিশ্রুতি মহাজোট দিয়েছে তাকে এনডিএ সরকার বিদ্রূপ করেছে। কেন্দ্রীয় বিজেপি নেতৃবৃন্দসহ মুখ্যমন্ত্রী নীতীশকুমার বিহারে তাদের নির্বাচনী জনসভায় ১০ লাখ চাকরির নম্র প্রতিশ্রুতিকে ‘অবাস্তব’ বলে হেসে উড়িয়ে দিয়েছেন। অথচ, বিজেপি’র ইস্তাহার ১৯ লাখের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে! ১০ লাখ কাজের সংস্থান যদি অসম্ভব হয়, তাহলে ১৯ লক্ষ কাজের সংস্থান কীভাবে সম্ভব হবে? রহস্যের সমাধান হয়ে যাবে যদি আমরা প্রধানমন্ত্রীর ‘আত্মনির্ভর’ বিহার বা ভারতের প্রতিশ্রুতির মধ্যে যে সংকেত রয়েছে তার অর্থোদ্ধার করি! ‘স্বনির্ভরতা’ হচ্ছে মূলত ‘নিজের ভরণপোষণ নিজে করো’-কে একটু অন্যভাবে বলা। ‘পকোড়া বেচার’ মতো অত্যন্ত নড়বড়ে উপায়ে মানুষের কোনওক্রমে কষ্টেসৃষ্টে বেঁচে থাকাকে প্রধানমন্ত্রী ‘আত্মনির্ভরশীল কর্মসংস্থান’ বলে চালিয়ে দিয়েছেন, আর অন্যদিকে সরকার নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির যাবতীয় দায়িত্ব কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলেছে।
নীতিনৈতিকতা আর নির্লজ্জতার সমস্ত সীমা ছাড়িয়ে বিজেপির ইস্তাহার বিহারবাসীকে বিনামূল্যে কোভিড ১৯-এর টিকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী যখন বিধানসভা নির্বাচনের এই প্রতিশ্রুতির ঘোষণা দেন তখন বিষয়টি আরও ন্যক্কারজনক হয়ে ওঠে। মোদী সরকার, যারা কোভিড১৯-এর বিস্তার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ, যারা অপরিকল্পিত লকডাউনের সময় বিহার থেকে ভিন রাজ্যে খাটতে যাওয়া শ্রমিকদের অকথ্য নিষ্ঠুরতার শিকার হতে বাধ্য করেছে, তারা এখন ভ্যাকসিনের বিনিময়ে ভোট চাওয়ার নির্লজ্জ স্পর্ধা দেখাচ্ছে!
এনডিএ সরকারের বিরুদ্ধে ক্রোধের এক অমোঘ ঢেউ সমুদ্রলহরের মতো ক্রমশ ছড়িয়ে পড়েছে, যে সরকারের অপশাসনে রাজ্যকে কাটাতে হয়েছে পনেরোটা বছর। আর, ভিন রাজ্যে খাটতে যাওয়া বিহারের ভূমিপুত্রদের (যারা লকডাউনে ঘরে ফেরার জন্য কয়েকশো মাইল হেঁটে এসেছেন) বিহার সীমান্ত পেরোতে না দেওয়ার কথা বলে সরকারের উদ্ধত ঘোষণা সেই অপশাসনকেও ছাড়িয়ে গেছে। বিজেপি, যারা জোরের সঙ্গেই ঘোষণা করেছে যে এনডিএ জিতলে নীতীশকেই মুখ্যমন্ত্রী করা হবে, এই ক্রোধের আগুন থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন রাখার বৃথা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আসল সত্যিটা হল, বিজেপি এবং জেডিইউ যারা একসঙ্গে পনেরোটা বছর সাঁতার কেটেছে, তাদের একসঙ্গেই ডুবতে হবে।
বিজেপি’র (৩৭০ ধারা বিলোপ, অযোধ্যা এবং অন্যান্য প্রশ্নে) ঘৃণা ও বিদ্বেষের বিষ নিয়মিত গেলানোর চেষ্টা বিহারের ভোটদাতাদের উপর কোন কাজ করেনি। তারা মহাজোটের কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং শ্রমিক ও কর্মচারিদের অধিকার রক্ষার প্রতিশ্রুতিতে আবেগ ও উদ্দীপনার সঙ্গে সাড়া দিচ্ছেন। যখন যোগী আদিত্যনাথ তার জনসভাগুলিতে বলেন – বিহারের মানুষ এবার জম্মু ও কাশ্মীরে বাড়ির মালিক হতে পারবেন – বিহারের গরিব মানুষ তাকে মনে করিয়ে দেন যে এনডিএ সরকার তাদের বাস্তুজমি বন্টন করেনি যা নিজেদের রাজ্যেই প্রাপ্য ছিল, উল্টে তারা গরিবদের বস্তিগুলো বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছে।
বিহার নির্বাচন, চাকরি ও অধিকারের প্রশ্নকে সামনে এবং রাজনীতির কেন্দ্রে রেখে, আর সমস্ত সাম্প্রদায়িক ও গণতন্ত্র-বিরোধী বক্তব্যকে (ন্যারেটিভ) প্রত্যাখ্যান করে বিচার ছাড়িয়ে ভারতীয় রাজনীতির জন্য অ্যাজেন্ডা ঠিক করছে।
(এম এল আপডেট ২৭ অক্টোবর ২০২০)