১৯ নভেম্বর, বাঁকুড়া: সিপিআই (এম-এল) লিবারেশন সহ সিপিআই(এম), ফরওয়ার্ড ব্লক, আরএসপি দলের পক্ষ থেকে ধর্মঘটের সমর্থনে ৭টি দাবি সহ বাঁকুড়া জেলার আরও ৮ দফা দাবি নিয়ে DM অফিসে ডেপুটেশন জমা দেওয়া হয়।
উক্ত ডেপুটেশনে ২৬ নভেম্বর সারা ভারত জুড়ে যে ধর্মঘট পালন হতে চলেছে তার দাবিগুলো উপস্থাপন করা হয়। ডেপুটেশনের প্রারম্ভীক পর্যায়ে একটি মহামিছিল আয়োজন করা হয়। মহামিছিল হিন্দু স্কুল থেকে শুরু হয়ে DM অফিসের মোড় পর্যন্ত হয়। প্রায় হাজার দেড়েক মানুষ অংশগ্রহণ করেন। মিছিলের শেষে সভা করা হয় যেখানে মূল বক্তা ছিলেন সিপিআই(এম)-এর রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র। সভায় সভাপতিত্ব করেন অজিত পতি। সিপিআই(এমএল)-এর পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন জেলা সম্পাদক বাবলু। তাঁর বক্তব্য “বনের জমি থেকে আদিবাসী বনবাসীদের উচ্ছেদ হতে দিচ্ছি না। সরকার অবিলম্বে আদিবাসীদের পাট্টা সহ জমি দিক এবং নয়া কৃষি আইন, ৪টি শ্রম কোড এবং শিক্ষানীতি বাতিল করুক। এর পাশাপাশি ওনার আরো দাবি যে বিজেপির সাম্প্রদায়িক ছক - বাংলায় এনআরসি লাগু করা.... যেটা শুধু মুসলমানদের জন্য নয়, জেলার সমস্ত ভূমিহীন জনতাকেই বিশেষত আদিবাসী-দলিত জনতাকেও চরম বিপদের মুখে ঠেলবে। তাই এই ফ্যাসিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে লিবারেশন সামনের সারীতে থেকে লড়ছে, ভবিষ্যতেও আমরা আরো জোরালো গণআন্দোলন তৈরী করবো এটা আমাদের দৃঢ় সংকল্প।”
ডেপুটেশনের দাবিগুলির মধ্যে কয়েকটি হলো,
১) কৃষি ও শ্রমিক বিরোধী সকল আইন বাতিল করো।
২) প্রত্যেক গ্রামে ক্যাম্পের মাধ্যমে চাষীদের কাছ থেকে লাভজনক দামে ফসল ক্রয় করো।
৩) আয়কর বহির্ভূত পরিবারকে মাসিক ৭,৫০০ টাকা ও ১০ কেজি চাল, ডাল প্রদান করো।
৪) মনরেগা প্রকল্পে ২০০ দিনের কাজ ও দৈনিক ৬০০ টাকা মজুরি চালু কর।
৫) বনের জমি থেকে আদিবাসীদের উচ্ছেদ বন্ধ করে রেকর্ড সহ বনের জমির পাট্টা দাও।
৬) রেল, ব্যাংক সহ অন্যান্য সরকারী ক্ষেত্র পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দেওয়া চলবে না।
৭) সরকারী ও আধা সরকারী ক্ষেত্রে অস্থায়ী কর্মীদের স্থায়ীকরণ করে ১৮,০০০ টাকা নূন্যতম মাসিক মজুরি দিতে হবে।
১০টি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন ও ফেডারেশন সমূহের ডাকা ২৬ নভেম্বর ধর্মঘটকে সফল করতে ২রা নভেম্বর বাঁকুড়ায় আঞ্জুমান হলে যৌথভাবে ট্রেড ইউনিয়ন ও গণসংগঠনগুলির কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে এআইসিসিটিইউ-র পক্ষে বক্তা ছিলেন ফারহান। সংগঠনের পক্ষে তিনটি প্রস্তাব রাখা হয়: প্রথমত, ধর্মঘটটা যেহেতু কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধেই দেশব্যাপী ডাকা একটি সাধারণ ধর্মঘট, তাই এই ধর্মঘটের অভিমুখকে জোড় করে টেনে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড় করানো যাবে না। তাহলে সেটা কেবল নির্বাচনী ফায়দার কৌশলে রূপান্তরিত হবে, বরং আমাদেরকে আন্দোলনের মেজাজে ধর্মঘটকে সফল করার চেষ্টা করতে হবে, তা না হলে বামপন্থার সাথে চরম বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়ে যাবে। দ্বিতীয়ত, যত বেশি স্থানে সম্ভব ছোট-বড়ো প্রচারে, মিছিলে, সভায়, স্কোয়াড প্রচারে ট্রেড ইউনিয়ন ও গণসংগঠনগুলিকে ঐক্যবদ্ধভাবে উপস্থিত করতে হবে, এতে জনতাকে কনফিডেন্সে আনা সম্ভব হবে। তৃতীয়ত, প্রচারে সর্বাত্মকভাবে জোড় দিতে হবে, দেওয়াল লিখনের মাধ্যমে মানুষের কাছে এটা স্পষ্ট করতে হবে যে ‘কেন ধর্মঘট’ ও ‘কোন দাবিতে’ ধর্মঘট। কনভেনশনে তিনটি প্রস্তাবই সমর্থন পায় এবং জেলা স্তরে স্ট্রাইক কমিটি গঠন হয়, সেখানে আমাদের পক্ষ থেকে থাকেন জিতেন দিয়াঁশ ও বাবলু ব্যানার্জী।
প্রচার পর্বের শুরু থেকেই ছাতনা, বাঁকুড়া শহর বাঁকুড়া ১ ও ২নং ব্লক এবং বিষ্ণুপুর শহরে প্রায় সবকটি মিটিং ও কর্মসূচীতে এআইসিসিটিইউ-র তরফ থেকে শামিল হওয়া গেছে। প্রচারে অন্য মাত্রা যুক্ত হয় যখন সারা বাংলা গ্রামীন ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয় এআইকেএসসিসি-র তরফ থেকে এবং সিপিআই(এমএল) লিবারেশন সহ ১৬টি রাজনৈতিক দল এই ধর্মঘটকে সমর্থন জনানোর কারণে। ওন্দা ও রাণিবাঁধ বিধানসভাতে আমরাই স্বাধীনভাবে গ্রামীন বনধের প্রচার সংঠিত করি। ৮ তারিখ ওলা হাট থেকে শুরু করে মাঝডিহা পর্যন্ত মাইক প্রচার করা হয় প্রায় ২০-২৫ কিমি পথ জুড়ে। এরসাথে চারটি স্থানে সংক্ষিপ্ত পথসভাও হয়, যেখানে মূল বক্তা ছিলেন বাবলু ব্যানার্জী এবং আদিত্য ধবল। ১১ তারিখ বিষ্ণুপুর শহর থেকে শুরু করে ওন্দা পর্যন্ত মাইক প্রচার করা হয়। এই দিনও রামসাগরে সবজি হাটতলা সহ ওন্দায় কৃষি বাজারে ও আরো কয়েকটি স্থানে পথসভা করা হয় যেখানে প্রধান বক্তা ছিলেন মঙ্গল মুর্ম্মু ও বাবলু ব্যানার্জী। ২৪ তারিখ রাণিবাঁধ ও খাতড়া ব্লক জুড়ে ব্যাপক অঞ্চলে মাইক প্রচার সহ রানিবাঁধ সব্জি বাজার, খাতড়ায় পাম্প মোড়, গোড়াডি মোড়ে পথসভা করা হয়, সেখানে বক্তব্য রাখেন ফারহান ও বাবলু ব্যানার্জী এবং সাঁওতাল ভাষায় বক্তব্য রেখে তাক লাগিয়ে দেন কমরেড মঙ্গল মুর্ম্মু। ২৫ তারিখে খাতড়া শহরে যৌথভাবে মিছিল সংগঠিত হয়, মিছিল শেষে যৌথ সভা থেকে বক্তব্য রাখেন বাবলু ব্যানার্জী। ওন্দা, হীড়বাঁধ, খাতড়া, রাণিবাঁধ ব্লক ও বিষ্ণুপুর শহরে ভালো সংখ্যক দেওয়াল লিখনেও কমরেডরা দারুন উৎসাহ দেখান ফলত, পোষ্টারিং সহ বেশ চোখে পরার মতো প্রচারও হয়েছে এসব জায়গাতে। বিষ্ণুপুরে ৪টি গণকনভেনশন হয় যৌথ উদ্যোগে। এই কনভেনশনগুলিতে বক্তব্য রাখেন ফারহান ও তিতাস গুপ্ত। স্কোয়াড প্রচার ও মিছিলেও আমাদের উপস্থিতি মানুষের কাছে আমাদের লড়াই আন্দোলনে থাকার নিশ্চয়তাকে দৃঢ় করেছে। এরসাথেই নির্মাণ শ্রমিক ইউনিয়ন, AISA ও AIPWA-র পক্ষ থেকেও বিষ্ণুপুরে কুমারী টকিজ, ইন্দিরা মার্কেট ও রবীন্দ্র স্ট্যাচু মোড়ে তিনটি পথসভা করা হয় ১৭ই নভেম্বর। এই তিনটি পথসভাতে বক্তা ছিলেন তিতাস গুপ্ত, বিল্টু ক্ষেত্রপাল, সুশান্ত ধীবর, প্রান্তিক দাশগুপ্ত ও মঙ্গল মুর্ম্মু। ধলডাঙ্গা মোড়ে বামপন্থী ছাত্রযুবদের একটি যৌথ পথসভা হয় ২৩ তারিখে, সেখানে AISA’র পক্ষে বক্তা ছিলেন মঙ্গল।
জেলার সবকটি কর্মসূচী থেকেই ধর্মঘটের ৭ দফা দাবিকে ব্যাখা করার পাশাপাশি বিজেপির ‘আচ্ছে দিনের’ ভাঁওতামির মুখোশ খুলে দেওয়া হয়। ব্যাক্তি পিছু ১০ কেজি রেশনের দাবি, ২০০ দিনের কাজের দাবি, মজুরি বৃদ্ধি সহ লকডাউন ভাতা চালু ও সকলের জন্য ৩,০০০ টাকা পেনশন চালুর দাবি এই ধর্মঘটকে জনতার কাছে সার্বিক করে তুলেছে। এরই সাথে ১৯ নভেম্বর সিপিআই(এমএল) লিবারেশন, সিপিআই(এম), সিপিআই, আরএসপি ও ফরওয়ার্ড ব্লকের পক্ষ থেকে ডিএম ডেপুটেশন সংগঠিত হয়। এই ডেপুটেশনে বনের জমি থেকে আদিবাসী ও বনবাসীদের উচ্ছেদ বন্ধ করে অবিলম্বে বনের ও চাষের জমির রেকর্ড সহ পাট্টা দেওয়ার দাবি করা হয়। এই ডেপুটেশনের সভাতে বক্তব্য রাখেন পার্টির জেলা সম্পাদক বাবলু ব্যানার্জী।
ধর্মঘটের প্রচার পর্বে আমরা অনেকাংশে সফল, কারণ INTUC থেকে শুরু করে CITU-র পক্ষ থেকেও বক্তব্য ও প্রচারের মূল নিশানা ছিল কেন্দ্রের জনবিরোধী ফ্যাসিস্ট মোদী সরকার। সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টির চক্রান্ত থেকে গণতন্ত্র হরণ এমনকি সারাদেশে আইনের শাসন-সংবিধানের শাসনকে ধ্বংস করে ‘জোর যার মুলুক তার’ নিয়ম চালু করার বিজেপির প্রচেষ্টাকে জনতার সামনে নিয়ে আসা হয়। নারী-মুসলমান-আদিবাসী-দলিত বিদ্বেষী আরএসএস-এর কর্মকান্ডগুলিকেও বারং বার ফাঁস করা হয় এই সম্পূর্ণ প্রচার পর্ব জুড়ে। ধর্মঘটের দিন ভোরবেলা থেকেই রাস্তায় থেকে, অবস্থান ও মিছিলের মধ্যে দিয়ে ধর্মঘটকে সফল করার জন্য সমস্ত কমরেডরা চাক্কা জ্যাম-এর লক্ষ্যে পুরোপুরি প্রস্তুত।