তৃণমূল কংগ্রেস আভ্যন্তরীণ ক্ষমতার গোষ্ঠী সংঘাতের পরিণামে প্রায় নিশ্চিত এক ভাঙ্গনের মুখে। ভাগ্যের কি নিষ্ঠুর পরিহাস! সেই তোপ শোনা যাচ্ছে নন্দীগ্রামে প্রতাপশালী ‘অধিকারী পরিবার’ থেকে আসা দাপুটে দল নেতা-মন্ত্রীর মুখে। যে নন্দীগ্রামের ভূমি উচ্ছেদ বিরোধী আন্দোলন তৃণমূলকে রাজ্যের মসনদে পৌঁছে দিয়েছিল, সেখানে এখন দল দুভাগ হওয়ার অবস্থা। তৃণমূলের ক্ষমতায় আরোহণের পথ সুগম হয়েছিল আরেক কৃষিজমি রক্ষা আন্দোলনের সুবাদে যে সিঙ্গুর থেকে, সেখানেও দলে দুর্নীতি ও ক্ষমতার সংঘাতকে কেন্দ্র করে অশান্তি বাসা বেঁধেছে বেশ ক’বছর। দল দীর্ণ হচ্ছে স্থানীয় জনগণের বিভিন্ন অংশের সাথেও সংঘাতে জড়িয়ে। অন্দরে প্রবীণ মাস্টার মশাই আর উঠতি দাদা-নেতার মধ্যেকার গোষ্ঠিদ্বন্দ্ব, বাইরে ‘জমি ফেরত দেওয়া’ ও কৃষিকে পুনরুদ্ধার করার প্রশ্নে সদিচ্ছা ও গুরুত্ব প্রদানকে কেন্দ্র করে দল আর জনগণের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব — এই দুই সংঘাতে সিঙ্গুরে তৃণমূলের পায়ের তলা থেকে মাটি ক্রমেই সরে সরে যাচ্ছে। না, সিপিএমের দিকে তার কোনো প্রত্যাবর্তন ঘটেনি, ঘটছে না, বরং ঘোর বিপদজনক বিপথগামী হয়েছে বিজেপির প্রভাবে। গত লোকসভা নির্বাচনে ওখানে বিজেপির দিকে সিপিএমের প্রতি হতাশগ্রস্ত অংশ শুধু নয়, টিএমসি-র প্রতিও বীতরাগবশত একাংশ চলে গিয়েছিল। অবশিষ্ট বিক্ষুব্ধ টিএমসি গোষ্ঠী এখন পরোক্ষে আসন্ন ভাঙ্গনের সংকেত দিতে শুরু করেছে নন্দীগ্রামের ‘দাদার কীর্তি’র সপক্ষে থাকার জানান দিয়ে। নন্দীগ্রামে তৃণমূলের শিবিরে যা ঘটছে সেটা দলনেত্রী ও তাঁর ঘনিষ্ঠ নেতৃত্বচক্র স্বীকার না করলেও রাজ্যের শাসক দলের অভ্যন্তরে অনেকটা বজ্রপাতের মতো, ধ্বস নামার মতো। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর এতবড় ভাঙ্গনের মুখে পড়েনি। এর আগে দলের প্রাক্তন দু’নম্বর নেতা ও তার একান্ত আপন গোষ্ঠী বেরিয়ে গিয়ে বিজেপিতে ঢুকেছে, বিজেপি শর্ত দিয়েছে তৃণমূল ভেঙ্গে ফায়দা তোলার প্রমাণ দিয়ে চলার, গোষ্ঠীচক্রগুলো লুফেও নিয়েছে সেই কারবার। তমলুকের ‘অধিকারী সাম্রাজ্যের’ অধীশ্বরের নয়া হৈ হল্লা তোলার রাজনৈতিক মতিগতি যদিও এখনও খুব স্পষ্ট নয়, তবে তাঁর ওপর যে বিজেপির বেশ কিছুকাল যাবত নজর রয়েছে তা বোঝার অপেক্ষা রাখে না। আঞ্চলিক শাসক দল তৃণমূলে যে ভাঙ্গনের প্রবণতা চলছে তার প্রধান প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ গন্তব্য বিজেপি। এভাবে বাংলার ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনের আগে বেড়ে চলেছে বিজেপি বিপদ। এই বিপদ ওরা যে বাড়াতে পারছে তার পেছনে অবশ্যই তৃণমূলী অপশাসনের জনপ্রতিক্রিয়া এবং তার নেতৃত্বের ভেতরকার নানা ক্ষমতার সংঘাত বেশ বড় কারণ। অন্য ভাষায় বললে খাল কেটে বিজেপির ধেয়ে আসার সুবিধা করে দেওয়ার জন্য তৃণমূল অবশ্যই দায়ী।
তবে বিজেপি-ই হয়ে উঠছে সবচেয়ে বড় বিপদ এবং তার সবথেকে বড় বড় কারণগুলো রয়েছে বিজেপির মধ্যেই। তার ফ্যাসিস্ট মতাদর্শ ও রাজনীতি, কর্পোরেটমুখী সংস্কার কর্মসূচী, দেশব্যাপী হামলা নামানো ও দখল অভিযান চালানোর মধ্যে। বিজেপি মানেই সংবিধান ও গণতন্ত্রের সমূহ বিপদ, বিদ্বেষ-বিভাজনের বিষাক্ত সাম্প্রদায়িক রাজনীতির মেরুকরণে পরিবেশ-পরিস্থিতি বিষিয়ে যাওয়া। বিহারে কোনোক্রমে গরিষ্ঠতা জুটে যাওয়া জোট সরকারের চালকের আসনের দখল হাসিল করে বিজেপি হুমকি দিচ্ছে ২০২১-এর নির্বাচনে বাংলা দখলের।
বিপরীতে, বিজেপিকে মোকাবিলার কার্যকরী নতুন আশা-ভরসাও জাগিয়েছে বিহারে বাম শক্তিসমূহের আত্মঘোষণা। তাই বিহারে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন বামপন্থীরা তা থেকে শিক্ষা নিয়ে বাংলার বুকে আরও দৃঢ়তার সাথে চ্যালেঞ্জ নিয়ে থাকতে হবে রণাঙ্গনে। বামপন্থার নির্ণয়ে বিজেপিকেই গণ্য করতে হবে প্রতিরোধের প্রধান লক্ষ্যবস্তু, সেই ধারায় তৃণমূলকেও বুঝিয়ে দেওয়া যাবে কাকে বলে জবাব।