রিজার্ভ ব্যাংকের একটি আভ্যন্তরীণ কমিটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ব্যবস্থা আরও উন্নত ও লাভজনক করার লক্ষ্যে কর্পোরেট সংস্থাকে ব্যাংক খোলার লাইসেন্স দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। ২০১৩ সালে এইরকম একটি প্রস্তাব এসেছিল কিন্তু আইডিএফসি এবং বন্ধন ফিনান্সিয়াল সার্ভিসেস ব্যতীত আর কেউই শীর্ষ ব্যাংক নির্ধারিত যোগ্যতার মান অর্জন করেনি। ২০১৪ সালে রঘুরাম রাজন যখন রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন তখন কর্পোরেটদের ব্যাংক খোলা নামঞ্জুর করে দেওয়া হয়। ঝাড়পোঁচ করে আবার সেই প্রস্তাবটি ঝুলি থেকে বার করা হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক সংস্কারের প্রসঙ্গ উঠলেই সরকারের একটাই সমাধানসূত্র - বেসরকারীকরণ। এটাই বিশল্যকরণী, সব সমস্যার সমাধান করে দেবে। এবার কর্পোরেটদের মাধ্যমে সেটা করার প্রস্তাব।
শুরুতেই বলে রাখা ভালো এটা ব্যাংক শিল্পে অবধারিতভাবে বিপর্যয় ডেকে আনবে। প্রথমত কোনো কর্পোরেট সংস্থা ব্যাংক চালানোর অর্থ মালিক ও পরিচালক এক হয়ে যাবে, বাণিজ্যিক পুঁজি ও ব্যাংক পুঁজি হবে একাকার। ‘কানেকটেড’ লেন্ডিং, অর্থাৎ যে ঋণ দিচ্ছে এবং যে ঋণ নিচ্ছে দুজন একই ব্যক্তি, ইতিমধ্যেই চালু আছে, এটা নতুন কিছু নয়। সম্প্রতি হয়ে যাওয়া ইয়েস ব্যাংকের সংকট জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ। মূল প্রমোটার রানা কাপুর তাঁর তাঁবেদার বিভিন্ন সংস্থাকে দেদার ঋণ দেয়, সেখান থেকে দফায় দফায় তাঁর স্ত্রী, কন্যাদের অ্যাকাউন্টে টাকা জমা হয়। ২০০৪ থেকে শুরু করে দশ বারো বছরের মধ্যে ব্যাংক ফুলেফেঁপে ওঠে তারপর হুড়মুড় করে সেটির পতন হয়। শেষমেশ স্টেট ব্যাংক তাদের ৪৯% শেয়ার কিনে আমানতকারীদের রক্ষা করে। প্রায় ৪৫০০ কোটি টাকা তছরুপের দায়ে রানা কাপুর এখন ইডির তদন্তাধীন। ‘কানেকটেড’ লেন্ডিং বাস্তবে ক্রোনি লেন্ডিং। ঋণগ্রহিতার ব্যবসার ঠিক মতো যাচাই হয় না, তাঁর লেনদেনের মূল্যায়ন করা হয় না, শুধুমাত্র মালিক/পরিচালকের সাথে সম্বন্ধ বা যোগসাজশের কারণে তাকে সাধারণ মানুষের গচ্ছিত অর্থ পাইয়ে দেওয়া হয়। চাটুকারদের রমরমা বাড়ে, ব্যাংক ধসে পড়ে। ১৯৯৭-৯৮ সালে জাপান, কোরিয়াতে এরকমটা হয়েছে।
দ্বিতীয়ত কর্পোরেটরা যদি ব্যাংকের মালিকানা পায় তাহলে তারা প্রায় একছত্র অর্থনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী হবে যা তারা খেয়ালখুশি মতো ব্যবহার করতে পারবে। মনে রাখতে হবে সরকারি ব্যাংকের আমানত প্রায় ১৪০ লক্ষ কোটি টাকা যা আদানি, আম্বানিরা সামান্য কিছু বিনিয়োগ করে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। এই ধনকুবেররা তাদের সীমাহীন অর্থনৈতিক প্রতিপত্তি কাজে লাগিয়ে ছোটখাটো ব্যাংক এবং আর্থিক সংস্থাগুলি করায়ত্ত করবে, ব্যাংক শিল্পে তাদের একচেটিয়া আধিপত্য কায়েম হবে। অত্যন্ত প্রভাবশালী রাজনৈতিক যোগাযোগের কারণে রিজার্ভ ব্যাঙ্কও এদের ক্রীড়ানকে পরিণত হবে। শীর্ষ ব্যাংক সংকটের গভীরতা অনুমান করতে পারলেও এই ধনকুবেরদের প্রবল প্রভাবের কারণে সংকটের মেরামতের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে দ্বিধা করবে। গত অক্টোবর মাসে আমেরিকার কংগ্রেস গুগল, ফেসবুক, অ্যাপেল, অ্যামাজনের বিরুদ্ধে ছোট সংস্থাকে বিপন্ন করা ও একচেটিয়া অধিকার কায়েম করার অভিযোগ আনে এবং এই প্রবণতা রোধ করার জন্য এদের ব্যবসার কিছু অংশ খণ্ডিত করার প্রস্তাব আনে। এর থেকে বোঝা যায় বাণিজ্যিক ও ব্যাংক পুঁজির মেলবন্ধন এবং সেটির একচেটীয়াকরণ রাজনৈতিক ব্যবস্থাকেই অসহায় ও সংকটাপন্ন করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।
তৃতীয়ত এই কর্পোরেটদের আরও বহু ব্যবসায় বিনিয়োগ আছে। যেমন আম্বানিদের টেলিকমে বিপুল বিনিয়োগ আছে, আদানিদের আছে তেল, গ্যাস, বিদ্যুতে। এঁদের ব্যবসার ক্ষেত্র ক্রমবর্ধমান, প্রতিনিয়ত তা অজানা অনাবিষ্কৃত ক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়ছে। এতে মুনাফা যেমন আছে, ঝুঁকিও আছে। এই বিশাল সাম্রাজ্যে বিনিয়োগ উত্তরোত্তর বাড়াতে তারা সরকারি ব্যাংকের সম্পদ কাজে লাগাবে, এই সম্পদ ঐ ঝুঁকির শিকার হবে অথচ সেটি থেকে মুনাফার কারণে ব্যাংক শিল্পের এতটুকুও লাভ হবে না। সরকারি ব্যাংকের এই সম্পদ তাঁদের অন্যান্য ব্যবসার উত্থান পতনের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জুড়ে যাবে। এরফলে ব্যাংকে টাকা জমা রাখা আম আদমির পক্ষে আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাবে।
ব্যাংক শিল্পের সংকট নিয়ে সরকারের দুশ্চিন্তার শেষ নেই। অনুৎপাদক সম্পদ বাড়ছে, মূলধন নেই, পরিষেবা খারাপ। অতএব বেসরকারীকরণ কর। অথচ গত পঞ্চাশ বছরে যত ব্যাংক ফেল করেছে তার অধিকাংশই বেসরকারী। ইদানিং তিনটি ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে, তিনটিই প্রাইভেট -পাঞ্জাব এন্ড মহারাষ্ট্র কো-অপারেটিভ ব্যাংক, ইয়েস ব্যাংক এবং লক্ষ্মীবিলাস ব্যাংক। ইয়েস ব্যাংকের মতো পিএমসি ব্যাংকেও যাবতীয় সম্পদ মূল প্রমোটার ওয়াধাওয়াদের স্বার্থে কাজে লাগানো হয়েছে। ব্যাংকের মোট ঋণের প্রায় ৭৫%, এদের সংস্থা HDIL করায়ত্ত করেছে। ভাবা যায়! এটা যদি ক্রোনি লেন্ডিং না হয় তো কোনটা? এরফলে প্রায় ৫২,০০০ গ্রাহক গত পনেরো মাস ধরে চূড়ান্ত হেনস্থার সম্মুখীন হচ্ছে, কয়েকজন আত্মহত্যা করেছে। একই কারণে লক্ষ্মীবিলাস ব্যাংকও সংকটে। সেটাকে সিঙ্গাপুরের ডিবিএস ব্যাংকের হাতে তুলে দেওয়া হল। আত্মনির্ভরতা চূলোয় তুলে, ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রে চুপিসাড়ে বিদেশী ব্যাংকের পদার্পণ ঘটল।
সুতরাং বেসরকারিকরণ কোন সমাধানই নয়। সরকারি ব্যাংক পরিচালনায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ কর। নেতা তার পছন্দসই লোককে সিএমডি বানিয়ে দিয়ে তাকে দিয়ে নিজের চাটুকারদের ঋণ বিলি করবে এবং সেগুলি অনতিবিলম্বে এনপিএতে পরিণত হবে এবং তার ফলে অধস্তন অফিসার ও কর্মচারীদের অদক্ষ, অকর্মণ্য, অলস বলে গাল দেওয়া হবে এবং পুরো সরকারি ব্যবস্থাটাই অচল বলে দেগে দেওয়া হবে এই প্র্যাক্টিশ বন্ধ কর। ব্যাংক পরিচালনায় স্বচ্ছতা আন। রিজার্ভ ব্যাংকের মনিটরিং আরও কড়া, সতর্ক ও নিরপেক্ষ হোক। বারবারই তোতা পাখির মতো বলা হয় অনুৎপাদক সম্পদ বাড়ছে, মূলধন নেই। তা এই অনুৎপাদক সম্পদ উদ্ধারের প্রচেষ্টা নেওয়া হচ্ছে না কেন? এআইবিএ, ব্যাংক কর্মচারীদের সর্ববৃহৎ কর্মচারী ইউনিয়ান সরকারি ব্যাংকে উইলফুল ডিফল্টারদের (যারা ইচ্ছাকৃত ভাবে ঋণপরিশোধে অক্ষম) একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। ২,৪২৬টি এই ধরণের সংস্থার থেকে ব্যাংকের মোট পাওনা ১.৪৭ লক্ষ কোটি টাকা। এদের সর্বাগ্রে কুখ্যাত মেহুল চোক্সির গীতাঞ্জলী জেমস লিমিটেড। এই বিপুল অঙ্ক উদ্ধারে সরকার সচেষ্ট হোক। এতে নানা ছুতোয় গ্রাহকদের থেকে এখন যে টাকা কাটা হচ্ছে তা বন্ধ হবে। হয়তো আমানতের ওপর সুদও কিছু বাড়ানো যাবে। অর্থনীতির এই চরম সংকটকালে তাদের কিছু সুরাহা দেওয়া যাবে।
- সোমনাথ গুহ