২ নভেম্বর ২০২০ পোলবার সেঁইয়া সংলগ্ন বালিটানা গ্রামে সমবেত হয়েছিলেন অসংখ্য মানুষ, আদিবাসী মঞ্চের সংগঠক কমরেড বিশ্বনাথ সরেনের স্মরণসভায়। হরিপাল থেকে বলাগড়, ধনেখালি, পোলবা, দাদপুর, পাণ্ডুয়া সহ জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে এসেছিলেন আদিবাসী মঞ্চের পতাকাতলে সংগ্রামরত তাঁর সহযোদ্ধারা। কলকাতা থেকে ছুটে এসেছিলেন পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদের রাজ্য সম্পাদক কমরেড নীতীশ রায়, শীলা দে সরকার, কোন্নগর থেকে এসেছিলেন আইসা সংগঠক সৌরভ, সিপিআই(এমএল) জেলা কমিটির পক্ষে উপস্থিত ছিলেন মুকুল কুমার শুভাশীষ চ্যাটার্জী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ।
৫৫ বছরের জীবনযুদ্ধ শেষে গত ১৪ অক্টোবর ২০২০ কলকাতার পিজি সংলগ্ন রামরিক হাপাতালে মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ জনিত কারণে দীর্ঘ ১২ দিন অসচেতন অবস্হায় কাটিয়ে ভোররাতে অকালে বিদায় নেন কমরেড বিশ্বনাথ সরেন। রেখে গেছেন স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, পুত্রসম জামাই সহ গুণমুগ্ধ হাজারো মানুষকে, যাদের উদ্যোগে ছিল এই স্মরণসভা।
সকলের প্রিয়, সাহসী, বিনয়ী, মৃদুভাষী নেতা বিশ্বনাথ সরেন ছিলেন সারা বাংলা আদিবাসী অধিকার ও বিকাশ মঞ্চের রাজ্য কমিটির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও হুগলি জেলার সহ সভাপতি। কমরেড বিশ্বনাথ শুধু আদিবাসী নেতা ছিলেন না, তিনি ছিলেন সমস্ত মেহনতি মানুষের লড়াইয়ের সাথী, বামপন্থী আদর্শে আজীবন স্হির বিশ্বাস ছিল তাঁর। এই আদর্শবোধ, গরিব মানুষের অধিকার রক্ষার লড়াইয়ের প্রতি দায়বোধ থেকেই তিনি সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের সদস্যপদ গ্রহণ করেন। আমৃত্যু ছিলেন লিবারেশনের ধনেখালি, পোলবা-দাদপুর এরিয়া কমিটির সদস্য।
সমবেত সকলেই স্মরণ করলেন এই পর্যবেক্ষণ যে আদিবাসী মঞ্চের প্রতিটি সভায় কমরেড বিশ্বনাথদা তুলে ধরতেন আদিবাসীদের প্রতি বঞ্চনার ইতিহাস। এই বঞ্চনাকে তিনি অন্তর থেকে ঘৃণা করতেন; বঞ্চনার বিরুদ্ধে, আদিবাসী সমাজের উন্নয়নের দাবিতে বারবার ডাক দিতেন ‘হুল’ মাহা’র। অন্যায়ের প্রতিবাদ জানানোর জন্য তুলে ধরতেন জননেতা সিধু, কানহুর জীবন সংগ্রামের কথা। বলতেন, এই জমি, জঙ্গল সবকিছুই ছিল আদিবাসীদের। আজ সেখান থেকেই সাঁওতালদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে। স্মরণসভার শুরুতে বাজছিল তাঁর গান, যে গানের মূল বিষয় আদিবাসী কৃষকদের, সাঁওতালদের বীরত্ব কাহিনী।
এসবই তাঁকে আদিবাসী জনগণের নেতৃত্বে তুলে এনেছিল। কৃষক জনগণের আপনার জন করে তুলেছিল। তাঁর স্মৃতিতে গান গাইতে গিয়ে তাই চোখের জল ফেলছিলেন মঞ্চ নেত্রী আরতি হাঁসদা, সরস্বতী বেসরা সহ অনেকেই। পুত্র বিকাশ বাবাকে নতুন করে অনুভবের কথা তুলে ধরলেন। সিপিআই(এম)-র পোলবা-দাদপুর জোনাল সম্পাদক কমরেড মজিদ মণ্ডল ছিলেন প্রয়াত কমরেডের বিশেষ পরিচিত। তাঁর বক্তব্যে তিনি তুলে ধরেন কমরেডের লড়াকু চরিত্রের দিকটি। কমরেড মুকুল কুমার বললেন, আদিবাসী মঞ্চকে গড়ে তোলার অনেক আগে থেকেই বিশ্বনাথ সরেন ছিলেন একজন কমিউনিস্ট যোদ্ধা, সিপিআই(এমএল) সংগঠক। সভায় শেষ পর্যন্ত উপস্থিত ছিলেন কমরেডের স্ত্রী, লড়াইয়ের সাথী কমরেড সাগরী সরেন।
বালিটানায় এই বিশেষ সভাটি সংগঠিত করতে সিপিআই(এমএল) সংগঠক, কমরেড বিশ্বনাথ সরেনের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহযোদ্ধা গোপাল রায়ের পাশাপাশি সমান ভূমিকা পালন করলেন ওই গ্রামেরই আলপনা হাঁসদার নেতৃত্বাধীন আদিবাসী লোকশিল্পী দলের সকল সদস্যারা, যে দলটি অনেক যত্নে গড়ে তুলেছিলেন প্রয়াত বিশ্বনাথ সরেন।
বিশ্বনাথ সরেন ছিলেন একজন সাধারণ কৃষিজীবী, গরিব কৃষক; প্রতিদিন কঠোর পরিশ্রম করে যাঁকে বেঁচে থাকতে হতো। আবার তিনিই ছিলেন এমন এক বিপ্লবী নেতা, যাঁর রক্তে ছিল সিধু, কানহু, ভগবান বীরসার সার্থক উত্তরাধিকার। যিনি অন্যায়, অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ডাক দেওয়ার সাহস রাখতেন। আদিবাসীদের শোনাতে পারতেন বিদ্রোহের গান। সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রামের এমন একজন লড়াকু সহযোদ্ধাকে মনে রাখার সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য পথ হল বিশ্বনাথ সরেনের সংগ্রামকে অব্যাহত রাখা, স্মরণ সভায় উপস্থিত সকলের এই উপলব্ধি বারবার উচ্চারিত হচ্ছিল নানান জনের বক্তব্যে। স্মরণ সভা হয়ে উঠেছিল সমবেত মেহনতি জনগণের অঙ্গীকার সভা। নীতীশ রায়ের গান পরিবেশকে করে তুলেছিল মর্মস্পর্শী।
কমরেড বিশ্বনাথ সরেন, তোমায় আমরা ভুলিনি, ভুলবো না।