প্রিয় সাথী,
এক গভীর সংকটের বাঁকে দাঁড়িয়ে রয়েছে আমাদের দেশ। দেশের অর্থনীতি আজ একেবারে তলানিতে। মোদীর অপরিকল্পিত ও পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে কঠোর লকডাউন গোটা দেশে কল্পনাতীত দুর্গতি ডেকে আনল। এক লহমায় লক্ষ কোটি শ্রমজীবী মানুষ কাজ খোয়ালো, রুটি-রুজি আর মাথার উপর এক চিলতে ছাদ হারিয়ে লাখে লাখে পরিযায়ী শ্রমিকদের অভাবনীয় দুর্দশা গোটা দেশ, সারা পৃথিবী দেখল। স্বাধীনতার পর দেশ ভাগের সময়েও এমন নির্দয় মানবিক সংকট কখনো দেখা যায়নি।
গোটা দেশ যখন অতিমারির ভয়ংকর থাবায় আক্রান্ত, তখন মোদির আশীর্বাদে মুকেশ আম্বানি প্রতি ঘন্টায় পকেটে ঢোকালো ৯০ কোটি টাকা, আত্মপ্রকাশ করল বিশ্বের চতুর্থতম ধনকুবের হিসাবে। একের পর এক বিমানবন্দর বেচে দেওয়া হল আম্বানি আদানিদের, আর লকডাউনের পর্যায়ে শ্রমিক কর্মচারিদের বেতন দেওয়া, কাউকে কাজ থেকে বসিয়ে না দেওয়ার যে আদেশনামা বলদর্পী অমিত শাহ’র মন্ত্রক করেছিল, তাকে তামাশায় পরিণত করল দেশী বিদেশি কর্পোরেটরা। সেন্টার ফর মনিটারিং অফ ইন্ডিয়ান ইকনমি জানাচ্ছে, অতিমারীর আগেই দেশে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা ছিল ৩.৫ কোটি, আর কোভিডের পর নতুন করে ২.১ কোটি বেতনভুক কর্মী কাজ হারায়, যার ফিরে আসার কোনো সম্ভাবনাই আর নেই। জুলাই মাসে কর্মচ্যুত হয়েছেন ৪০ লক্ষ ৮ হাজার মানুষ, আর আগস্টে সেই সংখ্যাটা হল ৩০ লক্ষ ৩ হাজার।
এরকম সার্বিক এক মহাসংকট থেকে সাময়িক পরিত্রাণ পেতে দেশের তাবড় তাবড় অর্থনীতিবিদ কেন্দ্রীয় সরকারকে প্রস্তাব দেয়, আয়কর আওতায় যারা নেই, জনগণের সেই বৃহৎ অংশের হাতে নগদ টাকা তুলে দাও, অন্তত ৬ মাস সকলকে নিখরচায় পর্যাপ্ত রেশন দাও, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোকে মজবুত করে সরকারী খরচ বাড়াও, এই পর্যায়ে যারা কর্মহীন হয়েছেন, তাদের কাজে ফেরাতে ব্যবস্থা নাও। কিন্তু মোদী সরকার সেই সমস্ত পরামর্শকে বিন্দুমাত্র আমল না দিয়ে উল্টো রাস্তা ধরলো। দেশের দুই বুনিয়াদি শ্রেণী – শ্রমিক ও কৃষকদের উপর নামিয়ে আনলো বিরাট বড় হামলা। এক শতাব্দীব্যাপী রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে যে সমস্ত অধিকারগুলো ঔপনিবেশিক যুগ থেকে শুরু করে পরবর্তীতে আদায় করেছিল ট্রেড ইউনিয়নগুলো, তা মাত্র তিন ঘন্টার সংসদ অধিবেশনে সব ছিনিয়ে নিল। নজিরবিহীনভাবে কৃষি বিল পাশ করালো বলপূর্বকভাবে, গজোয়ারি করে। নতুন শ্রম কোড মালিক পক্ষকে দিয়ে দিল ছাঁটাই করার অবাধ অধিকার। স্থায়ী কাজ, স্থায়ী শ্রমিকদের পরিণত করা হলো ফিক্সড টার্ম কন্ট্রাক্টে, প্রবর্তন করা হলো এক নতুন দাস প্রথা। সমকাজে সমমজুরির আইন নিক্ষিপ্ত হলো ডাস্টবিনে, ধর্মঘটের সাংবিধানিক অধিকার চুলোয় গেল, লক্ষ লক্ষ স্কীম কর্মীদের দেওয়া হলো না ন্যূনতম বেতন, সামাজিক সুরক্ষার অধিকার বা শ্রমিকের স্বীকৃতি; কন্ট্রাক্টরের গায়ে পরিয়ে দেওয়া হলো নিয়োগকর্তার জামা। গোটা শ্রম বাজার এই শ্রম কোডের দৌলতে ছেয়ে যাবে অস্থায়ী, ক্যাজুয়াল, ঠিকা শ্রমিকে। বাড়িতে বাড়িতে গৃহ নির্মাণের কাজে যুক্ত নির্মাণ শ্রমিকরা এরপর থেকে পাবেন না নির্মাণ কল্যাণমূলক বোর্ডের কোনো ধরনের সুযোগ সুবিধা। এরপর যে কোনো ঝুঁকিপূর্ণ কাজে, রাতের শিফটে মহিলাদের নিয়োগ করা যাবে, কিন্তু আইসিসি গঠনের যে বাধ্যতা এতদিন আইনত ছিল, এরপর তাও থাকবে না। মাতৃত্বকালীন ছুটিকে বিদায় জানানো হলো। জেলা ভিত্তিক শ্রম আদালত তুলে দিয়ে রাজ্যে করা হবে একটা মাত্র শ্রম আদালত। এইভাবে শ্রম বিরোধ নিরসনের প্রক্রিয়া হয়ে গেল জটিল, নাগালের বাইরে।
সমস্ত রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোর ঢালাও বেসরকারীকরণ এখন মোদী সরকারের নীতি। মাত্র চারটি সংস্থাকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখে বাকি সবগুলোকেই বেচে দেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে অর্থমন্ত্রী। রেল বেচে দেওয়া হচ্ছে। এরপর বেসরকারী সংস্থা যাত্রী ভাড়া ঠিক করার স্বাধীনতা পাবে, আর বন্ধ হবে সমস্ত ধরনের ভর্তুকি। লক্ষ লক্ষ রেল কর্মীকে ধরানো হচ্ছে বাধ্যতামূলক স্বেচ্ছা অবসর গ্রহণের কাগজ। গোটা দুনিয়া যখন প্যান্ডেমিক পরবর্তী পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রায়ত্ত বা সরকারী সংস্থাগুলোকে মজবুত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তখন একমাত্র মোদী সরকার বিপরীত পথে হাঁটছে।
আর অন্যদিকে লকডাউনের অজুহাতকে কাজে লাগিয়ে দীর্ঘদিন লোকাল ট্রেন বন্ধ রাখা হয়েছে। নিত্যযাত্রী, মেহনতি মানুষের জীবনে যাতায়াত বন্ধের ফলে নেমে এসেছে এক চরম দুর্দশা। প্রায় লক্ষাধিক রেল হকারদের রুটি-রুজি বন্ধ।
অত্যাবশকীয় পণ্য আইনকে তুলে দিয়ে মোদী কালোবাজারি ও মজুতদারদের হাতকে শক্তিশালী করলো। তিনটি কৃষি আইন এবার দেশের গোটা কৃষি ক্ষেত্রকে নিয়ে আসবে কর্পোরেটদের দখলে। একই ভাবে নতুন শিক্ষা নীতিও শিক্ষাঙ্গনকে নিয়ে আসবে ব্যক্তি মালিকানাধীন সংস্থা ও কর্পোরেটদের কব্জায়। আর গোটা শ্রম বাজার ও শিল্প ক্ষেত্রই এরপর পরিচালিত হবে ইনফর্মাল, ক্যাজুয়াল ও ঠিকা শ্রমিকদের মাধ্যমে। যেখানে থাকবে না কাজের কোনো নিশ্চয়তা, শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও সামাজিক সুরক্ষা। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিজেপির হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদ ও আর্থিক ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদী বিদেশী কর্পোরেটদের কাছে আত্মসমর্পণই হলো মোদীর বহু ঢাক পেটানো আত্মনির্ভর ভারত অভিযানের মূল কথা।
মোদীর আমলে ভারত যেন পরিণত হয়েছে বিরাট এক জেলখানায়। যে কোনো বিরোধী কন্ঠস্বর বা ভিন্ন মতাবলম্বীদের দমন করা হচ্ছে চরম নির্দয়ভাবে গোটা দেশ জুড়ে যেন এক অলিখিত জরুরী অবস্থা জারি আছে। গণতন্ত্রের সমস্ত প্রতিষ্ঠান আজ ভুলুন্ঠিত। সমগ্র দেশ, জাতি, দেশের সংবিধান চরম বিপদের মুখে। স্বাধীন ভারতে এতো বড় বিপদ এর আগে আসেনি কখনো।
এর বিরুদ্ধে দেশের কেন্দ্রীয় ইউনিয়ন ও ফেডারেশন সমূহ আগামী ২৬ নভেম্বর ২০২০ সারা ভারত সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে। ওইদিন কৃষক সংগঠনগুলোও গ্রামীণ বনধের ডাক দিয়েছে। সমস্ত বামপন্থী দল, বিভিন্ন ছাত্র-যুব-মহিলা সংগঠনও এই ধর্মঘটকে সর্বাত্বকভাবে সমর্থন জানাচ্ছে।
আসুন, মোদীর ফ্যাসিস্ট জমানার থেকে দেশকে মুক্ত করার প্রথম ধাপ হিসাবে ২৬ নভেম্বর ২০২০ সাধারণ ধর্মঘটকে সফল করে তুলি।
সংগ্রামী অভিনন্দন সহ,
এআইসিসিটিইউ,
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি