পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদের প্রাক্তন সভাপতি গণগায়ক প্রবীর বল (মনা) গত ২ অক্টোবর প্রয়াত হয়েছেন বেশ কিছুদিন রোগভোগের পর। তাঁর প্রয়াণের পর গণসংস্কৃতি পরিষদ অন্তর্ভুক্ত কয়েকটি সংগঠন তাঁকে স্মরণ করেছেন। এছাড়াও গত ১২ অক্টোবর প্রবীর বলের সাংস্কৃতিক বন্ধুদের দ্বারা পরিচালিত সম্প্রীতি মনন পত্রিকা বারাসাতে একটি অনুষ্ঠানে কথায় গানে কবিতায় তাঁকে শ্রদ্ধা জানান। প্রয়াত শিল্পীকে স্মরণের এই ধারাবাহিকতায় সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানটি গত ১৬ অক্টোবর কলকাতার রিপন স্ট্রীটের ক্রান্তি প্রেস হলে পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদ কর্তৃক আয়োজিত হয়। ১ মিনিট নীরবতা পালনের পরে প্রয়াত গণশিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেন উপস্থিত সুধীজনেরা, যাদের মধ্যে পরিষদের প্রাক্তন সভাপতি বিপুল চক্রবর্তী, বর্তমান সভাপতি দেবাশীষ চক্রবর্তী, প্রবীরের দীর্ঘদিনের শিল্পীজীবনের অগ্রজ অমিত রায়, অনুজ অসীম গিরি, সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের রাজ্য সম্পাদক পার্থ ঘোষ, পলিটব্যুরো সদস্য কার্তিক পাল, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য জয়তু দেশমুখ, রাজ্য কমিটির সদস্য মীনা পাল, ভারতীয় গণসংস্কৃতি সঙ্ঘের রাজ্য সম্পাদক অমিতাভ চক্রবর্তী, নাগরিক আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ নেতা অমলেন্দুভূষণ চৌধুরী, বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক অধ্যাপক নিত্যানন্দ ঘোষ প্রমুখ। উল্লেখ্য যে, প্রবীর বল আমৃত্যু সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের সদস্য ছিলেন। অমিত রায় প্রবীরের স্মৃতিচারণ করার সময়ে গত ৯০-এর দশকে পরিষদের অন্যতম সংগঠক প্রয়াত অরিজিৎ মিত্রের সূত্রে মনার সঙ্গে আলাপের কথা বলেন ও তিনি কীভাবে মনার গানে আবিষ্ট হয়েছিলেন তার উল্লেখ করেন। তিনি বলেন যে সংক্ষেপে বললে বলতে হয় যে, মনা ছিলেন একজন অত্যন্ত ভালো গায়ক ও অত্যন্ত ভালো একজন মানুষ, সাংস্কৃতিক জগতের রেষারেষি যাকে কখনো ছুঁতে পারেনি। বিপুল চক্রবর্তী আক্ষেপের সঙ্গে মনে করিয়ে দেন যে প্রবীরের গানের রক্ষণাবেক্ষণ যথাযথ হয়নি। অসীম গিরি জানান যে, তিনি মনাদার গানের গুণমুগ্ধ শ্রোতা ছিলেন আর মনাদার ছিল গানের দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার অসামান্য ক্ষমতা। পরিষদের বর্তমান সভাপতি দেবাশীষ চক্রবর্তী প্রবীরের নেতৃত্বে পূবের আওয়াজ দলের জনপ্রিয়তার কথা উল্লেখ করে বলেন যে ভাবতাম আমি যেন পরজন্মে ও রকম গান গাইতে পারি। পার্থ ঘোষ প্রবীরের রাজনৈতিক দৃঢ়তার কথা উল্লেখ করে বলেন প্রবীর ছিল বামপন্থী নকশালবাড়ির রাজনীতির প্রতি নিবেদিত প্রাণ, তাঁর গানেও ছিল সেই রাজনীতির পরশ। তিনি জানান কীভাবে নদিয়ার কালিগঞ্জে ৭০-এর দশকের শেষ দিকে প্রবীর শাসক দলের শারীরিক আক্রমণের মুখে দাঁড়িয়ে গান গেয়ে ঢিল ছোড়াকে প্রতিরোধ করেছিলেন। কার্তিক পাল ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের প্রয়োজনীয়তাকে উল্লেখ করে প্রবীরকে সাংস্কৃতিক আন্দোলনে ঐক্যের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরেন।
স্মৃতিচারণের পাশাপাশি পরিষদের কর্মীরা গান ও আবৃত্তির মধ্য দিয়ে তাদের প্রিয় মনাদাকে স্মরণ করেন। শোভনা নাথ আবৃত্তি করেন, প্রণব মুখার্জী, সুব্রত ভট্টাচার্য ও বাবুনি মজুমদার সঙ্গীত পরিবেশন করেন। কান্ডীরের শিল্পীরা সমবেত কন্ঠে প্রবীরের সুর দেওয়া দুটি গানের (একটির কথা অরিন্দম সেনগুপ্ত ও অন্যটির প্রবীর বল) সুঠাম পরিবেশনের মধ্য দিয়ে জানান দেন যে প্রবীরের গানকে পরিষদ বাঁচিয়ে রাখবেই। অনুষ্ঠানের শুরুতে প্রবীরের প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধার্ঘ হিসেবে পরিষদের নিজস্ব ওয়েবসাইট www.paschimbangaganasanskritiparisad.org-এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন বিপুল ও দেবাশীষ চক্রবর্তী। এছাড়া প্রবীরের স্মৃতিচারণ সমৃদ্ধ মূল্যবান একটি স্মরণিকা, “আগুনে আমার রক্ত লেগে আছে” প্রকাশ করে পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদ।
প্রবীরের স্মরণে আয়োজিত অনুষ্ঠানটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অত্যন্ত সুচারু ভাবে সঞ্চালনা করেন পরিষদের সম্পাদক গণকবিয়াল নীতীশ রায়, পরিষদের সভাপতি দেবাশীষ চক্রবর্তীর পাশাপাশি সহসভাপতি সাগর চট্টোপাধ্যায়ও সারাক্ষণ মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া, পরিষদের অন্যান্য কর্মকর্তা বা সদস্য যেমন অরিন্দম সেনগুপ্ত, শীলা দে সরকার প্রমুখ প্রিয় মনাদার প্রয়াণে বিমর্ষ থাকলেও তাদের প্রচেষ্টায় সমগ্র অনুষ্ঠানটি মর্মস্পর্শী হয়ে উঠেছে; উপস্থিত ছিলেন প্রয়াত শিল্পীর শোকসন্তপ্ত স্ত্রী বাণী ও পুত্র অর্কনাভ ।
অনুষ্ঠানটি শেষ হয় সমবেত কন্ঠে ইন্টান্যাশনাল গানের মধ্য দিয়ে।