গত সোমবার ১২ অক্টোবর এলাহাবাদ হাইকোর্টের লক্ষ্মৌ বেঞ্চের বিচারপতিরা হাথরসের মনীষা বাল্মিকীর পরিবারের সদস্যদের কথা শোনার জন্য তাঁদের আদালতে উপস্থিত হতে বলেছিলেন। সেখানে হাথরসের পুলিশ কর্তাও হাজির হয়েছিলেন। দলিত মেয়ে মনীষা বাল্মিকীকে ধর্ষণ করা হয়নি বলে পুলিশ কর্তা মন্তব্য করলে বিচারপতি তাঁর উদ্দেশে প্রশ্ন রাখেন – “কী করে বলছেন ধর্ষণ হয়নি, তদন্ত কি শেষ হয়ে গিয়েছে? আপনার বা কোনো ধনী পরিবারের মেয়ে হলে পারতেন তার দেহ এভাবে পুড়িয়ে দিতে?” বিচারপতির এই প্রশ্নের মধ্যেই ধরা পড়েছে হাথরসের নির্যাতিতা সম্পর্কে উত্তরপ্রদেশ সরকার ও প্রশাসনের দৃষ্টিভঙ্গির নির্যাস। একদিকে নৃশংস নিপীড়নের শিকার দলিত কন্যাকে ন্যায়বিচার প্রদানে চরম উপেক্ষা ও অবহেলা, অন্যদিকে ধর্ষকদের অপরাধী সাব্যস্ত হওয়া থেকে রেহাই দেওয়ার জোরদার প্রচেষ্টা – এই লক্ষ্যেই চালিত হয়েছে উত্তরপ্রদেশ প্রশাসনের যাবতীয় সক্রিয়তা। পরিবারের তরফে এফআইআর-এ গণধর্ষণের অভিযোগ, ২২ সেপ্টেম্বর আলিগড় হাসপাতালে তদন্তকারী অফিসারের কাছে দেওয়া বয়ানে মনীষা চারজন মিলে তাকে ধর্ষণ ও গলায় ফাঁস লাগিয়ে মেরে ফেলার চেষ্টার কথা জানায়, মৃত্যুর আগে সফদরজং হাসপাতালে দেওয়া বয়ানে মনীষা আরও একবার ধর্ষণের কথা জানান — এ সব সত্ত্বেও পুলিশ প্রথম থেকেই এফআইআর-এ ধর্ষণের অভিযোগ ঢোকাতে অস্বীকার করেছে। এবং তার জন্য ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে ফরেন্সিক ল্যাবের রিপোর্টকে, যে ল্যাবে নমুনা পাঠানো হয়েছিল ধর্ষণকাণ্ডের ১১ দিন পর। পুরুষের বীর্য দু-দিনের বেশি বাঁচে না, ফলে এতদিন পর যোনিতে বীর্যের সন্ধান মেলা সম্ভব নয়, এ কথা জানার পরও পুলিশ ফরেন্সিক ল্যাব-এর রিপোর্টকে ধর্ষণ না হওয়ার অকট্য তথ্যপ্রমাণ হিসাবে জাহির করছে। ফরেন্সিক ল্যাব-এর রিপোর্টে বীর্যের সন্ধান মেলেনি বলে পুলিশ দাবি করলেও ওই রিপোর্টে যে নির্যাতিতার যোনিতে দুটো গভীর ক্ষতের কথা বলা আছে তা তারা পুরোপুরি এড়িয়ে গেছে।
তবে ঠাকুর সম্প্রদায়ের অভিযুক্তদের অপরাধকে ধামাচাপা দিতে প্রশাসন এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ফরেন্সিক ল্যাব-এর রিপোর্টের ওপর ভর করাকেই একমাত্র কৌশল করেননি। প্রমাণ লোপাট করতে নির্যাতিতার দেহকে রাতের অন্ধকারে পুড়িয়ে দিয়েছে। নির্যাতিতার বাবা জানিয়েছেন, “তারপর কয়েকজন পুলিশ বাইরে থেকে আমাদের দরজায় তালা দিয়ে দিল এবং মেয়ের দেহকে চাষের মাঠে নিয়ে গিয়ে রাজপুতদের বাড়ি থেকে জোগাড় করা ঘুঁটে ও কাঠ দিয়ে তড়িঘড়ি পুড়িয়ে দিল।” মেয়েকে শেষ দেখা, রীতিসম্মত অন্ত্যেষ্টির কোন অধিকার বাবা-মায়ের নেই, নিহত দলিত কন্যার দেহের ওপর দখল শুধু পুলিশের!
এরপর মেয়েটির চরিত্র নিয়ে কটাক্ষ করা, ফোন কলের তথাকথিত রেকর্ড হাজির করে নির্যাতিতা ও মূল অভিযুক্তর মধ্যে সম্পর্ক থাকার কথা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হল। তবে অভিযুক্তদের রক্ষায় আশ্রয় নেওয়া সবচেয়ে বিস্ময়কর কৌশলটা হল “সম্মান হত্যার” অভিযোগ। জেল থেকে লেখা চিঠিতে পুলিশ সুপারের কাছে এই অভিযোগটি জানিয়েছে অভিযুক্তরা। চিঠিতে তারা জানায় যে মনীষা বাল্মিকী তাদের পরিচিত ছিল। সেদিন মাঠে তারা মনীষার সঙ্গে কথা বলছিল। পরে সেখানে মনীষার মা ও অন্যরা চলে আসে। সন্দীপ (মূল অভিযুক্ত) বাড়ি চলে যায়। পরে শুনতে পায় মনীষার বাড়ির লোকজন তাকে মারধর করছে। তারাই মনীষাকে মেরে ফেলে অভিযুক্তদের ঘাড়ে দোষ চাপিয়েছে। মনীষার বৌদি জানিয়েছেন, এই অভিনব কৌশলটার উদ্যোক্তা বিজেপির দলিত সাংসদ রাজবীর দিলার। তিনি জেলে অভিযুক্তদের সঙ্গে দেখা করে তাদের দিয়ে চিঠিটা লেখান। সাংসদ অবশ্য বলেছেন, সেদিন তিনি জেলে গিয়েছিলেন কারণ জেলার তাঁকে “চা খাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।” জেলে গিয়ে অভিযুক্তদের সঙ্গে দেখা করে চিঠি লেখানোর কথা তিনি অস্বীকার করেন। এতদিন “সম্মান হত্যার” ব্যাপারটা উচ্চ বর্ণের ক্ষেত্রেই ঘটতে দেখা গেছে। উঁচু জাতের মেয়ে বা ছেলে দলিত বা পশ্চাদপদ জাতের ছেলে-মেয়েকে বিয়ে করলে পরিবারের “সম্মান” রক্ষায় তাদের হত্যা করা হত। ঠাকুর জাতের অভিযুক্তদের রক্ষার চেষ্টায় উচ্চবর্ণের নিজস্ব ও একচেটিয়া ব্যাপারটার ভাগও তবে দলিতদের দেওয়া হচ্ছে!
সংবিধানে সাম্যের কথা, সৌভ্রাতৃত্বের কথা লেখা থাকলেও সেই লক্ষ্যের বাস্তবায়নে রাষ্ট্রকে কোনোদিনই চালিত করা হয়নি। একদেশদর্শিতা, উচ্চবর্ণের আধিপত্য বরাবরেরই ব্যাপার ছিল। কিন্তু গত ছ-বছরে ব্রাহ্মণ্যবাদী মতাদর্শের আরও তীব্র হওয়া, তার আধিপত্য বেড়ে চলার সাথে উচ্চবর্ণের দাপটে এক মাত্রাগত পরিবর্তন এসেছে। দলিতদের দমিয়ে রাখার তাদের স্পৃহা আগের তুলনায় অনেক বেশি উজ্জীবিত হয়েছে, ফলে দলিত-বিরোধী উৎপীড়নের সংখ্যারও বৃদ্ধি ঘটেছে। পরিসংখ্যান বলছে উত্তরপ্রদেশে দলিত নারীদের বিরুদ্ধে সংঘটিত হিংসার সংখ্যা ২০১৪-র ১১৮৮ থেকে বেড়ে ২০১৬-য় দাঁড়ায় ২০২৬, এবং ২০১৯-এ তা ১৫৩৮ বলে দেখা যাচ্ছে। এগুলো কিন্তু নথিভুক্ত হওয়া সংখ্যা আর হিংসাঘটিত সব অপরাধই যে নথিভুক্ত হয় না তার উল্লেখ বোধকরি না করলেও চলবে। কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় ব্রাহ্মণ্যবাদী মতাদর্শের শক্তিগুলোর অধিষ্ঠানে উচ্চবর্ণের প্রতাপ অনেক বেড়ে যাওয়ায় পেশিশক্তির প্রয়োগকে তারা অবাধ করে তুলেছে এবং রাষ্ট্রও কুণ্ঠাহীনভাবে তাদের মদত করে যাচ্ছে। সৌজন্য ও আপাত-ন্যায়ের যে হাবভাব শাসক রাজনৈতিক দলগুলো অন্তত দেখানোর চেষ্টা করত, বিজেপি তাকে ভেঙ্গেচুরে দিয়েছে। তার আধিপত্যের পথে ন্যায়নীতির কোন বাধাকে সে মানে না। কাঠুয়ায় ৮ বছরের নাবালিকাকে মাদক খাইয়ে বেহুঁশ করে তার ওপর গণধর্ষণ চালানোর পর হত্যা করা হয়। আর ধর্ষকদের সমর্থনে হিন্দুত্ববাদী সংগঠন সংগঠিত জনসমাবেশে রাজ্য মন্ত্রীসভার দুই বিজেপি মন্ত্রী ভাষণ দিয়ে ধর্ষণকাণ্ডে পুলিশি তদন্তকে ‘জঙ্গলরাজ’ বলে অভিহিত করেন। উত্তরপ্রদেশের উন্নাওতে বিজেপি বিধায়ক কুলদীপ সিং সেঙ্গার অপ্রাপ্তবয়স্ককে তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে। অভিযোগ জানালেও পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয় না। মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের বাড়ির সামনে নির্যাতিতা প্রতিবাদে গায়ে আগুন দিলে তবেই প্রশাসন সক্রিয়তা দেখায়। যোগী জমানায় উচ্চবর্ণের বিশেষভাবে ঠাকুর সম্প্রদায়ের হাতে দলিতদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া, তাদের ওপর গুলি চালনা, তাদের জেলে পোরার মতো নিপীড়নের অনেক ঘটনাই ঘটেছে। দেশে লক্ষ-লক্ষ কন্যাভ্রূণ হত্যা হলেও সরকার-প্রশাসন মুখ ঘুরিয়ে থাকে। আর নির্মম বাস্তব প্রতিদিনই “বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও”-এর আহ্বানকে বিদ্রুপ করে চলে।
এখানে হাথরসের উচ্চবর্ণ শাসিত পঞ্চায়েত গণধর্ষণে অভিযুক্তদের নির্দোষ প্রতিপন্ন করার মহান উদ্যোগে নিজেদের শামিল করে। হাথরসের প্রাক্তন বিজেপি বিধায়ক রাজবীর সিং পালোয়ান অভিযুক্তদের সমর্থনে ঠাকুরদের সমাবেশ ঘটিয়ে দলিতদের ও দলিত নেতা চন্দ্রশেখর আজাদকে হুমকি দেন। যোগী আদিত্যনাথের পুলিশ বাহিনী তাদের স্পর্ধাকে চরম মাত্রায় তুলে দলিত পাড়াকে ঘিরে রেখে, নির্যাতিতার পরিবারের সদস্যদের ঘরে আবদ্ধ করে সাংবাদিক সহ বাইরের অন্য কারো সাথে তাদের কথা বলতে দেয় না। এখানে বাহুবলীদের মুখ নিঃসৃত রক্ত হিম করা হুমকি দেওয়ার দায়িত্বটা নিজের কাঁধে তুলে নেন জেলা শাসক — ‘বয়ান কি বদলাবে না? সাংবাদিকরা চিরদিন থাকবে না, দু-দিন পরে চলে যাবে। আমরা কিন্তু চিরদিন থাকব!’ মনে পড়ে যায় ‘আতঙ্ক’ ছবির সমাজবিরোধীর মুখ থেকে বেরোনো সেই সংলাপ – মাস্টারমশাই আপনি কিন্তু কিছুই দেখেননি! অযোধ্যা জমি মালিকানা মামলায় সুপ্রিম কোর্টের এবং বাবরি ধ্বংস মামলায় সিবিআই বিশেষ আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে হাথরসের ঠাকুর সম্প্রদায় এবং যোগী প্রশাসনের মধ্যে বোধকরি এই আত্মপ্রত্যয় জেগে থাকবে যে, হাথরস গণধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডে তারা অভিযুক্ত ঠাকুর যুবকদের নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ার রায় বার করে আনতে পারবে! এটাই আজ রাষ্ট্রের মার্কামারা মূর্তি! এটাই আজ ভারতের ‘নিউ নর্মাল’!
– জয়দীপ মিত্র