প্রতিবেদন
নগ্ন নারীবিদ্বেষ আর নোংরা রাজনীতির খেলা এবার বন্ধ হোক
dder

সাড়ে তিন মাস ধরে টিভি-র চ্যানেলে চ্যানেলে (অল্প ক’টি প্রশংসনীয় ব্যতিক্রম ছাড়া) চলছে একই সিরিয়ালের রকমারি উপস্থাপনা। শুরুটা হয়েছিল সুশান্ত সিং রাজপুতের আত্মহত্যা/হত্যা/প্ররোচনা-জনিত আত্মহত্যার দুঃখজনক ঘটনা থেকে। তারপর, যেমনটা হয়েই থাকে, সিরিয়ালে এসেছে নতুন নতুন মোড়। যেমন, রিয়া চক্রবর্তী এপিসোডে আমরা দেখেছি কীভাবে স্রেফ কিছু অভিযোগ ও অনুমানের ভিত্তিতে তাঁকে কালিমালিপ্ত করা হল। এখন (সেপ্টেম্বরের চতুর্থ সপ্তাহে) সিরিয়াল যে এপিসোডে পৌঁছেছে তার সঙ্গে মূল কাহিনীর যোগসূত্র নেই বললেই চলে। এখানে আমরা দেখছি এবং শুনছি কয়েকজন উদীয়মান অভিনেত্রীর মাদক-সংযোগ আছে কি নেই, তাই নিয়ে নোংরা কেচ্ছা। এঁদের মধ্যে আছেন দীপিকা পাডুকন, যিনি মাঝরাতে জেএনইউ’তে নির্যাতিত ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতিবাদ সভায় হাজির হয়ে সংহতি জানিয়ে এসেছিলেন।

নারকোটিকস কন্ট্রোল ব্যুরো (এনসিবি) অভিনেত্রীদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা মাত্র, আদালতে মামলা শুরু হওয়ার অনেক আগেই, চালু হয়ে গেল মিডিয়া ট্রায়াল। বিভিন্ন সিনেমা ও স্টেজ শো থেকে এমন সব বাছাই করা ভিডিও ক্লিপ চালানো হতে লাগলো যাতে তাঁদের ব্যক্তিত্ব বা অভিনয়-ক্ষমতা নয়, যৌন আবেদনটুকুই ফুটে ওঠে। এতে অবশ্য দুটো লাভ হল। এক, চ্যানেলের আকর্ষণ এবং টিআরপি বাড়ল। দুই, দর্শকদের একাংশের মনে বিষাক্ত ধারণাটি গেঁথে দেওয়া গেল যে, ‘এই ধরনের’ মেয়েরা ড্রাগ নেবে, তাতে আর আশ্চর্য্য কি!

চরিত্র হননের এই অভিযানে সংবাদ মাধ্যমের প্রধান অবলম্বন হচ্ছে এনসিবি থেকে বে-আইনী ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ‘লিক’ করে দেওয়া ‘খবর’। যেমন, একান্ত ব্যক্তিগত হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাট। ২০১৭ সালে সুপ্রিম কোর্ট ব্যক্তিগত পরিসরের অধিকারকে স্বীকৃতি ও সম্মান জানিয়ে যে রায় দিয়েছিল, তাকে গ্রাহ্যই করছে না এই সংস্থা। এইসব খবরের সত্যাসত্য জানার কোনো উপায় নেই, কারণ তথ্যের অধিকার আইন এই সংস্থায় প্রযোজ্য নয়। এবং এর দায়িত্বে আছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, যাঁর নারীবিদ্বেষী মানসিকতা অতীতে পরিষ্কার দেখা গেছে। এখন প্রশ্ন উঠছে, ফরদিন খান, সঞ্জয় দত্ত প্রমুখ অনেক অভিনেতাই তো মাদকাসক্তির কথা নিজেরা সংবাদ মাধ্যমে জানিয়েছেন বা এজন্য ধরা পড়েছেন। তাহলে এনসিবি কেন শুধুমাত্র মহিলাদের টার্গেট করছে? তার চেয়েও বড় কথা, এই সংস্থার কাজ তো দেশ জুড়ে এবং সীমান্ত পেরিয়ে মাদক চোরাচালান বন্ধ করা এবং এ ব্যাপারে শুল্ক দপ্তর ও রাজ্য পুলিশকে সাহায্য করা। এই মূল দায়িত্ব পালনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েই কি এনসিবি বিশিষ্ট অভিনেত্রীদের টার্গেট করে কাজ দেখাতে চাইছে? সংস্থাটির প্রথম ডিরেক্টর জেনারেল বি ভি কুমার সম্প্রতি রাজদীপ সারদেশাই-এর সঙ্গে এক প্যানেল-চর্চায় বলেছেন, এনসিবি তার আসল লক্ষ্য থেকে সরে যাচ্ছে।

তবে এসব কেবল এনসিবি আর মিডিয়ার ব্যাপার নয়। কুনাট্যের নাট্যকার খোদ শাসক দল। সব দেশের ফ্যাসিস্টদের মতো আরএসএস-বিজেপিও অস্থি-মজ্জায় নারীবিদ্বেষী। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বেঁধে দেওয়া নৈতিকতা ও ‘ভারতীয় নারী’সুলভ আচরণবিধির গণ্ডি পেরিয়ে গিয়ে যাঁরা স্বাধীনভাবে চলেন (দীপিকার “মাই চয়েস” ভিডিও-টির কথা এখানে মনে পড়বে) এবং যাঁরা সোচ্চার হন পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে (মনে পড়বে রিয়া চক্রবর্তীর কথা, যিনি এনসিবি’র দপ্তরে হাজির হয়েছিলেন পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে শ্লোগান লেখা শার্ট পরে) বিশেষত তাঁদের শায়েস্তা করার কোনো সুযোগ ছাড়তে রাজি নয় মোদী সরকার।

এছাড়াও, পুরো ঘটনাক্রমের পিছনে আছে তাদের এক গুচ্ছ রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা। বিহার নির্বাচনের আগে বিহারের ছেলে সুশান্তের নামে আবেগ উস্কে দিতে চাইছে, বিরোধী জোটের শাসনাধীন মহারাষ্ট্র সরকারকে সুশান্ত-তদন্তে অবহেলার জন্য দায়ী করে ভোট কুড়োতে চাইছে বিজেপি ও তার জোট সঙ্গী জেডি(ইউ)। তিন তিনটি কেন্দ্রীয় সংস্থাকে (সিবিআই, ইডি, এনসিবি) এই তদন্তে নামিয়ে দিয়ে বিহারবাসীদের বিজেপি বলতে চাইছে, দেখ আমরা সুশান্তের ব্যাপারে কত আন্তরিক। একই সঙ্গে চাইছে আকাশচুম্বী করোনাগ্রাফ আর পাতালমুখী জিডিপিগ্রাফ রুখতে কেন্দ্রীয় সরকারের চরম ব্যর্থতা থেকে মানুষের দৃষ্টি অন্য দিকে ঘুরিয়ে দিতে। তারা চায় না, সংসদে যে রকম হিটলারি কায়দায় কৃষি বিলগুলো জবরদস্তি পাশ করানো হল তা নিয়ে সংবাদমাধ্যমে বিস্তারিত চর্চা হোক বা কৃষকদের ও অন্যদের প্রতিবাদী কর্মসূচী টিভি’র পর্দায় ঝলসে উঠুক। পাকিস্তান-চীন নিয়ে হল্লা পুরনো হয়ে এসেছে, তাদের এখন প্রয়োজন একটু অন্য স্বাদের মশলা। তাই শাসকের ইঙ্গিতে জো-হুজুর মিডিয়া এক অশ্লীল কুনাট্য রঙ্গে মানুষকে মশগুল করে রাখতে চাইছে।

আর এই শোরগোলে হারিয়ে যাচ্ছেন আসল সুশান্ত। টিভি’র পর্দায় আমরা তাঁর পেশীবহুল শরীরটাকে কসরত করতে দেখছি, জানছি না আসল মানুষটিকে। যিনি ২০১৮ সালে পরপর দুবার কেরালা ও নাগাল্যান্ডে বন্যা ত্রাণে এক কোটি ও সোয়া কোটি টাকা দান করেছিলেন। যিনি ‘পদ্মাবত’ সিনেমাটি নিয়ে করণি সেনার (যারা নিজেদের রাজপুত জাতির চ্যাম্পিয়ন বলে দাবি করে) তাণ্ডবের  প্রতিবাদে নিজের টুইটার হ্যান্ডেল থেকে রাজপুত শব্দটি ছেঁটে দিয়েছিলেন। এজন্য তাঁকে ট্রোলড হতে হয়েছিল। তিনি ট্যুইট করেছিলেন, মানবতার চাইতে বড় আর কোনো ধর্ম বা জাত নেই। ভালোবাসা আর সমবেদনাই আমাদের প্রকৃত মানুষ করে তোলে, বাকি সব ভেদাভেদ করা হয় কেবল সংকীর্ণ স্বার্থের খাতিরে।

এমন একজন মানুষের  মর্মান্তিক বিদায়কে যারা সংকীর্ণ রাজনীতির স্বার্থে এবং মনোরঞ্জন ব্যবসার স্বার্থে কাজে লাগায়, তাদের বিরুদ্ধে আমরা অবশ্যই প্রতিবাদে সোচ্চার হব। কিন্তু সেই সঙ্গে লড়তে হবে আমাদেরই অবচেতনে লুকিয়ে থাকা শতাব্দী-প্রাচীন পশ্চাদমুখী ধ্যানধারণাগুলোর বিরুদ্ধেও, যার মধ্যে একটি হল নারীবিদ্বেষী পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা। এদিকে ইঙ্গিত করে সমাজ সচেতন অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু টুইট করেছিলেন, “সতীদাহ ঘিরে উল্লাসের যে বর্ণনা পড়েছি, রিয়া চক্রবর্তীর গায়ে গণহারে অপরাধী তকমা দেগে দেওয়া দেখে তার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে।” তাঁকে সমর্থন জানিয়ে সমাজতত্ববিদ অভিজিৎ মিত্র নিজের টুইটে লেখেন, “নারী নরকের দ্বার-মার্কা মান্ধাতার আমলের ধ্যানধারণা এখনও রয়েছে। আজকের মেয়েরা নানা দিকে এগিয়ে গেলেও সুযোগ পেয়ে তাঁদের ধস্ত করার মনটা বিলক্ষণ রয়েছে।” কথাটা অনস্বীকার্য। তাই গণচেতনার পরিসরে এবং রাষ্ট্র ও পথভ্রষ্ট মিডিয়ার বিরুদ্ধে – দুটি ক্ষেত্রে দু’ধরণের সংগ্রামই আমাদের একসঙ্গে চালিয়ে যেতে হবে।

- চৈতালি সেন   

খণ্ড-27
সংখ্যা-35