লাভ জিহাদ কী জিনিস? এটি মূলত একটি ইসলামোফোবিক চক্রান্তকে শানিত করে এমন একটি থিওরি, যেখানে প্রচার করা হয় হিন্দু মেয়েদের ধর্মান্তরিত করতে মুসলমান যুবকরা প্রেমের ফাঁদ পাতে। আসলে প্রেম ভালোবাসা নয় ইসলামের সম্প্রসারণই হলো তাদের আসল উদ্দেশ্য। ২০০২-এর পরবর্তীতে একটু একটু শোনা গেলেও লাভ জিহাদ কথাটি ব্যাপকভাবে জনমানসে আসে ২০০৯ সালে কর্ণাটকের হিন্দুত্ববাদীদের দ্বারা সংগঠিত কিছু নির্দিষ্ট হিংসাশ্রয়ী ঘটনার পর। অতএব বোঝাই যাচ্চে লাভ জিহাদ কোনও একদিনের হুজুগ নয়। এই ঘৃণার, এই ভয়ের ধারণা আমাদের চেতনায়, মননে, বাচনভঙ্গি ও জীবনশৈলীতে – আমাদের অস্তিত্বের পাকে পাকে ক্রমশ জড়িয়ে যেতে থাকে। প্রত্যেক মুহূর্তে সমাজ এগুলোই আমাদের শেখায়। আমরাও সমাজের শৃঙ্খলাবদ্ধ সৈনিকের মতো আমাদের সামাজিক জীবনে সেই তথাকথিত শিক্ষাকে সংপৃক্ত করে ফেলি। মেয়েদের ক্ষেত্রে এই ‘শেখা’র শেকলগুলো আরেকটু শক্ত, আরেকটু কঠিন। কারণ “নিজের শরীর বা মনের প্রতি যে আমার নিজের অধিকার আছে”, এই বোধটাকেই বিসর্জন দিতে শেখানো হয় তাদের ছোট থেকেই। জন্মের পর বাবা, বিয়ের পর ‘স্বামী’ আর বৃদ্ধ বয়সে সন্তান, বলা ভালো ‘ছেলে’। এই অধীনে থাকার ট্রায়াঙ্গেল সমাজ ‘ভালো মেয়ে’ হওয়ার একটা সংজ্ঞা, একটা স্ট্রাকচার। যে সংজ্ঞা বা ধাঁচের বাইরে গেলে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে পুরুষের যে একচেটিয়া রাজ, নিয়ন্ত্রণ এবং পায়ের তলায় রাখার একচেটিয়া যে পরম্পরা তাতে আঘাত করে। আমার মেয়ে সে আমার মতেই চলবে, নিজের ইচ্ছায় বিয়ে করবে, অধিকার ফলাবে তাহলে পরিবারকে নিয়ন্ত্রণ করার সেই সামাজিক পুরুষত্ব নিয়ে লোকে ইপ্রশ্ন তুলবে না? কি বলবে লোকে! আলমারীতে সাজিয়ে রাখা বস্তু থেকে মানুষ হলে সে অধিকার নিয়ে সোচ্চার হবে, তার মন, মনন, শরীর, জীবিকা, স্বাধীনতা ও বাঁচার অধিকার নিয়ে। যা হিন্দুত্ববাদী ও মনুবাদী ভাবধারার পক্ষে আতঙ্কের।
ভাবছেন আমাদের ভূমিকা কোথায় এখানে? আসলে কি বলুন তো ওই যে ছোট্ট থেকে আমরা শেখাই “মেটিয়াবুরুজ যাচ্ছিস? জায়গাটা খুব আনসেফ রে!” আমরা কামদুনি বা পার্ক স্ট্রীট-এর ক্ষেত্রে হাজারটা ঘটনা ঘটলেও বলব না কিন্তু। তারপর ধরুন “যত্ত চোর, জঙ্গি দেখ ভাই সব হচ্ছে ওই একটা জাতের” বা “ইস কালো পরেছিস কেন সব! পুরো মোল্লা লাগছে তো” বা “এতগুলো বাচ্চা, তার মানে নিশ্চয়ই ওই জাতের, এই স্কুলে ওর টিফিন খাবি না!”। নিজের শরীর, মনের প্রতি অধিকার বোধের কথা বাদ দিন এই যে ফোবিয়া আমরা দিনের পর দিন তৈরি করি সেখান থেকেই চিন্তাধারায় ভালোবাসায় দেওয়াল তুলতে শুরু করি আমরা। এই ধরনের আগ্রাসন আসলে মানুষের স্বাভাবিক চাওয়া পাওয়াগুলোকে বন্ধ করতে চায়। পারিবারিক ও ব্যক্তিগত পরিসরে বিভেদের বিষ ঢুকিয়ে যে কোনও রকম সুস্থ চিন্তাকে ব্যাহত করে, আরও শক্ত হয় শিকল।
দুটো মানুষ একসঙ্গে থাকবেন, ভালোবাসবেন তাতে জাত ধর্ম কোথা থেকে আসছে বলতে পারেন? হিন্দুকে ভালোবাসলে একটু বেশি প্রেম, আর অন্য ধর্মের কাউকে ভালোবাসলে কম প্রেম এটা কোন ধরনের যুক্তি? ভালোবাসতে মানুষ লাগে। ধর্ম সেখানে কোথাকার কে? যদি বলেন ‘মানিয়ে নেওয়া’, সেটা তো বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠান যেটাকে এই সমাজে দাঁড়িয়ে এখনও অস্বীকার করতে পারি না আমরা তার প্রতিটা পদক্ষেপে আছে। একটি মেয়েকে অন্য পরিবারে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে যে রক্ত ঝরাতে হয়, যে সংগ্রাম করতে হয় সেই সমস্যাগুলো আছে। কিন্তু তার সঙ্গে ধর্মের যোগ কোথায়?
প্রেম মানে আত্মার একাত্মকরণ, আত্মীয়তা। সেখানে ধর্ম, বর্ণ, ভেদাভেদ কোথা থেকে আসে? প্রশ্নটা আপনার কাছে রইল।
- সৌমি জানা