রাস্তায় গণতন্ত্রের আত্মপ্রতিষ্ঠা করুন! দানবীয়, জনবিরোধী আইনগুলোর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হোন!
rase

মোদী সরকার সংসদীয় গণতন্ত্রকে যে ধরনের প্রহসনে পরিণত করেছে, সদ্য সমাপ্ত সংসদের বাদল অধিবেশন তারই এক দর্পণ হয়ে উঠল। প্রশ্ন তোলার সময়কে খেয়ালখুশি মাফিক বাতিল করা হল এবং এর মধ্যে দিয়ে প্রথাসিদ্ধ এই ধারণারই অবসান ঘটানো হল যে, সরকার এবং প্রশাসনিক বিভাগ আইনসভা, সংসদ এবং ফলত জনগণের কাছেও জবাবদিহি করতে দায়বদ্ধ।

সরকার ঘোষণা করল যে লকডাউনের কারণে যে সমস্ত পরিযায়ী শ্রমিকের প্রাণ গেছে তাদের সংখ্যা সম্পর্কে কোনো তথ্য তাদের কাছে নেই। লকডাউন নামানোর ফলে কতজন কাজ হারিয়েছেন সে সম্পর্কেও কোনো তথ্য সরকার জানালো না। কতজন ডাক্তার এবং কোভিড১৯ যোদ্ধা (স্বাস্থ্য এবং সাফাই কর্মী সহ) এই মারণ ভাইরাসের মুখোমুখি হয়, পিপিই সরঞ্জামের অভাব এবং যথা সময়ে চিকিৎসা না পাওয়ায় প্রাণ হারিয়েছেন, সে সম্পর্কে কোনো তথ্যও সরকার জানায়নি। যে সরকার দিল্লীতে নাগরিকত্বের সমভিত্তির জন্য আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে চার্জশিটে ১১ লক্ষ পাতার তথ্যপ্রমাণ সংকলিত করতে পারে তারা তাদের গৃহীত বিপর্যয়কর কর্মনীতির – দায়সারাভাবে ও অবজ্ঞাভরে রূপায়ণ যাকে আরও সর্বনাশা করে তোলে – বলি হওয়া মানুষজন সম্পর্কে তথ্য রাখার ব্যাপারে কোনো গুরুত্বই দেয়নি। গণতান্ত্রিক রীতিনীতি এবং প্রথার প্রতি নির্লজ্জ অবজ্ঞা দেখিয়ে (আরও স্বতন্ত্র গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের কথা না হয় বাদ দেওয়াই গেল) দেশের কৃষকদের তীব্র বিরোধিতার মুখে পড়া কৃষি বিলগুলোকে ভোটে না ফেলে রাজ্যসভায় “পাশ হয়েছে” বলে ঘোষণা করা হল। সরকারের পক্ষে দাবি করা হয়েছে যে, বিরোধী সাংসদরা হট্টগোল করায় কক্ষে এমন শৃঙ্খলা ছিলনা যাতে ভোটাভুটি চালানো যায়। সেক্ষেত্রে এই প্রশ্নটা ওঠে যে – মাথাগুণে ভোট করার মতো অবস্থা যদি না থেকে থাকে তাহলে ধ্বনি ভোট চালানোর মতো শৃঙ্খলা এল কোথা থেকে? রাজ্যসভার কার্যক্রমের টিভি সম্প্রচারকে সে সময় স্তব্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। কাজেই, সংসদের ভিতরের কন্ঠগুলোকে শব্দহীন করে রাখাটা এটাই প্রমাণ করেছিল যে, ধ্বনি ভোটটাও ছিল মেকি। পরে বিরোধী সাংসদরা সংসদীয় কার্যক্রম বয়কট করেন এবং শাসক পক্ষ কক্ষে বিরোধীপক্ষের সাংসদদের উপস্থিতিহীন অবস্থায় চারটে শ্রমবিধি বিল পাশ হয়েছে বলে ঘোষণা করে। প্রাণোচ্ছল, সোচ্চার, শক্তিশালী, দৃশ্যমান বিরোধীপক্ষই বলিষ্ঠ গণতন্ত্রের পরিচায়ক। বিরোধীহীন সংসদ মুমূর্ষু গণতন্ত্রকেই দেখিয়ে দেয়। আর মুমূর্ষু গণতন্ত্রে দেশের শ্রমিক ও কৃষকরাই সরকারের আক্রমণের অঘোষিত নিশানায় পরিণত হয়, আর তাদের সাথেই শাসকদের আক্রমণের ঘোষিত নিশানা হয়ে ওঠে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা।

তিনটে কৃষি আইন ভারতের কৃষকদের এবং দেশের প্রধানত কৃষি অর্থনীতির মৃত্যুঘন্টা বাজিয়ে দিয়েছে। চারটে শ্রম বিধি বিল ভারতের অধিকাংশ শ্রমিকদের শ্রম আইনের নামমাত্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা থেকেও বঞ্চিত করে তাদের ইচ্ছেমতো নিয়োগ ও ছাঁটাই করার পথকে প্রশস্ত করবে। শ্রম বিধিগুলোতে নারী শ্রমিকদের অধিকারের সুরক্ষা এবং সবচেয় নিরাপত্তাহীন শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি রয়েছে। কিন্তু বিধিগুলো ইউনিয়ন কার্যকলাপ চালানোকে একরকম অসম্ভবপর করে তুলেছে। আর শ্রমিকরাও জানে যে, কাগজে-কলমে আইন ও সুরক্ষা ব্যবস্থা থাকলেও বাস্তবে সেগুলোর প্রয়োগকে সম্ভব করে তুলতে লড়াই করার জন্য ইউনিয়ন না থাকলে সেগুলো তামাশা হয়েই দেখা দেয়।

mld

 

সংসদের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র যদি বিলীয়মান হয়ে দেখা দেয় তবে রাস্তার প্রতিবাদ-প্রতিরোধগুলো ভারতীয় গণতন্ত্রের স্পর্ধিত প্রাণস্পন্দনের অব্যাহত ধারা হয়ে দেখা দিচ্ছে। গত ২৫ সেপ্টেম্বর সারা ভারতেই কৃষকরা এক বিশাল ভারত বনধকে সফল করে তুলতে রাস্তা ও রেল অবরোধ সংগঠিত করেন যা ভারতকে স্তব্ধ করে দেয়। সমস্ত স্থানেই শ্রমিক ও যুবকরা কৃষকদের সমর্থন জানান। পাঞ্জাবে কৃষকদের রোষ এমনই ছিল যে বিজেপির দীর্ঘ দিনের মিত্র আকালি দল তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে এনডিএ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়।

দানবীয় ও জনবিরোধী কৃষি আইনগুলোর বিরুদ্ধে কৃষকদের চাক্কা জ্যাম (রাস্তা অবরোধ) দানবীয় ও জনবিরোধী সিএএ-র বিরুদ্ধে জনগণের সুবিশাল আন্দোলনের কথা মনে পড়িয়ে দিচ্ছে। ওই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের আজ সহিংস “দাঙ্গাকারী” রূপে মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসানো হচ্ছে, কেননা, ওই আন্দোলনের মহিলা প্রতিবাদকারীদের একটা অংশ দিল্লীতে রাস্তা অবরোধ করেন। ওই প্রতিবাদীদের দানবীয় ইউএপিএ আইনে জেলে ভরা হচ্ছে – ইউএপিএ এমনই একটা আইন যাতে সরকারের সমালোচকদের একেবারে ভিত্তিহীন অভিযোগেও জেলে পুরে জামিন না দিয়ে বা বিচার না করে বছরের পর বছর আটক রাখা যায়।

২০১৮-য় তোলা একটা ছবিতে দেখা যাচ্ছে ইউএপিএ-তে অভিযুক্ত সিএএ-বিরোধী আন্দোলনের তিন সক্রিয় কর্মী মীরন হায়দার, আসিফ তানহা এবং খলিদ সইফি ভিন রাজ্য থেকে দিল্লীতে আসা কিষান যাত্রায় অংশগ্ৰহণকারী কৃষকদের জন্য সংগঠিত গণরসুইয়ে রান্না করছেন। এঁদের মতো ছাত্র ও যুবকরাই ছিলেন কৃষক আন্দোলন এবং সিএএ-বিরোধী আন্দোলনের পদাতিক বাহিনী। সিএএ-বিরোধী শাহিনবাগগুলোতে গণরসুই সংগঠিত করাটাকে দিল্লী পুলিশ দণ্ডনীয় অপরাধ বলে সাব্যস্ত করেছে। পাঞ্জাবের যে কৃষকরা শাহিনবাগে এই ধরনের গণরসুইগুলো সংগঠিত করেছিলেন, আগামী দিনে তাঁরা ইউএপিএ-তে অভিযুক্ত হতেই পারেন! কৃষি আইন, শ্রম বিধি আইন, সিএএ এবং ইউএপিএ-র মতো দানবীয় আইনগুলোর বিরুদ্ধে এবং যে স্বৈরাচারী সরকার এই সর্বনাশা আইনগুলো জনগণের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সময় ভরতের কৃষক, শ্রমিক, সাধারণ জনগণের কাছে সমুপস্থিত।

(এম এল আপডেট সম্পাদকীয়, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২০)  

খণ্ড-27
সংখ্যা-36