বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জে পি নাড্ডা এসেছিলেন বঙ্গ সফরে। দলের উত্তরবঙ্গের কর্মকর্তাদের বৈঠক উপলক্ষে এসে শোনালেন কিছু টোটকা প্রচারের কথা। তাতে রয়েছে একদিকে রাজ্য রাজনীতির সমস্ত মনযোগকে টিএমসি সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র করে তোলার চেষ্টা, যার বাস্তব ভিত্তি আছে অবশ্যই। অন্যদিকে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন মোদী সরকার যা করছে তার সাফাই গাওয়া, আর এরাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায় এলে কী করবে তার রঙীন কিছু প্রতিশ্রুতি; যেগুলোর আদৌ কোনো ভিত্তি বাস্তবিকই নেই।
বিজেপি জানে তাকে সবচেয়ে বেশি সম্মুখীন হতে হচ্ছে “বিদ্বেষ-বিভাজনের রাজনীতি”র কারবারী হিসেবে, তার সাম্প্রদায়িক-জাতিবাদী-বর্ণবাদী-পিতৃতান্ত্রিক চিহ্নিত সত্তার কারণে। তাই নাড্ডাজী এবার সেইসব কলঙ্ক খন্ডাতে মরীয়া হয়ে উল্টে ‘বিভেদের রাজনীতি’র দায় চাপাতে চাইলেন যাবতীয় বিরোধী শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে। তার জন্য মানুষের ক্ষোভের কারণ হয়ে থাকা আপাত একটা সুবিধাজনক 'অপর' দল খাড়া করা দরকার, সেই উদ্দেশ্যে তার আশু টার্গেটে রাজ্যের শাসক তৃণমূল। নাড্ডার অভিযোগের উপাদানও বড় বিচিত্র! কেন্দ্রের ‘আয়ুস্মান ভারত’ প্রকল্প আর ‘কৃষক সম্মাননা নিধি’ কার্যকরী না করে রাজ্য সরকার নাকি ‘বিভেদ ও বঞ্চনা’র এবং ‘ভাগ কর শাসন কর’ পলিসি নিয়ে চলছে! পক্ষান্তরে রাজ্য সরকার চায় না কেন্দ্রের ‘আয়ুস্মান’ প্রকল্পে জুড়তে। রাজ্যকে আর্থিক দায়ভাগ বহন করতে হবে শতকরা আশি ভাগ, অথচ প্রকল্পের নামকরণে তার স্বীকৃতি নেই, কেবল নাম কিনতে চায় কেন্দ্র, এই ধূূূয়ো তুলেছে রাজ্য। ‘কৃষক সম্মাননা নিধি’ প্রকল্প নিয়েও থাকছে জটরহস্য। এসবের উৎসে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রীয়তাকে কেন্দ্র করে কেন্দ্র-রাজ্যের সংঘাত। মোদী সরকার যুক্তরাষ্ট্রীয়তার সাংবিধানিক ক্ষমতাকে, বিশেষ করে বিরোধীদল ক্ষমতায় থাকা রাজ্যগুলোতে ছলে-বলে-কৌশলে নস্যাৎ করে দিতে সক্রিয়। তবু তোতার মতোই নাড্ডা কার্যত কেবলই যাতনাময় মোদীর ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’-এর ধ্বনি তুললেন। আসলে এই আওয়াজ বিজেপি জমানার সর্বনাশা বিভাজনের রাজনীতিকে আবরণ দেওয়ার প্রয়োজনে কৌশলগত হাতিয়ার। তা প্রতিনিয়ত উন্মোচিতও হয়ে চলেছে। ভারতে ‘ভাগ কর শাসন কর’ পলিসির সূত্রপাত সুদূর অতীতে, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের আমলে, ব্রিটিশ শাসকরা চলে গেলেও ভারতের শাসকশ্রেণীগুলো সেই ব্রিটিশ পলিসি উত্তরাধিকারীর মতো ধারণ ও প্রয়োগ করতে দ্বিধা করেনি। শাসনের সংকট থেকে পরিত্রাণ খুঁজতে দমনের বিভিন্ন কঠোর আইন কানুন ব্যবহারের সাথে সাথে কেন্দ্রে এবং রাজ্যে রাজ্যে শাসকরা নানা রূপে ঐ “ভাগ করে মোকাবিলা”র পলিসি চালিয়ে এসেছে। কোনও রঙের সরকার এই অপরাধমুক্ত নয়, মমতা সরকারও নয়। তবে এহেন ঔপনিবেশিক শাসক আচরণের সবচেয়ে নৃশংস পুনরাবৃত্তি করে চলার দায়ে অভিযুক্ত ও অপরাধী প্রমাণ হচ্ছে কেন্দ্র-রাজ্যের বিজেপি সরকারগুলো। সংসদে ও প্রাতিষ্ঠানিক আদালতে না হলেও জনতার বিচারে ও জনআন্দোলনেে। এর কারণ হল তাদের মূল অবস্থানটাই “বিদ্বেষ-বিভাজনের মতাদর্শ ও রাজনীতি”র ভিত্তির ওপর। নাড্ডা বিজেপির পরিচালনার মাহাত্ম প্রচার করতে বিপরীতে কোনও শাসকদলে ‘মা ও ছেলে’র বা কোথাও বা ‘পিসি-ভাইপো’র পরিবারতন্ত্র চলছে বলে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। জানা কথা। কিন্তু তা নিয়ে কথা বলার মতাদর্শগত, রাজনৈতিক, নৈতিক — কোনও ‘শ্রেষ্ঠত্ব’ দাবি করা বিজেপির সাজে না, বরং এই প্রশ্নে খোদ বিজেপি সবচেয়ে কলঙ্কিত, বিজেপির তুলনা কেবলমাত্র বিজেপি। গৈরিক এই দলটি পরিচালিত হয় সবচেয়ে পরিবারতন্ত্রের স্বার্থে, পরিবারতন্ত্রের জন্য, পরিবারতন্ত্রের দ্বারা। বিজেপির মাথার ওপর রয়েছে আরএসএস-সংঘ পরিবার।
নাড্ডা এই হুমকি আরও একবার দিয়ে রাখলেন, সিএএ হবেই। অতিমারী পরিস্থিতি দেখা দেওয়ার কারণে সাময়িক স্থগিত রয়েছে, অবস্থা স্বাভাবিক হলেই আবার তা শুরু হবে। কঠোর বাস্তবতা হল, এই ঘোরতর বিপদটি রয়েই গেছে। একটু মওকা পেলেই বিজেপি এটা অভিযান আকারে চালাতে চাগিয়ে তুলবে। বিপরীতে, এই অভিসন্ধির মোকাবিলা করতে, এই অ্যাজেন্ডা প্রত্যাহারের দাবিতে তাই প্রতিরোধ আন্দোলনের ধারাটিকেও পুনরুজ্জীবিত করে তোলার চ্যালেঞ্জ রাখতে হবে।
নাড্ডা তৃতীয় যে বিষয়টির উল্লেখ করেছেন তা হল বিজেপি এরাজ্যে ক্ষমতায় এলে চাষিদের সব অভাব-অভিযোগ দূর করবেন। আর আজকের প্রকৃত নিষ্ঠুর প্রহসনের বিষয়টি কী! মোদী সরকার সম্প্রতি প্রচণ্ড ক্ষতিকারক একগুচ্ছ আইন তৈরি করেছে, যার ফলে কৃষকের জীবন-জীবিকায়, চাষবাস, ফসলের মূল্য, বেচাকেনা, ঋণ পরিশোধ, বিনিয়োগ, কৃষি জমিরক্ষা, খাদ্যশস্যের সরকারী সংগ্রহ ও মজুতের ভিত্তিতে খাদ্য সরবরাহের নিরাপত্তার চরম বিপর্যয় ঘনিয়ে আসার বিপজ্জনক সম্ভাবনা রয়েছে বিস্তর। তারপরও নাড্ডাদের আব্দার চাষিদের ভালোর জন্য নাকি বিজেপি আছে!
বিজেপির বাংলায় জমি তৈরির স্বার্থবাদী নষ্টামীর নির্দিষ্ট প্রকাশগুলো সম্পর্কে সজাগ-সচেতন হোন, সেগুলোকে চিহ্নিত করুন, সেইমতো মোকাবিলায় এগিয়ে আসুন, এক হোন; এই সংকল্পে সংগ্রাম-সম্প্রীতি-ঐক্য-ব্যাপকতর সংগ্রামী ঐক্য গড়ে এগিয়ে চলাই আজ সবচেয়ে বড় দাবি।