মাননীয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
মুখ্যমন্ত্রী, পশ্চিমবঙ্গ সরকার
নবান্ন, হাওড়া।
মাননীয়া,
এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতিতে এই জরুরি বার্তা ও আবেদন আপনার কাছে পৌঁছে দিতে চাই। গত ৮-৯ মাসেরও বেশি সময় ধরে গোটা বিশ্ব এবং আমাদের দেশের জনগণ কোভিড১৯ অতিমারীর বিরুদ্ধে মরণপণ লড়াই চালাচ্ছেন। আমাদের দেশের কেন্দ্রীয় সরকার ও বিভিন্ন রাজ্যের সরকারগুলির দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ এবং দেশজুড়ে স্বাস্থ্যব্যবস্থার কঙ্কালসার অবস্থার ফলে দেশবাসী হারাচ্ছেন তাঁদের প্রিয়জনকে, পরিচিতজন ও প্রতিবেশিকে। কেন্দ্রের সরকার (এবং রাজ্যগুলিরও) শুরু থেকেই তাদের অজ্ঞতা ও আহাম্মকি ঢাকতে ১৮ দিনেই করোনা অতিমারী জয় করে ফেলার ঘোষণা করে দিয়েছিল। স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি, জরুরি ভিত্তিতে আরও আরও চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ, রোগ নিয়ে গভীর গবেষণার ব্যবস্থা করা, সর্বোপরি আরও আরও হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ব্যবস্থা করা, সমগ্র স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে সরকারী নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার (বিশেষত চরম মুনাফালোভী বেসরকারী স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা) বিন্দুমাত্র চেষ্টা না করে সর্বরোগহর দাওয়াই হিসাবে অপরিকল্পিত ও জবরদস্তি মূলক লকডাউন চাপিয়ে দিয়েছে। তার ফলাফল কি হয়েছে তা খোলা চোখে আন্দাজ করা যায় পরিযায়ী শ্রমিক ও কাজহারা মানুষ ও তাদের পরিবারবর্গের দিকে তাকালে। সরকারের (রাজ্য ও কেন্দ্রের) দায়িত্বজ্ঞানহীনতা ও উদাসীনতা থেকে মানুষ তো সেই শিক্ষাই পেয়েছে যে অতিমারী নিয়ে ছেলেখেলা করা যায়, উদাসীন থাকা যায়, দায়িত্বজ্ঞানহীন থাকা যায়। পুলিশের লাঠি, কাঁদানে গ্যাস আর প্যান্ডেমিক আইনের অগণতান্ত্রিক ধারাগুলির প্রয়োগ করে বা ভয় দেখিয়ে সমাজকে দায়িত্বশীল ও সচেতন করা যায় না। একটি শিশুও তা বোঝে। শুধু সরকার বোঝে না। আর এই দায়হীনতা ও কতিপয় বিশেষজ্ঞ নির্ভর সরকারী উদ্যোগ ও তৎপরতা সমাজকে শুধু নিষ্ক্রিয় করে দিয়েছে তাই নয়, যত রকমের অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার সমাজে শাখা প্রশাখা বিস্তার করতে সুযোগ করে দিয়েছে। আর সরকারগুলি আড়চোখে তা দেখে গেছে, কোনো পদক্ষেপ করেনি।
উৎসব মানুষের জীবনের অঙ্গ। বছরভর দুঃখ কষ্ট মানুষ ভুলতে চায়। বস্তুত যে কোনো উৎসব আসলে মানুষে মানুষে মিলনোৎসব। কিন্তু উৎসব অনুষ্ঠানের নামে উন্মাদনা, জলের মতো অর্থব্যয়, সমাজে নতুন করে আরও বিভাজন তৈরি করা ও তাকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করার নির্লজ্জ প্রতিযোগিতা আমাদের খাদের দিকে নিয়ে যায় ও যাচ্ছে। তা শুধু এই অতিমারীর দিনেই নয়, বলতে গেলে “সাধারণ সময়েও”। মূল্যবোধগুলি চুরমার হতে থাকে। একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশে (সংবিধানে এখনও আছে) শাসক রাজনৈতিক দল ঘোষণা করে পূজা করে, (রাষ্ট্রের নিরাপত্তা রক্ষীদের ঘেরাটোপে রাষ্ট্রপতি একটি বিশেষ ধর্মের দেব-দেবী বন্দনা ও মন্ত্রোচ্চারণ করেন), রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সরকারের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক ভবন থেকে অনলাইন ৬৯টি পূজা উদঘাটন করেন। আমরা আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, রাজ্যের মুখ্যসচিব তার পরিচালনা ও ঘোষকের কাজ করেন। স্বরাষ্ট্র সচিব থেকে গোটা আমলাকুল প্রশাসনিক ভবনে দুর্গা মন্ডপে পরিণত করার কাজে তৎপর হয়ে পড়েন। অতিমারী কি আমাদের সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতাকে ও আক্রান্ত এবং রোগগ্রস্ত করে ফেললো? জবাব দেবার জন্য কেউ দায়বদ্ধ নেই।
জনগণই শেষ ভরসা। নিজেকে, নিজের পরিবার পরিজনকে, সর্বোপরি সমাজকে রক্ষার দায় সাধারণ মানুষকেই নিতে হবে। স্বেচ্ছা আরোপিত শৃঙ্খলা ও দায়িত্ববোধ থেকেই মানুষকে উদ্যোগী হতে হবে।
চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞ বন্ধুরা জানাচ্ছেন, কোভিড সংক্রমণ-২ এবং পুনর্সংক্রমণের সম্ভাবনা ভীষণভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। শুধু নতুন সংক্রমণ হু হু করে বাড়বে তাই নয়, করোনা সংক্রমণের পর সুস্থ হয়ে যারা বাড়ি ফিরেছেন, তাঁদেরও আক্রান্ত হওয়ার সংবাদ আসছে। হংকং থেকে এই পুনর্সংক্রমণের সংবাদের পাশাপাশি নেদারল্যান্ডস থেকে পুনরায় সংক্রমণে মৃত্যু সংবাদও আসছে। খোদ আমেরিকা থেকেও পুনর্সংক্রমণের তথ্য আসছে। আক্রান্ত মানুষের শরীরে যে এন্টিবডি তৈরি হয়, তা ১০০ দিনের বেশি স্থায়ীত্ব পাচ্ছে না।
এমনই এক পরিস্থিতিতে মূলত এরাজ্যে শারদ উৎসবের সূচনা হতে যাচ্ছে, এবং মাসখানেক ধরে তা চলবে। এই প্রেক্ষাপটে আপনার কাছে এবং রাজ্যের মন্ত্রীপরিষদের কাছে জরুরি ভিত্তিতে কোভিড সংক্রমণ-২ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ার আগে সমস্ত ধরনের কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করার আবেদন জানাচ্ছি :
১) সরকার ও মন্ত্রীপরিষদের সদস্যদের পৃষ্ঠপোষকতায় পূজা উদঘাটন ও উৎসব পালন বন্ধ করুন।
২) পূজা প্রাঙ্গণে কঠোর ভাবে দর্শনার্থী নিয়ন্ত্রণ করা হোক। মুখে মাস্ক, হাত ধোয়ার সাবান, হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা পূজা কমিটিকে করতে হবে।
৩) সার্বজনীন উৎসবের পরিবর্তে পারিবারিক উৎসব অনুষ্ঠানে জোর দেওয়া হোক।
৪) যে পাড়ার উৎসব সে পাড়ার জনগণের জন্য নিয়ন্ত্রিত হোক।
৫) উৎসব প্রাঙ্গণে প্রবেশের আগে প্রাথমিক পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হোক।
৬) প্রত্যেকটি সার্বজনীন পূজা কমিটিকে অন্তত ১০-১৫ জন কোভিড রোগীর চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করতে হবে।
৭) সর্বোপরি রাজ্য সরকারকে জরুরি ভিত্তিতে কোভিড চিকিৎসার জন্য চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী নতুন করে নিয়োগ করতে হবে। বহু প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বহুদিন ধরে কোন চিকিৎসক নেই। চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীরাই চিকিৎসা পরিষেবা চালাচ্ছেন।
৮) চিকিৎসকদের কাছে বার্তা দিতে হবে বিনা কারণে প্রাইভেট চেম্বার বন্ধ রাখা যাবে না।
৯) কোনো বেসরকারী হাসপাতাল অন্যায়ভাবে রোগী ফেরালে এবং লাগামহীন অর্থ নিলে লাইসেন্স বাতিল করতে হবে।
১০) উৎসবের দিনগুলিতে স্কেলিটন স্টাফ দিয়ে হাসপাতাল চালানো বন্ধ করতে হবে।
১১) পূজা কমিটিকে উৎসাহ ভাতা দেয়ার পরিবর্তে ফ্রন্ট লাইন স্বাস্থ্যকর্মীদের উৎসাহ ভাতা দেয়া হোক।
আশা করি অতিরিক্ত ব্যস্ততার মাঝেও আমাদের আবেদন আপনি ভেবে দেখার সময় পাবেন।
ধন্যবাদান্তে
সিপিআইএমএল (লিবারেশন)
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির পক্ষে
পার্থ ঘোষ রাজ্য সম্পাদক,
১৫/১০/২০২০