সঙ্গীতহীন শরীরটার এখানেই ইতি টানলেন প্রবীর বল। আমাদের প্রিয় মনাদা। ২ অক্টোবর পার্কসাকাসের ফ্লেমিং হাসপাতাল থেকে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ ক্রিক রো-র পার্টি অফিসে তাঁর দেহ পৌছালে সেখানে তাঁর অনুরাগীরা তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানান। পার্টির পলিটব্যুরো মেম্বার কার্তিক পাল রাজ্য কমিটির সদস্য সলিল দত্ত, জয়তু দেশমুখ, বাসুদেব বসু কল্যাণ গোস্বামী, অতনু চক্রবর্তী, ধীরেশ গোস্বামী প্রমুখ। এছাড়াও পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদের সভাপতি দেবাশিস চক্রবর্তী, মাধব মুখার্জী, অরিন্দম সেনগুপ্ত, বরুণ গাঙ্গুলী, মানস ঘোষ, নীতীশ রায় সহ অন্যান্য কর্মীরা। পরিবারের পক্ষে মাল্যদান করেন প্রবীর বলের স্ত্রী, পুত্র, বোন ও অন্যান্যরা। সেখান থেকে ক্যাওড়াতলা শ্মশানে “লালে লাল আগুনে অগ্নিস্নাত আমি ইস্পাত দৃঢ় মানুষ”-এর একটি পর্বের অন্তিম ঘোষণা হল।
প্রবীর বা আমাদের প্রিয় মনাদা এখন ইতিহাস। সঙ্গীত শিল্পী সুবোধ বলের সুযোগ্য উত্তরাধিকারী অসাধারণ কন্ঠের অধিকারী, উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের সাথে আধুনিক গানে তাঁর বিশেষ কদর ছিল। কিন্তু নকশালবাড়ির ডাকে সারা দিয়ে হয়ে উঠলেন আদ্যপান্ত গণসঙ্গীত শিল্পী। শুধু গাওয়া নয়, গীত রচনা, কবিতায় সার্থক সুর সংযোজন করে হয়ে উঠলেন প্রকৃতই জনগণের শিল্পী। মাঠে ময়দানে গণসংগ্রামের প্রতিটি পদক্ষেপে, তাঁর কথায় “মৃত্যুর মুখোমুখি মিছিলে” মনাদা ছিল আদর্শ গণশিল্পীর প্রতীকস্বরূপ। বেহালায় গড়ে তুললেন “পূবের আওয়াজ” নামে গণসংগীতের দল। সে দল সারা বাংলা জুড়ে দাপিয়ে গেয়ে বেরিয়েছে। বন্ধুদের বিপদে আপদে সবার আগে বারংবার ছুটে গেছেন। কাস্টমসের গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি করেও কিভাবে কমিউনিষ্ট পার্টির কর্মী হিসাবে পথের প্রতিবাদী মিছিলে হাঁটতে হয় তা তিনি বারবার পথে নেমেই প্রমাণ করেছেন।
১৯৮৫ সালে ‘পশ্চিমবঙ্গ গণশিল্পী পরিষদ’, ১৯৮৯-এ ‘পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদ’ সংগঠিত করার প্রশ্নে তিনি ছিলেন অগ্রণী। অনেকটা সময় তিনি সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর গান ছড়িয়ে আছে অগণিত শিল্পী ও সংগ্রামী মানুষের মধ্য। “প্রতি দিন বাঁচার লড়াইয়ে প্রতিদিন”, সুর বৈচিত্রে অনবদ্য। চা বাগনের শ্রমিকদের নিয়ে “এখানে চা বাগানে প্রতিদিন আঁধার নামে”, “প্রতিরোধের আওয়াজ ওঠাও”— আজও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জ্বলে উঠবার মতো গান। “বরফে বারুদ ঢেকো না” কিংবা অরিন্দমের কবিতা নিয়ে “হৃদয় আমার জুরাস না/ যন্ত্রণা তুই মরিস না/ স্মৃতিগুলো দোহাই তোদের/ বুকের মাঝে দাপাস না”।
শেষ জীবনটা তাঁর ভাল কাটলো না। গলায় ক্যানসার — অপারেশন, রেডিয়েশন সবই হল, কিন্তু গলায় গান আর ফিরে এলোনা। তার মাঝেই মস্তিস্কে অ্যলঝাইমার, চিনতে না পারা, ভুলে যাওয়া, সর্বশেষ সিরোসিস অফ লিভার।
তখনো কথা বলার অবস্থায় ছিল মনাদা, আমরা বাবলি সিতাংশু গৌতম অরিন্দম আলো মামু গিয়েছিলাম, চিনতে পারলো, কিন্তু নাম মনে করতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। বারবার বলছিল আমি আর গান গাইতে পারি না ...। আমারা বলছিলাম মনাদা আমরা একটা গানের অনুষ্ঠান কারবো শুধু তোমার গান নিয়ে, তুমি আমাদের সাথে গাইবে। খুব খুশি হয়েছিল। কিন্তু তার পর নেমে এলো কোভিড সঙ্কট। আমাদের আর একসাথে গাওয়া হলো না। সব আশাতো সবসময় পূরণ হয় না। এটাও হল না।
যখনই আমরা গাইতে থাকবো, তখনি আমাদের স্কোয়াড লিডার প্রবীর বল আমাদের সামনে থাকবে আমাদের কোরাস থেকে আরো নতুন নতুন শিল্পীদের গালায় ছড়িয়ে পড়বে মনাদা, প্রবীর বলের গান। শিল্পী কমরেড প্রবীরের কীর্ত্তি অবিনশ্বর হোক।
– নীতিশ রায়
বিশিষ্ট গণসংগীত শিল্পী ও আজীবন সিপিআই(এমএল) সদস্য কমরেড প্রবীর বল গত ২ অক্টোবর শেষনিঃস্বাস ত্যাগ করেন। কমরেডকে স্মরণ করে এদিন বিকালে দঃ ২৪ পরগণা জেলা অফিসে শ্রদ্ধা জানানো হয়। উপস্থিত ছিলেন জেলা সম্পাদক কিশোর সরকার, বজবজ চলার পথের পক্ষে দেবাশিস মিত্র, অঞ্জন ঘোষ সহ মহিলা ও আইসার কর্মীরা।