বিহারের আসন্ন বিধানসভা নির্বাচন কোভিড-১৯ মহামারির ছায়াতেই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে এবং নির্বাচনী প্রচার ও জনসমাবেশের ওপর থাকছে বড় ধরনের নিয়ন্ত্রণ। বিহারের ব্যাপক অঞ্চল এখনও বন্যা বিপর্যয়ের কবলে। বিহারই হবে ভারতের প্রথম রাজ্য যেখানে ব্যাপক নিয়ন্ত্রণের মধ্যে বড় ধরনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতিকে বিবেচনায় নিয়েই নির্বাচনের দিনক্ষণ নির্ধারণের অনুরোধ আমরা ভারতের নির্বাচন কমিশনের কাছে রেখেছিলাম, যাতে জনগণের অংশগ্ৰহণে কোনো ব্যাঘাত না ঘটে। নির্বাচন কমিশন কিন্তু বাঁধা নিয়মের অনুসরণেই নির্বাচনের দিন ঘোষণা করেছে। আমরা জনগণের কাছে আবেদন জানাচ্ছি, কোভিড১৯-এর পরিপ্রেক্ষিতে পালনীয় সতর্কতা ও বিধিনিয়ম মেনে উৎসাহের সঙ্গে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশ নিন।
নীতীশ কুমার সরকার উন্নয়ন ও সুশাসনকেই এখনও তাদের অভীষ্ট লক্ষ্য বলে বড় গলায় ঘোষণা করে চলেছে; কিন্তু এই লক্ষ্যকে গণতন্ত্রের বুনিয়াদি পরিপ্রেক্ষিত থেকে সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন করে তোলা হয়েছে, ফলে বহু বিজ্ঞাপিত গালভরা এই কথাগুলো মোদীর ‘অচ্ছে দিন’-এর পরিণতির ধারাতেই শূন্যগর্ভ বুলি বা নির্মম তামাশায় পরিণত হয়েছে। ২০১৫-র নির্বাচন এক অ-বিজেপি সরকারের পক্ষেই প্রবল রায় দিয়েছিল, কিন্তু ক্ষমতার ও তামাম নিয়ন্ত্রণের বিজেপির সীমাহীন লালসা এবং তার সাথে নীতীশ কুমারের নির্লজ্জ রাজনৈতিক সুবিধাবাদ যুক্ত হয়ে ওই রায়কে চূড়ান্ত প্রহসনে পরিণত করে এবং অভূতপূর্বরূপে নির্বাচকমণ্ডলীরও অবমাননা ঘটায়। ক্ষমতা কবজা করার দুরভিসন্ধি দ্বারা চালিত হয়ে বিজেপি এখন এমনকি তার নিজের জোটেই বিভাজন ঘটিয়েছে এবং এলজেপি জোট থেকে বেরিয়ে গিয়ে জেডিইউ-র মোকাবিলা করছে এবং বেশকিছু বিজেপি নেতাও এলজেপি-র পথ ধরেছেন।
নীতীশ কুমারের প্রশাসনিক মডেলে প্রথম থেকেই ছড়ি ঘুরিয়েছে আমলাতন্ত্র, এবং তাতে বিভিন্ন স্তরের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কোনো ভূমিকাই থাকেনি এবং জনগণের নানান অংশের বৈধ দাবি ও আন্দোলনগুলোর প্রতি কোনো সম্মানও দেখানো হয়নি। বছর-বছর ধরে চলা এই আমলাতন্ত্র-কেন্দ্রিক ব্যবস্থা ক্রমেই আরও বেশি স্বেচ্ছাচারী ও অনির্ভরযোগ্য হয়ে দেখা দিয়েছে, বিভিন্ন বিভাগ ও অঞ্চলে চক্রগুলোই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেছে; যে সমস্ত অফিসার নির্দেশ মতো চলেননি, প্রধান্যকারী নেতা ও স্বার্থের প্রতি অনুগত না হওয়ায় তাদের হেনস্থা ঘটানো ও শাস্তি দেওয়া হয়েছে। নীতীশ কুমারের ‘সুশাসন’-এর এই আষাঢ়ে কাহিনী এখন সৃজন-এর মতো দুর্নীতিতে কালিমা লিপ্ত, মুজাফফরপুরের নারী আবাসে ধর্ষণ ও মেয়েদের হত্যা এবং ছাপরা থেকে মাধেপুরা, ঔরগঙ্গাবাদ থেকে জাহানাবাদ পর্যন্ত বিস্তৃত ক্ষেত্রে দাঙ্গার মতো রাষ্ট্র চালিত ভয়াবহ অপরাধগুলোর কলঙ্কে কলঙ্কিত।
যে বিজেপি নীতীশ কুমারকে তাদের মুখ হিসাবে কাজে লাগিয়ে নিজেদের অনুপ্রবেশকে গভীরতর এবং নিয়ন্ত্রণকে ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী করে তুলেছে, তারাই এখন সমস্ত ক্ষমতাকে আত্মসাৎ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। ক্ষমতার সংহতকরণ ও কেন্দ্রীভবন মোদী সরকারের বৈশিষ্ট্য রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। আর যে ক্ষমতা তারা নিজেদের হাতে রাশিকৃত করছে, ভারতের কৃষক ও শ্রমিক এবং সাধারণ জনগণের স্বার্থের বিনিময়ে তার সমস্তটাকেই কাজে লাগানো হচ্ছে আদানি-আম্বানী সাম্রাজ্যের সুবিধার স্বার্থে। নীতীশ কুমার বিহারের বিশেষ মর্যাদা পাওয়ার ব্যাপারে প্রভূত উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেও মোদী সরকার কিন্তু সুপরিকল্পিতভাবে ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয়তাকে ধ্বংস করছে। জম্মু ও কাশ্মীরের মতো সংবিধান স্বীকৃত রাজ্যের শুধু বিশেষ মর্যাদাই হরণ করা হয়নি, তার রাজ্যের মর্যাদাটুকুও কেড়ে নিয়ে তাকে দুটো কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে পর্যবসিত করা হয়েছে। সহযোগিতামূলক যুক্তরাষ্ট্রীয়তার বুলি কিন্তু আর জুলুমবাজি ভিত্তিক কেন্দ্রীভবনের বুলডোজারকে আড়াল করতে পারছে না। নরেন্দ্র মোদী ও নীতীশ কুমারের সরকার দুটোর দিকে তাকিয়ে আমরা “চূড়ান্ত ক্ষমতা চূড়ান্ত রূপে নীতিহীন করে তোলে” প্রবাদটাকে একটু অদলবদল করে নিয়ে বলতে পারি, “চূড়ান্ত ক্ষমতা নিয়ে আসে চূড়ান্ত ঔদ্ধত্য ও চরম আগ্ৰাসন।” যে ‘দু-ইঞ্জিন ওয়ালা’ সরকার বিহারকে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে, তাকে ক্ষমতা থেকে অপসারিত করতে হবে।
বিহার ১৯৭০-এর দশকে গণতন্ত্রের এক গুরুত্বপূর্ণ রণাঙ্গন হয়ে দেখা দিয়েছিল। জয়প্রকাশ নারায়ণের পথপ্রদর্শনে ১৯৭৪র ছাত্র আন্দোলন গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধারে এবং জরুরি অবস্থার অবসানে প্রবল ভূমিকা পালন করেছিল। বিহার আরও একবার ১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে সংঘ বাহিনীর সামন্ততান্ত্রিক-সাম্প্রদায়িক আগ্ৰাসনের বিরুদ্ধে সামাজিক ন্যায় ও ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিল। বিহারকে আজ আবার তার সমস্ত শক্তি, উদ্যম ও অঙ্গীকারের সম্মিলন ঘটিয়ে মোদীর ফ্যাসিবাদী বুলডোজারকে রুখে দিতে হবে, সংবিধানকে বাঁচাতে, গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধার করতে এবং জনগণের জন্য অধিকার অর্জন করতে হবে। বিহারে সিপিআই(এমএল) বিহারি সমাজের সর্বাপেক্ষা নিপীড়িত ও প্রান্তিক অংশের পার্টি হিসাবে উঠে আসে, এবং পাঁচ দশক আগে পথ চলা শুরুর পর থেকে সে সামন্ততান্ত্রিক হিংস্রতা ও রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের মোকাবিলা করে গণতন্ত্র, মর্যাদা ও সামাজিক রূপান্তরণের পতাকাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার পথে অবিচল থেকেছে। বিহার বিধানসভায় সিপিআই(এমএল) বিধায়করা ক্লান্তিহীনভাবে ন্যায় ও জনগণের অধিকারের পক্ষে উদ্যোগ নিয়েছেন। মোদী সরকার তার ফ্যাসিবাদী আগ্ৰাসন অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাচ্ছে এবং সংঘ বাহিনী বিহারের দখল নিয়ে পাশের রাজ্য উত্তরপ্রদেশের মতো তাকে সামন্ততান্ত্রিক-সম্প্রদায়িক-পিতৃতান্ত্রিক হিংসা, ধর্মান্ধতা ও ঘৃণার পরীক্ষাগারে পরিণত করার দুরভিপ্রায় চালাচ্ছ। বিহার ও ভারতের ইতিহাসের এই সংকটময় রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে এর বিরুদ্ধে যে বিস্তৃত ঐক্য আত্মপ্রকাশ করছে, তাকে শক্তিশালী করে তুলতে সিপিআই(এমএল) তার সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করতে অঙ্গীকারবদ্ধ।
অর্থনৈতিক বৃদ্ধি এবং পরিকাঠামো উন্নয়নের লম্বাচওড়া দাবি সত্ত্বেও বিহার আজও স্থায়ী দারিদ্র্য, নাছোড় অর্থনৈতিক পশ্চাদপদতা এবং জনস্বাস্থ্য ও জনশিক্ষার অতলস্পর্শী দুর্বলতার মধ্যে আটকে রয়েছে। লকডাউন পর্বে বিহারের লক্ষ-লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক ও ছাত্র-ছাত্রীদের যে যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে তা গোটা দুনিয়ার সামনে কর্মহীন বৃদ্ধি এবং ভালো কাজ ও শিক্ষার সুযোগের সন্ধানে শ্রমিক ও ছাত্র-ছাত্রীদের স্থানান্তর গমনের অব্যাহত ধারার বাস্তবতাকে প্রতীয়মান করেছে। বিহারের উন্নয়নের এজেণ্ডাকে কখনই হরেক প্রকল্পের এক জগাখিচুড়িতে পর্যবসিত হতে দেওয়া যাবে না, যার উপরিতলে সামান্য অভিঘাত সৃষ্টির সমর্থ্যও থাকে না এবং যা বড় ধরনের ও লাগাতার কোনো সমস্যার মূল কারণের সমাধান থেকে শতহস্ত দূরে থাকে। উন্নয়নের এজেণ্ডাকে জনগণের ক্ষমতায়ন ও সামাজিক রূপান্তরণের পরিপ্রেক্ষিতেই দৃঢ়ভাবে স্থাপিত করতে হবে এবং ন্যায়, স্বাধীনতা ও সাম্যের সাংবিধানিক অধিকার দ্বারা চালিত হতে হবে। আশা ও পরিবর্তনের এই সম্মুখদর্শী বীক্ষাকে সামনে রেখে সিপিআই(এমএল) ২০২০-র নির্বাচনী ইস্তাহার প্রকাশ করছে, যে ইস্তাহার বিহারের জনগণের পরিস্থিতিকে উন্নত করতে পার্টির স্থায়ী অঙ্গীকারের এক সনদ হয়ে থাকবে।
(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয়, ৬ অক্টোবর ২০২০)