বিশ্বের অন্যতম প্রধান মানবাধিকার সংগঠন ‘অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশানাল’ ভারতে তাদের কাজকর্ম বন্ধ করে দিতে একপ্রকার বাধ্যই হচ্ছে পরিস্থিতির চাপে। অ্যামনেস্টি ইন্ডিয়ার পক্ষ থেকে জারি করা এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ভারত সরকার তাদের সব ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে লেনদেন বন্ধ করে দেওয়ার পর সেখানে তাদের পক্ষে আর কোনও ক্যাম্পেইন বা গবেষণা চালানো সম্ভব নয়।
ভারতে মানবাধিকার তথা সিভিল লিবার্টিজ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত অনেকেই বলছেন, ভারতে যখন সমাজের নিপীড়িত শ্রেণী ও সংখ্যালঘুরা বারবার আক্রান্ত হচ্ছেন এবং কাশ্মীরের মতো দেশের নানা প্রান্তেই মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে – তখন এভাবে ভারতে অ্যামনেস্টির কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যাওয়াটা বিরাট এক আঘাত।
ভারতে অ্যামনেস্টির কার্যক্রমকে বারবার সরকারের বাধার মুখে পড়তে হয়েছে। ভারতে বিভিন্ন সরকারী সংস্থা বহুদিন ধরেই তাদের আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি তদন্ত করে দেখছে।
বস্তুত ভারত-শাসিত কাশ্মীরের মানবাধিকার পরিস্থিতিই হোক বা কিংবা মুসলিমদের পিটিয়ে মারার ঘটনা – সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যে সব সংগঠন সরকারের সমালোচনায় সবচেয়ে সরব, অ্যামনেস্টি ইন্ডিয়া ছিল তার প্রথম সারিতেই।
ভারতের সরকারী কর্মকর্তারা অবশ্য দাবি করছেন, অ্যামনেস্টি ইন্ডিয়া বহুদিন ধরেই বিদেশ থেকে অবৈধভাবে অর্থ গ্রহণ করছে এবং তার মাধ্যমে ‘ফরেন কন্ট্রিবিউশন (রেগুলেশন) অ্যাক্ট’ বা এফসিআরএ লঙ্ঘন করে আসছে। দিল্লিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে বলা হয়েছে, অ্যামেনেস্টির ভারতীয় কার্যালয় ‘প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ’এর (এফডিআই) রুট ব্যবহার করে ব্রিটেন থেকে বিপুল পরিমাণ অনুদান পেয়েছে – যেটা তারা করতে পারে না।
বস্তুত ২০১৮ সালেই ভারতের এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টোরেট (ইডি) ভারতে অ্যামনেস্টির সব ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট জব্দ করে দিয়েছিল। সেই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আদালতে গিয়ে অ্যামনেস্টি সাময়িক অব্যাহতি পেলেও পরে তাদের বিরুদ্ধে ইডি আবার একই ধরনের পদক্ষেপ নেয়।
অ্যামনেস্টি ইন্ডিয়া জানিয়েছে, সেপ্টেম্বর মাসের ১০ তারিখে তারা জানতে পারে যে তাদের কোনও ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টেই তারা লেনদেন করতে পারবে না, কারণ সরকারের পক্ষ থেকে ইডি তার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এরপর কর্মীদের মাইনে দেওয়া, চলমান ক্যাম্পেইন, গবেষণা বা ফিল্ড রিপোর্টগুলোর খরচ চালানো অ্যামনেস্টির পক্ষে একেবারে অসম্ভব হয়ে পড়ে – যার ফলশ্রুতিতে এদেশে কার্যালয় বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
অ্যামনেস্টি ইন্ডিয়ার নির্বাহী পরিচালক অবিনাশ কুমার বলেছেন, “গত দুবছর ধরে আমাদের বিরুদ্ধে সরকার একনাগাড়ে যে ক্র্যাকডাউন চালাচ্ছে আর এই যে আমাদের অ্যাকাউন্টগুলো সব জব্দ করা হল, এটা কোনও কাকতালীয় ঘটনা নয়।”… “সরকার আমাদের লাগাতার যেভাবে হেনস্থা করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, এটা সেই পরিকল্পনারই অংশ”, দাবি করেছেন তিনি।
সাম্প্রতিককালে দিল্লির সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় দিল্লি পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলা এবং কাশ্মীরের সরকারের মানবাধিকার রেকর্ডের সমালোচনা করার সঙ্গেও এই পদক্ষেপের সম্পর্ক থাকতে পারে বলে অ্যামনেস্টি মনে করছে। এবছরের ফেব্রুয়ারী মাসে ভারতের রাজধানী দিল্লিতে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছিল, তাতে সেখানকার পুলিশও সামিল হয়েছিল, অগস্টে প্রকাশিত এক রিপোর্টে অ্যামনেস্টি এই অভিযোগ করেছিল।
সেই রিপোর্টে তারা আরও অভিযোগ করেছিল যে দাঙ্গা আটকানোর জন্য যেমন পুলিশের সক্রিয় ভূমিকা অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়নি, তেমনই দাঙ্গা পীড়িত মানুষ যখন ফোন করে পুলিশের সাহায্য চেয়েছেন, তখনও তাদের একাংশকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়নি।
এইসব রিপোর্ট সরকারের অস্বস্তি বাড়াচ্ছিল আর সে কারণেই যে সরকার এই সংস্থার কাজকর্ম বন্ধ করে দিতে উদগ্রীব তা স্পষ্ট।